সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০০৮

গাজার প্রতিটি মৃত্যু যখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়

1 টি মন্তব্য :
 
ছবি সত্বঃ বিবিসি
দেশের সংবাদপত্রগুলো যখন নির্বাচন নিয়ে মহাব্যস্ত তখন প্যালেস্টাইনের গনহত্যা অনেকের চোখকে এরিয়ে যাচ্ছে ইচ্ছে করেই, কিন্তু মানুষের বিবেকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে নোংরা রাজনীতির কাছে মানবতা কতটুকু অসহায়।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ২৭৫, যা ক্রমাগত বাড়ছেই। টিভির খবরে নিহত-আহত মানুষ নিয়ে অসহায় ছুটোছুটির ফাঁকে আকাশ থেকে ধেয়ে আসছে মৃত্যুবান। মানবতা সেখানে অসহায় - শান্তির বাণী সেখানে অদৃশ্য -ধর্মের বাণী যেখানে অচ্যুত।

গাজার এই মানুষগুলো কি আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো শান্তিতে বাঁচতে চায়নি ?
নৈতিকতারর কোন মানদন্ডে এই হত্যাকে সমর্থন করা যায় ?
আইনের কোন দৃস্টিকোনে এ হত্যাযগ্যকে সমর্থন করা যায় ?
এ গনহত্যা কি আসলেই প্রয়োজনীয় ছিলো ?
সীমান্তের এপার-ওপারের সাধারন মানুষ কি এ হত্যা- সন্ত্রাসকে সমর্থন করে ?



এইসব প্রশ্নের উত্তর কখনোই পাওয়া যাবে না, যায় না। নোংরা ক্ষুদ্র রাজনীতি, যুদ্ধকৌশল, নিরাপত্তা ও সীমান্ত প্রতিরক্ষা, রাষ্ট্রনীতি এবং একই সাথে সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিবেচনার উপরে নির্ভর করে এইসব প্রশ্নের উত্তর। তবুও উত্তর মেলে না।





 ছবি সত্বঃ বিবিসি

শান্তির মা আজ মৃত। ইশ্বর আজ বধির-মৌন।

গাজার এই সব মানুষগুলোর জন্য সমবেদনার সাথে সাথে সৌহার্দ পোষন করছি। এ চরম অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাই। প্রতিরোধের সাথে সহমর্মিতা জানাই প্রতিটি মুহুর্তে।

শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০০৮

নিদারুন কস্টের এক গল্প

কোন মন্তব্য নেই :
নাম করনে গল্প হলেও পৃথিবীর কোনো এক অংশে অভিনীত এক নাটকের ছোট্ট একটি অংশ এটি। জীবনের চলার পথে জনৈক বন্ধুর কাছ হতে শোনা ঘটনাটি শুনতে শুনতে ভাবছিলাম এমনোও কি হয় !

জীবনে কতো কিছুই না ঘটে। কিছু ঘটনা হয়তো স্মৃতি হতে ধীরে ধীরে মুছে যায় , কিছু স্মৃতি মনের গহীন অতলে ঠিকই ধিকি ধিকি করে জ্বলতে থাকে। গল্পটি না হয় সেই বন্ধুর মুখ থেকেই শোনা যাক।

" সারা রাত কাজ শেষে বাসায় যখন এসেছিলাম ঘড়িতে তখন ভোর ৪ টা। প্রচন্ড ক্লান্ত, ততোধিক ভয়াবহ খিদে। দু প্যাকেট নুডুলস সেদ্ধ করে তাতে সামান্য কিছু মিক্সড ভেজি মিশিয়ে ঘুমুতে যাবার সময় ঘড়িতে এলার্ম সেট করতে ভুলিনি। সকালে দূর শহর হতে আমাকে দেখতে আসবে। এতোদিন জানতাম মেয়েদেরই দেখতে আসে, এখন ছেলেদেরও দেখতে আসে। মেয়েদের যদি আনুস্ঠানিক/অনানুস্ঠিক ভাবে দেখতে যাওয়া যায় তবে ছেলেদের ব্যপারে কেনোইবা তার ব্যতিক্রম হবে ?

প্রচন্ড টেনশন হচ্ছিলো। সুন্দর কাপড় পড়তে হবে, ভালো করে নিজেকে তাদের সামনে উপস্থাপিত হতে হবে। আচ্ছা কি ভাবে কথা বল্লে তারা ইমপ্রেসড হবেন ! ইত্যাদি নানান সব ভাবনা। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টেরই পাইনি।

মোবাইলের রিঙের শব্দে ঘুম যখন ভাঙলো তখন ঘড়ির কাঁটা কোন ঘরে ছিলো সেটাও মনে নেই। আজকালকার ডিজিটাল ঘড়িতে অবশ্য কাঁটার বদলে সংখ্যা ভাসে। অচেনা নাম্বার থেকে ঘুম জড়ানো গলায় হ্যালো বলতেই শুনতে পেলাম উনারা আর মাত্র ১ ঘন্টার দূরত্বে রয়েছেন। ক্লান্ত শরীরে এটা শোনার পরও আবার কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। ঘুম যখন ভাঙলো তখন দড়জায় উনারা দাঁড়িয়ে। গরীবের ভাঙা কুটির দেখে আশাহত যে হয়েছিলেন সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। চা এর কথা বলতেই উনারা বল্লেন বাহিরে কোথায় খেতে খেতেই না হয় আলাপ সারা যাবে।

পকেটে একাউন্ট নিংরে বের করা সবটুকু টাকা নিয়ে রেস্টুরেন্ট গিয়ে ভাবছিলাম কি কথা হবে। মানুষের চোখ নাকি অনেক কিছু বলে দেয়। আমি তাদের চোখ পড়বার চেস্টা করছিলাম। চেস্টা করছিলাম তাদের গলার স্বর থেকে মনের ভাব বোঝার। আপ্রান চেস্টা ছিলো তাদের সন্তুস্ট করবার। কত কিছু ভেবে রেখেছিলাম। কিছুই জানতে চাইলেন না। কথায় দায়সারা ভাব, যেনো ইন্টারভিউ বোর্ডে আগেই সিলেক্ট করা প্রার্থীকে চাকুরি দেবার জন্য অন্য সব প্রার্থীকে অবান্তর অপ্রাসংগিক সব প্রশ্ন করা।"

তার পর কি হলো বস ?

" কি আর হবে, সব কিছু শেষে উনারা আমাকে নামিয়ে চলে গেলেন। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম উনাদের গাড়ি আস্তে আস্তে ধীরে দূরে হারিয়ে যাচ্ছে।"

তার পর?

" তারপর আর কি, জীবন জীবনের মতো চলতে থাকে। স্বপ্ন দূস্বপ্নে পরিনত হলো। এক সময় সব কিছুই স্বাভাবিক হয়ে এলো তবুও সে সব ঘটনা ভুলতে পারি না। মাঝে মাঝে শেখ সাদির সেই গল্পের কথা মনে পরে; পোষাক দিয়ে মানুষ যাচাই। টাকা দিয়ে মানুষ যাচাই, চেহারা দিয়ে মানুষ যাচাই। অথচ কেউই মানুষের ভেতরটাকে দেখতে চায় না, জানতে চায় না, বুঝতে চায় না। "

তার পর ?

"জীবনতো আর থেমে থাকে না। ভালো আছি, সুখে আছি, শান্তিতে আছি । সে সময় সব কিছুই বুজতে পেরেছিলাম, প্রসন্ড কস্স্ট লাগছিলো কিন্তু সবসময় জানতে ইচ্ছে হয় ঠিক কি কারনে উনারা আমাকে অপছন্দ করেছিলেন।"

টেলিফোনে হাজার মাইল দূর থেকেও উনার দীর্ঘনিঃশ্বাষ শুনতে পাচ্ছিলাম। জীবনটা আসলেই বড্ড বিচিত্র। বিশাল এক নাট্য মন্চ, আমরা যার যার ভুমিকায় অভিনয় করে যাচ্ছি সুনিপুন ভাবে।

শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০০৮

মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও - ১.৭ শেষ ( একটি কথ্য ইতিহাস)

কোন মন্তব্য নেই :
প্র: আপনি ১৫ এপ্রিল ঠাকুরগাঁওয়ের পতন হয় বলেছেন। পুনরায় রি-অরগানাইজ হয়ে কবে থেকে আপনারা যুদ্ধ শুরু করলেন ?
উ: এরপর তো ভারতে গিয়ে আমরা পুনরায় সংগঠিত হতে লাগলাম। ভারতে এসে যোগাযোগ করতে করতেই তো এক মাস সময় লেগে গেলো। মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর আমরা দ্রুত সংগঠিত হতে শুরু করলাম। আমার মনে আছে, আমরা ছোট্ট একটা ঘরে ১৬ জন ঘুমিয়ে ছিলাম। চিৎ হয়ে শুলে চার আনা আর কাত হয়ে শুলে দুই আনা-এ রকম একটা অবস্থানে ছিলো সে সময়। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়ে আমরা পুনরায় অপারেশন শুরু করতে পেরেছিলাম সম্ভবত: জুন মাস থেকে।

প্র: মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের মানুষের ধারণা কেমন ছিলো ?
উ: মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে জনগণের ধারণা ভালো ছিলো বলেই তো দেশটা স্বাধীন হতে পেরেছে। মুক্তিযোদ্ধারা যখনই যে জায়গায় বা এলাকায় ঢুকেছে, তখনই সেই এলাকায় তারা আশ্রয় পেয়েছে। স্থানেনীয় জনগণ যদি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় না দিতো, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ কখনই এই পর্যায়ে শেষ হতে পারতো না। মুক্তিযোদ্ধারা যে সমস্ত জায়গায় পাক আর্মিদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিলো বা ব্রিজ-কালভার্ট ধ্বংস করেছিলো তার প্রত্যেকটাই স্থানেনীয় জনগণের সাহায্য সহযোগিতায় তারা করেছিলো। মুক্তিযোদ্ধারা সাধারণভাবে রাতে ঘুরে বেড়াতো। কারণ পাকিস্তানআর্মি গ্রামগঞ্জের কোথাও রাতের বেলা বেরুতো না। স্থানেনীয় জনগণের কারণেই আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা, খাওয়া বা ঘুরে বেড়ানোর কোনো অসুবিধা হয়নি।

প্র: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কি আপনি peoples war বলে মনে করেন ?
উ: অবশ্যই।

প্র: কিভাবে ?
উ: পূর্ব পাকিস্তানের আম-জনতা অনেকদিন যাবতই পাকিস্তান সরকারের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলো। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ থেকে তারা যে অর্থ শোষণ করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাচ্ছিলো সেই সম্পর্কে ক্ষোভ অনেকদিন থেকেই মানুষের মনে দানা বাঁধছিলো। এই ক্ষোভটা রাতারাতি সৃষ্টি হয়নি। এর পিছনে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের যথেষ্ট অবদান ছিলো। আওয়ামী লীগের ৬ দফা, ১১ দফা এগুলো বাংলাদেশের জনগণের প্রাণের দাবি ছিলো এবং শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী যখন হামলা চালালো তখন অন্য কোনো রাস্তা না দেখে তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। কেউ অস্ত্র হাতে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ করেছে আবার কেউ পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছে, সহযোগিতা করেছে, আশ্রয় দিয়েছে। যারা ভারতে গিয়েছিলো তারাও যুদ্ধের অংশীদার। কারণ তারা নিজেদের বাড়িঘর সহায় সম্পদ সব কিছু ছেড়ে বিদেশে রিলিফ ক্যাম্পে ছিলো। এটাও যুদ্ধের একটা অংশ। যারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছিলো, পাকিস্তানি আর্মির অত্যাচার সহ্য করেছিলো এবং তারপরও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলো- এটাও যুদ্ধের একটা অংশ। সর্বোপরি ১৯৭০ সালে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত মুজিবনগর সরকারই এ যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। সুতরাং এই যুদ্ধকে আমি peoples war বলেই মনে করি।

প্র: আমরা লক্ষ্য করেছি যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিবাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক হারেই অত্যাচার করেছে। আপনার এলাকায়ও কি এ রকম ঘটনা ঘটেছে ?
উ: আমার এলাকায় এ রকম তেমন ঘটনা ঘটেনি। এ কথা আমি বলতে পারি এই কারণে যে, আমার এলাকার তিন দিকেই ভারতীয় বর্ডার খুব কাছাকাছি ছিলো। প্রথম অবস্থানেতে যারা ভারতে চলে গিয়েছিলো তাদের বেশির ভাগই ছিলো হিন্দু। ফলে, হিন্দুদেরকে তারা খুব একটা পায়নি। প্রত্যেকটা এলাকা থেকে হিন্দুরা সব চলে গিয়েছিলো। ফলে, পাকিস্তানিরা আলাদা করে হিন্দুদের উপর অত্যাচার করার সুযোগ পায়নি। তবে কোনো কোনো এলাকায় সীমিতসংখ্যক মাইনোরিটি থাকলেও থাকতে পারে। তবে উল্লেখযোগ্য নয়। জাতিভাঙ্গাতে যে হিন্দুদের হত্যা করা হয়েছিলো সেটা পাক আর্মি করেনি। রাজাকার, বিহারী আর আল-বদর-রা এ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলো। ওখানে পাক আর্মির কোনো অংশ গ্রহণ ছিলো না।

প্র: স্বাধীনতার ৩২ বছর পর একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ণ করবেন ?
উ: আমার মনে হয়, পাকিস্তান আমলের মাঝামাঝি সময় থেকে শেষ দিন পর্যন্ত এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের পরেও নেতৃবর্গ এবং আমরা যারা বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলাম, আমরা যে মন-মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ ছিলাম, সেই মন মানসিকতা, চিন্তাধারা এখন এতোটাই নিচে নেমে গেছে যে, আজকে আমার সামনে হতাশা ছাড়া আর কিছু নেই। এমন বাংলাদেশ আমরা চাইনি। হিন্দু সমঙ্রদায়ের একজন সদস্য হিসাবে আমি বিশেষভাবে বলতে চাই যে, পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিলো দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। কায়দে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তখন বলেছিলেন যে,Muslims of India should have a separate state for their own cultural tradition. কিন্তু পাকিস্তান অর্জনের পর সেই কায়দে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বুঝতে পারলেন যে, রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে ধর্মকে প্রাধান্য দিলে সেই রাষ্ট্র চলতে পারে না। এই জন্যই পরবর্তীতে এক কনফারেন্সে তিনি বলেছিলেন, ধর্ম হিসাবে কোনো নাগরিককে বিচার করা হবে না, এ দেশের একজন নাগরিক হিসাবেই বিবেচনা করা হবে। এই ঘটনার ঠিক উল্টোটা ঘটে আমাদের দেশে। দেশটা স্বাধীন হওয়ার আগে চারটি স্বীকৃত রাজনৈতিক দাবি আমাদের ছিলো-১. গণতন্ত্র, ২. জাতীয়তাবাদ, ৩. ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ৪. সমাজতন্ত্র। স্বাধীনতার পর আমরা যারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছিলাম, আমাদের কাছে মূল বিষয়টা ছিলো ধর্মনিরপেক্ষতা। কারণ ধর্মের কারণে পাকিস্তান আমলে আমরা নিজেদেরকে প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে দেখতে পেতাম না। আমাদের অনেক আশা ছিলো যে, পাকিস্তানের হাত থেকে যদি দেশটা স্বাধীন হয় তাহলে সেই দেশটা হবে প্রকৃতপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ এবং আমি সংখ্যালঘু বলে আমাকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে ভাবতে হবে না। আর এ কারণেই আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। কিন্তুদেশটা স্বাধীন হওয়ার কিছু দিন পরই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও রাষ্ট্রীয় মূল চার নীতি বিসর্জন দেয়া হলো। পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে আমূল পরিবর্তন আনা হলো, ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দেয়া হলো। আমরা ধীরে ধীরে সেই পাকিস্তানি আমলের যে রাজনীতি, যে রাষ্ট্র ব্যবস্থানে ছিলো, সেই দিকেই ফিরে যাচ্ছি। অর্থাৎ ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসাবে পাকিস্তানি আমলে আমরা যে অবস্থানেয় ছিলাম এখন আবার সেই অবস্থানেয় ফিরে যাচ্ছি। পাকিস্তানি আমলে ফিরে যাচ্ছি বললে সত্যের অপলাপ করা হবে বরং ফিরে গেছি বলাই সঙ্গত।

প্র: যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলো- রাজাকার, আল-বদর যারা ছিলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এদের কি গ্রেফতার করা হয়েছিলো ? এ সম্পর্কে আপনি কি জানেন ?
উ: ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে ১৪৩ জনের একটা লিস্ট তৈরি করা হয়েছিলো। যাদেরকে আমরা বাংলাদেশ বিরোধী কার্যকলাপের সাথে জড়িত থাকার সন্দেহ করতাম- তাদের নাম এই তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরা হয়। তালিকায় শান্তি কমিটির লোকজনেরও নাম ছিলো। এদের মধ্যে অল্প কিছুসংখ্যক লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। পরবর্তীকালে এম. পি. এ. ফজলুল করিম সাহেবের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, এই লোকগুলোকে গ্রেফতার করা ঠিক হবে না। গ্রেফতার করা হলে দেশে স্বাভাবিক অবস্থানে বা শান্তি ফিরে আসবে না। সে জন্য খুব অল্পসংখ্যক লোককেই সে সময় ধরা হয়েছিলো। পরবর্তীকালে তো বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমাতে তারাও ছাড়া পেয়েছে। কয়েকজনকে মাত্র ধরা হয়েছিলো। যেমন- ওমর আলী, নূরুল হক চৌধুরী-এ রকম ১০/১২ জনকে বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরা হয়েছিলো। পরবর্তীকালে এদেরকেও ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো কোনো মামলা মোকর্দ্দমা ছাড়াই।

আসলে সে সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা ছিলেন তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে খুব একটা তৎপরতা আমি লক্ষ্য করিনি। ’৭১-এ যে হত্যাযজ্ঞ চলেছিলো, যে অত্যাচার চলেছিলো, সে ব্যাপারে মোর্কদ্দমা হয়েছিলো বটে, কিন্তু সাক্ষি পাওয়া যায়নি। ধীরে ধীরে লোকজনও কেমন যেন নির্লিপ্ত হয়ে পড়লো এবং আমরাও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লাম। অপরাধীরা এমনিভাবেই ছাড়া পেয়েছে। কারোরই জেল হয়নি। কিছুদিন আটক ছিলো মাত্র। কিন্তুবিচার করে শাস্তি দেয়া এ রকম কারো ক্ষেত্রেই ঘটেনি । আমি তো একজন আইনজীবী আমি জানি।

প্র: আপনি কি আমাদের আর কিছু বলবেন ?
উ: বাংলাদেশের মধ্যে আমার ধারণায় সবচেয়ে গরীব এলাকা হচ্ছে পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও। গ্রামে গেলে আপনি এমন একটা এলাকা পাবেন না যারা দু’বেলা পেট ভরে ভাত খায়। এক বেলা ভাত খায় আর আরেক বেলা অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে থাকে। এদের চাইতেও যারা নিচু বা গরীব যাদের সংখ্যা সবচাইতে বেশি তারা একবেলাও ভাত পায় না অনেক দিন। তারা কচু ঘেচু সেদ্ধ করে খায়। আমি প্রতি শুক্রবার গ্রামে যাই তাদের অবস্থানে দেখতে। চোখে না দেখলে আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না তাদের অবস্থানে। আবার যখন ঢাকায় আসি তখন আমার মনে হয় না এটা বাংলাদেশ। মনে হয়, আমেরিকার কোনো অঙ্গরাজ্য বুঝি ! যে দেশের লোক একবেলা পেট ভরে ভাত খেতে পায় না, সে দেশের এতো প্রাচুর্য ! গুটিকয়েক লোকের কাছে এতো অর্থ যে, তারা নিজেরাও জানে না তাদের টাকার পরিমাণ কত। আমাদের এলাকায় এখনো বহু লোক ৫০০ বা ১০০০ টাকা এক সাথে কোনোদিন দেখেনি। পাকিস্তান আমলে গুটিকয়েক কোটিপতি ছিলো। আর এখন বাংলাদেশে কয়েক’শ কোটিপতি। এটাই কি স্বাধীনতার মূল্যবোধ ? এর জন্যই কি দেশ স্বাধীন হয়েছিলো ? এটাই কি আমরা চেয়েছিলাম ?

শেষ

শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০০৮

বীরাঙ্গনা গুরুদাসীর জন্য একটি ভন্ড এলিজি

২টি মন্তব্য :
বীরাঙ্গনা গুরুদাসী তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাতের লাঠির আলতো বাড়ি মেরে আর এসে বলবেন না, ‘কেমন আছিস বাবা? ভালো আছিস তো? দে কয়ডা টাহা (টাকা) দে, তোরা না দিলি পাব কনে ক।’


স্বাধীনতার পর কোনো এক বিষন্ন দূপুরে বীরাঙ্গনা উপাধিতে ভূষিত করে আমরা উনাদের ধন্য করেছিলাম, যথাসময়ে ভুলেও গিয়েছিলাম। দীর্ঘ ৩৭ টি বছর ধরে উনাদের কেউ হয়তো বীরাঙ্গনা গুরুদাসীর মতো ভিক্ষের ঝোলা হাতে আমাদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেরিয়েছেন, কেউবা আত্নহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন আবার কেউবা আজো কস্টে নিভৃতে কাঁদেন। পাগলী বলে হয়তো অনেকের দিকেই ছুড়ে দিয়েছি ঢিল।

স্বাধীনতার জন্য নিজের সম্মান বিলিয়ে দিতে বাধ্য হওয়া এসব মানব সন্তানের খবর নেবার তাগিদ বা প্রয়োজন অবশ্য আমাদের নেই। আমরা উনাদের বীরাঙ্গনা বলে নিজেদের ধন্য করেছি কিন্তু সমাজে-পরিবারে গ্রহন করে নেইনি।

আজ পত্রিকার ভেতরের পাতার ছোট্ট কবরটি পড়ে কেউবা তাকে জননী ডাকছি, আমার মতো কেউবা ব্লগের পাতায় ভন্মামী করে এলিজি লিখে আত্মতৃপ্তিতে ভুগছি কিন্তু জীবদ্দশায় কেউ তাঁদের খোঁজ নেবার প্রয়োজনটুকু বোধ করিনি। জীবিত অবস্থায় কিছু না করে মারা যাবার পরে এসব করা ভন্ডামী ছাড়া আর কি !

বীরাঙ্গনা গুরুদাসীর নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় না থাকাতে রাস্ট্রীয় সম্মান অবশ্য উনার ভাগ্যে জুটেনি। যে মানুষটি ৩৭ টি বছর কোনো সম্মান পাননি দেশের কাছ থেকে, সমাজের কাছ থেকে, আমাদের কাছ থেকে; তার কাছে একদিনের লোক দেখানো সম্মানে কি এসে যায়।

বীরাঙ্গনা গুরুদাসী ওপার থেকে তাকিয়ে অভিশাপ দিয়ে বলছেন " ধিক এই অকৃতগ্য বাঙালী জাতি"।

------------------------------
বীরাঙ্গনা গুরুদাসী  আর নেই
নিজস্ব প্রতিবেদক( প্রথম আলো) , খুলনা

বীরাঙ্গনা গুরুদাসী তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাতের লাঠির আলতো বাড়ি মেরে আর এসে বলবেন না, ‘কেমন আছিস বাবা? ভালো আছিস তো? দে কয়ডা টাহা (টাকা) দে, তোরা না দিলি পাব কনে ক।’ সবার পরিচিত সেই অসহায় গুরুদাসী মন্ডল (৬৫) চিরবিদায় নিয়েছেন। খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনিতে নিজ বাড়িতে গত ৭ ডিসেম্বর গভীর রাতে তিনি পরলোকগমন করেন। ছাব্বিশে মার্চ, ষোলই ডিসেম্বর, একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে আর তাঁকে দেখা যাবে না।
গুরুদাসীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে খুলনার সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধারা কপিলমুনিতে হাজির হন। এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান খুলনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুর রউফ, পাইকগাছার নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। একাত্তরের এই দিনে কপিলমুনি হাইস্কুলের যে মাঠে গণ-আদালত বসিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল, সেই মাঠেই গুরুদাসীকে শেষ শ্রদ্ধা ও সালাম জানায় মুক্তিযোদ্ধাসহ উপস্িথত সাধারণ মানুষ। এ দৃশ্য দেখে কপিলমুনির হাজার হাজার শোকার্ত সাধারণ মানুষ।
গার্ড অব অনার দেওয়ার জন্য পুলিশের একটি চৌকস দল উপস্থিত থাকলেও মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় গুরুদাসীর নাম না থাকায় তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়নি। তবে মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল কাইয়ুমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা জাতীয় পতাকা দিয়ে তাঁর মরদেহ আচ্ছাদিত করে পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে শেষ সালাম জানান। পরে কপিলমুনি শ্মশানঘাটে তাঁকে দাহ করা হয়।

বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০০৮

মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও, পর্ব ১.৬ ( একটি কথ্য ইতিহাস-বলরাম গুহঠাকুরতা)

কোন মন্তব্য নেই :
প্র: আজকাল অনেকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতীয়দের ষড়যন্ত্র বলে মত প্রকাশ করছেন। এ বিষয়টাকে আপনি কিভাবে দেখেন ?
উ: ভারত তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য আমাদের দেশ স্বাধীন করার ষড়যন্ত্র করেছে- এটা যারা প্রচার করছেন তারা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থেই সেটা প্রচার করছেন। এ প্রশ্নে আমার যে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কেবল সেই অভিজ্ঞতারই পুনরুল্লেখ করবো। আমি বলেছি, এপ্রিল মাসের গোড়াতেই ভারতে গিয়েছিলাম এবং সে সময় বেশকিছু নেতৃস্থানেনীয় ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছিলাম। আমি কথা বলার আগ পর্যন্ত তারা আমাদের সম্পর্কে কিছুই জানতো না। আমি কথা বলেছিলাম ডি. এন. ঘোষ, শেরিফ অফ কলকাতার সঙ্গে। তিনি আমাদের প্রথমেই বললেন, আপনারা যে আমাদের কাছে আসলেন, Have you heard of any revolution that without making cell in the neighbouring country? Any revolution could be possible ? অর্থাৎ তিনি বলতে চাইলেন, আপনারা তো এই ঘটনার আগে আমাদের সাথে কোনো রকম যোগাযোগ করেননি। যেহেতু আপনারা যোগাযোগ করেননি সেহেতু প্রথমেই কিভাবে আপনারা আশা করেন যে, আমরা আপনাদের অস্ত্র দেবো ? তিনি শুধু কলকাতার শেরিফই নন, তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো ভারতের তখনকার রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরি এবং পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় রাজনীতিক প্রফুল্ল সেনের মতো লোকের সঙ্গে। কাজেই ভারতের সাথে কোনো রকম যোগাযোগ আমাদের ছিলো- এমন কথা বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিলো। যদি মূল্যায়ন করতে বলেন যে, দেশটা কিভাবে স্বাধীন হলো, তাহলে আমাকে একটা ছোট্ট গল্প বলতে হবে। গল্পটা হচ্ছে এ রকম :

লন্ডন থেকে একটা জাহাজ অনেক যাত্রী নিয়ে আমেরিকা যাচ্ছিলো। সেই জাহাজের তিন তলার এক মহিলা ডেকের রেলিং ঘেষে তার ছোট্ট এক শিশুকে বলছিলো, এই যে তুমি বিশাল জলরাশি দেখছো, এই জলরাশিই পৃথিবীর তিন চতুর্থাংশ জুড়ে রয়েছে। এই কথা বলার সময়ই শিশুটি হঠাৎ করে সমুদ্রে পড়ে যায়। শিশুটি সমুদ্রে পড়ে যাবার পর সবাই চারদিক থেকে চিৎকার করছে,help, help বলে। কিন্তু কেউই সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করবার চেষ্টা করছে না। তখন এক সরদারজী সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে বাচ্চাটাকে উদ্ধার করে আনলো। আমেরিকায় যখন জাহাজটা পৌঁছুলো তখন বহু সাংবাদিক, ফটো সাংবাদিক সরদারজীকে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি নিজের জীবন বিপন্ন করে যে পরের উপকার করলেন- কেন করলেন ? সরদারজী এ সব কথার উত্তর না দিয়ে বলেছিলো, বন্ধ করো সব বাজে কথা। আগে দেখ কে সে, যে আমাকে ধাক্কা দিয়েছিলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামটাও ছিলো কিছুটা সে রকম। আমার দৃষ্টিতে পাকিস্তানসরকার আমাদের ধাক্কা দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে ঠেলে দিয়েছিলো। আওয়ামী লীগ বা কোনো রাজনৈতিক দলের পৃথক কোনো দেশ গঠনের মনোভাব বা চিন্তাধারা ছিলো বলে জানি না। যদিও ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মাঠ পর্যায়ের কিছু নেতা সেটাকে স্বাধিকারের সংগ্রাম বলে চালিয়েছেন। কিন্তুতিনি প্রকৃত স্বাধীনতার সংগ্রাম বলেননি। আমি মনে করি, ২৫ মার্চ পাকিস্তানি আর্মি যদি জনগণের উপর এভাবে ঝাঁপিয়ে না পড়তো এবং নির্বাচনে জয়ী দলকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতো- তাহলে দেশটা স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে এগিয়ে যেতো না। আমি দৃঢ়তার সাথেই বলছি, কোনো রাজনৈতিক দলেরই ভারত সরকারের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ ছিলো না কিংবা ভারত সরকারও এদের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করেনি। এটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটেছে। সাধারণ মানুষ নিজেদের জীবন বাঁচাবার জন্যে, পাকিস্তানি আর্মিদের অত্যাচার, শোষণ, অবিচার থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য তখন স্বাধীনতা সংগ্রামে যেতে বাধ্য হয়েছে। এ যুদ্ধ কোনো বহির্শত্রু বা বাইরের কোনো সরকারের ইঙ্গিতে হয় নাই, দেশের জনগণই এটা করেছে। তবে ক্ষেত্রটা আওয়ামী লীগ দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তৈরি করেছিলো, মানুষকে তারা ঐ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলো- এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। সঙ্গে অন্য দলের ভূমিকাকেও খাটো করে দেখা ঠিক হবে না।

প্র: ইদানিংকালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কতিপয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার বলার চেষ্টা করছেন যে, তাদের নেতৃত্বেই যুদ্ধটা হয়েছে- এ সম্পর্কে আপনি কি বলেন ?
উ: কোনো সামরিক অফিসার বা ব্যক্তিত্ব কোনোভাবেই স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার দাবি করতে পারেন না। সেটা সঠিকও নয়। আমি মনে করি,তারা যদি তাদের নিজের জীবন বিপন্ন হতে না দেখতো, তাহলে তারা এই সংগ্রামে আসতো কি না বলা মুস্কিল। এখানে কোনো পলিটিক্যাল মোটিভেশন ছিলো না। তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে-এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা। এ প্রসঙ্গে আমি ঠাকুরগাঁওয়ের কথা বলতে পারি। শেষ দিন পর্যন্ত ইপিআর জোয়ানরা বলে গেলো যে তারা আমাদের সাথে যোগ দেবে। কিন্তুতারা আসেনি, যে কথা আমি পূর্বেই বলেছি। ইপিআর উইং কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ হোসেন যখন প্রত্যেককে আর্মস জমা দিতে বললেন, যখন তিনি সাধারণ জওয়ানদের কাছ থেকে আর্মস জমা নেওয়ার নির্দেশ দিলেন, কেবল তখনই তারা আর্মস নিয়ে বেরিয়ে আসলো এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলো। কিন্তুতার আগ পর্যন্ত তারা এই কাজটা করেনি। অর্থাৎ আমি যেটা বলতে চাই, তাহলো তাদের ব্যক্তিগত জীবন যখন বিপন্ন হতে লাগলো তখনই তারা এসেছে। এর সাথে অন্যান্য বিষয় ছিলো যেমন- তাদের উপর অবিচার করা হয়েছে, বৈষম্য করা হয়েছে; বাঙালি সোলজার হিসাবে তাদের ওপর অন্যায় করা হয়েছে- এগুলো সত্যি। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনেই তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে। এটা army revolution নয়, political revolution । পরবর্তীতে মুজিবনগর সরকারই সব কিছু পরিচালনা করেছে। এই সরকারের নেতৃত্ব ও নির্দেশেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। এখন কতিপয় সেনা অফিসার যদি নেতৃত্বের দাবি করেন তাহলে সেটা হবে অন্যায় দাবি এবং এই দাবি কখনই ইতিহাসের অংশ হতে পারে না।

প্র: বর্তমানে অনেকেই বলছেন যে, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই ভাষণ শুনেই নাকি বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো- এ সম্পর্কে আপনি কি জানেন ?
উ: আমাদের এলাকার খুব কম মানুষই কালুরঘাটের এই রেডিও বার্তা শুনেছে। আমরা যেহেতু পলিটিক্যালি খুব সচেতন ছিলাম এবং আমরা লোকমুখে যখন শুনলাম যে, আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোকজনও যুদ্ধে যোগদান করছে তখন অনেক কষ্টে কালুরঘাটের রেডিও বার্তাটা পরে শুনেছিলাম। কিন্তুআম-জনতা, শতকরা ৯০ ভাগ লোকই এ রকম কোনো কথা শোনেইনি। জনগণের বেশিরভাগ হয়তো দেশ ত্যাগ করতো না, যদি না তাদের জীবনের ভয় থাকতো। যখন পাকিস্তানিআর্মি আক্রমণ শুরু করলো, তখন তারা তাদের নিজেদের জীবন ও মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষার্থে দেশ ত্যাগ করলো। তারা কালুরঘাটের বক্তৃতা বা অন্য কোনো সামরিক কমান্ডারের বক্তৃতা শুনে দেশ ত্যাগ করেছে বা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে- এটা আমি মনে করি না।

আগামী পর্বে এই সাক্ষাতকার পর্ব সমাপ্য

রবিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০০৮

মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও, পর্ব ১.৫ ( একটি কথ্য ইতিহাস-বলরাম গুহঠাকুরতা)

কোন মন্তব্য নেই :
প্র: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তো আপনি অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। এ সময়ের এমন কিছু স্মরণীয় ঘটনার কথা কি বলবেন যা এখনও আপনার মনে স্মৃতি হয়ে আছে ?
উ: সেই স্মৃতি কিছুটা বেদনাদায়ক। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন আমাদের এলাকায় বেশ কিছু অবাঙালি বাঙালিদের হাতে নিহত হয়েছিলো, যেটা আমার কাছে অমানবিক বলে মনে হয়েছে। ছোট ছোট বাচ্চাদের পর্যন্ত যেভাবে মারা হয়েছিলো তা ছিলো বেদনাদায়ক। এমন ঘটনাও দেখা গেছে যে, অবাঙালি ইপিআর অফিসারের বউকে গোল পোস্টের বারে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে সাধারণ মানুষকে দেখাবার জন্যে। এই সমস ঘটনা আমার কাছে পৈশাচিক বলে মনে হয়েছিলো। আমাদের ইপিআর-এর সাথে আনসার ও মুজাহিদরা মিলে এই খুন-খারাবিগুলো করেছিলো বলে জানি। আমি তাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে বাধা দিতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তুতারা বলেছিলো উকিল সাহেব আমাদের রাইফেলটা কিন্তুউল্টো দিকে ঘুরে যেতে পারে। কথা বলবেন না। তখন আমি তাদেরকে আর কিছু বলিনি। কিন্তু মর্মাহত হয়েছিলাম।

প্র: কোন্‌ সময়টাতে এ সব ঘটনা ঘটেছিলো ?
উ: মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের ১২ তারিখের মধ্যে।

প্র: কোন্‌ কোন্‌ এলাকায় এ সব ঘটনা ঘটেছে ?
উ: দিনাজপুর জেলার গোটাটাতেই ঘটেছে। কিন্তু সব ঘটনা আমি নিজের চোখে দেখিনি। ঠাকুরগাঁওয়ের ঘটনা আমি নিজের চোখে দেখেছি।

প্র: ঠাকুরগাঁওয়ের কোন্‌ কোন্‌ এলাকায় দেখেছেন, নির্দিষ্ট করে নামগুলো বলবেন ?
উ: ঠাকুরগাঁও শহরের উত্তর পাশে গার্লস স্কুলের পাশে নদী ছিলো। সেই নদীর পারে নিয়ে গিয়ে তাদের গুলি করে মারা হতো।

প্র: কাদের কাদের মারা হয়েছে ? কোনো নাম কি আপনার মনে পড়ে ?
উ: অনেকের নাম আমার মনে পড়ে। হায়াত আশরাফ ও তার ছেলে। আমাদের বন্ধু আনোয়ার, কমর সেলিম, ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার, সাইফুল্লাহ, কুদ্দুস। এদের কেউ কেউ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলো। বখতিয়ার খাঁ ও তার ছেলে-পেলেরা। তার এক ছেলে অবশ্য বেঁচে আছে।
অবাঙালিদের হত্যার ব্যাপারে ন্যাপ, আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি বা আর যারা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন- তাদের কোনো হাত ছিলো না। প্রকৃতপক্ষে সেই সময় ইপিআর ক্যাম্প থেকে যারা অস্ত্র সহ বেরিয়ে আসলো এবং আনসার ও মুজাহিদ- যাদের কাছে রাইফেল ছিলো, গুলি ছিলো- তারাই এ সব কাজ করেছে। তাদের সঙ্গে অবশ্য কিছু দুষ্কৃতিকারীও ছিলো। তাদের উপর প্রকৃতপক্ষে কারোরই কোনো নিয়ন্ত্রন ছিলো না। কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রনই ছিলো না। যারা অবাঙালি নিধন করেছিলো- তাদের কয়েকজনের সঙ্গে আমি তখন বা পরে কথা বলেছি। তাদের ভীতিটা ছিলো এই রকম--পরবর্তীকালে দেশে যদি শান্তি ফিরে আসে এবং সরকার কাজ করে তখন এই অবাঙালিরাই সরকারের কাছে তাদের চিনিয়ে দেবে। এই ভয়টা সাংঘাতিকভাবে ওদের ওপর ভর করেছিলো। দেশটা যে এ ভাবে স্বাধীন হবে তারা সেটা ভাবতেই পারেনি। আমি যখন ব্যক্তিগতভাবে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম, মানুষকে যে এ ভাবে তোমরা হত্যা করলে সেটা কি ভালো ? তখন ওরা বললো, উকিল সাহেব আপনি জানেন না, পরবর্তীকালে আমাদেরকে কে চেনাবে ? বাঙালিরা আমাদের চেনাবে না। এই অবাঙালিরাই আমাদের চিনিয়ে দেবে যে এরা ইপিআর ছিলো। এরা এই কাজ করেছে। তখন আমাদের কোর্ট মার্শাল হবে। আমরা মারা যাবো।

কমর সেলিমের বাড়িতে বহু অবাঙালি আশ্রয় নিয়েছিলো, সেখানে গিয়ে গুলি করে করে হত্যা করা হয় তাদেরকে। পাশবিক অত্যাচার করে গুলি করা হয়েছে-এমন ঘটনা আমাদের এলাকায় কম। জেলখানায় কিছু লোক রাখা হয়েছিলো। জেলখানা থেকে বের করে তাদের গুলি করে মারা হয়েছিলো। আমি এবং কমিউনিস্ট পার্টির কামরুল হোসেন আমরা দু’জনেই চেষ্টা করেছিলাম খুন খারাবিটা বন্ধ করতে। কিন্তুতারা বন্ধ তো করেইনি, উল্টো আমাদের ভীতি প্রদর্শন করলো যে, তাদের রাইফেলের নল আমাদের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে। বস্তুত: সে সময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব কার্যকর ছিলো না, ছিলো রাইফেলধারীদের নেতৃত্ব। আজ আমার নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয়। এই সমস্ত লোককে আমরা আশ্বাস দিয়েছিলাম যে, চিন্তা করো না, কোনো অসুবিধা হবে না। আসলে আমাদেরও ধারণা ছিলো না যে, তাদেরকে এভাবে গুলি করে মারা হবে। আমরা যদি তাদেরকে বলতাম যে, রাতের অন্ধকারে যে যেদিকে পারো পালিয়ে যাও, তাহলেও হয়তো অনেক জীবন রক্ষা পেতো। কিন্তু আমরা তাদের বলেছি চিন্তা করবেন না, আমরা তো আছি। কিন্তু প্রয়োজনের সময় আমরা তাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি।

প্র: ঠাকুরগাঁওয়ে প্রকৃত অর্থে অস্ত্রের লড়াই যখন শুরু হলো- তখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা নিয়ন্ত্রন কাদের হাতে ছিলো ?
উ: নিয়ন্ত্রন রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে ছিলো না। যার হাতে অস্ত্র তার হাতেই ক্ষমতা। আমি বাধা দিতে গিয়ে বিপদগ্রস্ত হয়েছিলাম। আমরা পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা।

প্র: হত্যার সঙ্গে কি সম্পদ লুণ্ঠনের কোনো ব্যাপার ছিলো ?
উ: হ্যাঁ।

প্র: এর পিছনে কি কোনো বিশেষ কারণ কাজ করেছে ?
উ: লুন্ঠনটা কোনো বিশেষ অর্থে কাজ করেছে বলে মনে হয় না। লুণ্ঠনটা যে কেবল গুটিকয়েক অস্ত্র ধারীরাই করেছে তা নয়, বরং আমার জানা মতে, লুণ্ঠনটা করেছে সাধারণ মানুষ। গ্রাম-গঞ্জ থেকে লুণ্ঠনকারীরা এসে বিভিন্ন জায়গায় তারা লুট করেছে। এ সব আমরা নিজ চোখেই দেখেছি। এরা পলিটিক্যালি মটিভেটেড নয়। তারা কোনো রাজনৈতিক দল বা সেই দলের কোনো অঙ্গ-সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলো না। তাদের মূল কাজটাই ছিলো লুট করা। গ্রাম থেকে লোকজন এসে পাগলের মতো সব লুট করেছে। আর আমরা অসহায়ের মতো তা দেখেছি, কিছুই করতে পারিনি।

প্র: লুট কি কেবল অবাঙালিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘরে হয়েছে ?
উ: অবাঙালিদের তো বটেই। তারপর আমরা যখন চলে গিয়েছি বা যাচ্ছি তখন আমাদেরগুলোও লুট হয়েছে। আমাদের সব জিনিসপত্র নিয়ে গেছে।

প্র: যুদ্ধকালের কোনো ঘটনা কি আপনাকে এখনো পীড়া দেয় ?
উ: আমার যেটা বেশি করে মনে হয় সেটা হলো- অবাঙালিদের কেউ কেউ আমাদের উপর অনেকটাই নির্ভর করেছিলো। তারা ভেবেছিলো, বিপদের সময় আমরা তাদের সাহায্য সহযোগিতা করতে পারবো। কিন্তুআমরা কিছুই করতে পারিনি। এটা আমাকে খুব কষ্ট দেয়। আমরা যখন দেশ ত্যাগ করে আসতে লাগলাম তার আগ পর্যন্ত অবাঙালিদের মারা হয় এবং তাদের সঙ্গে যে গহনা ও টাকা-পয়সা ছিলো সেই সব গহনা ও টাকা পয়সা কন্ট্রোল রুমে জমা হচ্ছিলো এবং সেটার পরিমাণ ছিলো প্রচুর। সোনাদানা, টাকা সব ট্রাঙ্কে রাখা হচ্ছিলো এবং সার্বক্ষণিক সেখানে পাহারাদার ছিলো।

প্র: এটা কিভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছিলো ?
উ: যাদের মারা হচ্ছিলো বিভিন্ন জায়গায় সেখান থেকেই সংগৃহীত অর্থ-সম্পদ কন্ট্রোল রুমে জমা করা হচ্ছিলো। যারা এ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলো তারা কিছু নিয়েছে এ কথা ঠিক। কিন্তু বেশির ভাগই জমা হয়েছিলো কন্ট্রোল রুমে। এক সময় এই জমার পরিমাণটা, সোনা-দানা এবং টাকা পয়সায় বেশ বড় আকার ধারণ করলো। ঠাকুরগাঁওয়ের যখন পতন হতে শুরু করলো তখন কতিপয় নেতা এ সব সমঙদ নিয়ে পালিয়ে গেলো। আমি তাদের নাম বলবো না। আমি নিজ চোখে দেখেছি কারা এ সব নিয়ে গেছে। ঐ সব ব্যক্তিরা কিন্তু ভারতে পালিয়ে গেলেও পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো অবদান রাখেনি। তারা ঐ সব গয়নাগাটি, টাকা পয়সা কিভাবে কোথায় রাখবে- এইসব নিয়েই ব্যস্ত ছিলো।

প্র: এরা কোন্‌ দলের সেটা কি আপনার জানা ?
উ: হ্যাঁ, জানা। কারণ ঠাকুরগাঁও ছোট জায়গা। আমি সবাইকে বিশেষভাবে চিনি। কি ন্তুআমি তাদের নাম বলবো না। কারণ আমার নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে। কোন্‌ ব্যক্তি, কোন্‌ দলের, কারা কারা ব্যাঙ্ক লুট থেকে টাকা নিয়েছে এ সবই আমি জানি। কিন্তু তাদের সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারবো না।

প্র: আপনি বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে অবাঙালিদের উপর অত্যাচার করা হয়েছে। কিন্তুএই অবাঙালিরাই তো পাকিস্তানিদের সঙ্গে থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে এবং বাঙালি নিধন ও নারী ধর্ষণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে- এ সম্পর্কে আপনি কি বলবেন?
উ: আমাদের এলাকার অবাঙালিরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে তখন- যখন পাকিস্তানিরা ঠাকুরগাঁও দখল করলো। তারা এটা করেছে জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য। আমি জানি, ঠাকুরগাঁওয়ে এ সময় রাজনৈতিকভাবে এমন কোনো অবাঙালি নেতৃত্ব ছিলো না যে, তারা রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানের পক্ষে বা আমাদের বিপক্ষে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে পাকিস্তানিআর্মিরা যখন আমাদের এলাকা দখল করে নিলো এবং আমরা আমাদের এলাকা ছেড়ে চলে আসলাম তখন তারা অনেক অন্যায় কাজ করেছে। কেউ অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠনের জন্যে করেছে আবার কেউ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে করেছে এ কথা আমরা বলতে পারি।
চলবে.....

বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০০৮

মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও ১.৪ ( একটি কথ্য ইতিহাস-বলরাম গুহঠাকুরতা)

কোন মন্তব্য নেই :
প্র: মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আপনার এলাকার সীমান্ত বরাবর অনেক শরণার্থী ক্যাম্প গড়ে উঠেছিলো। এ সব ক্যাম্প কোথায় কোথায় গড়ে উঠলো, ক্যাম্পের অবস্থানে কেমন ছিলো। এ ব্যাপারে আপনি কিছু বলবেন কি ?
উ: কালিয়াগঞ্জের তরঙ্গপুর থেকে শুরু করে বিহারের কিষণগঞ্জ এবং সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গের ইসলামপুর এবং সেখান থেকে জলপাইগুড়ি পর্যন্ত অনেকগুলি ক্যাম্প ছিলো। তার মধ্যে দাড়িভিট বলে একটা ক্যাম্প ছিলো অনেক বড়। তরঙ্গপুরের ক্যাম্প ও অনেক বড় ছিলো। কিষণগঞ্জের ক্যাম্প ও বেশ বড় ছিলো এবং ইসলামপুরের মরাগতির ক্যাম্প ও অনেক বড় ছিলো। ক্যাম্প গুলোতে বাংলাদেশ থেকে আসা লোকজন আশ্রয় নিয়েছিলো। ভারত সরকার চাল, ডাল, তেল, নুন সব দিতো। আশ্রয় নেয়া মানুষ কেবল রান্না করে খেতো। খড়ের একেকটা ঘরে ৪/৫ জন করে শরণার্থী থাকতো। প্রতিটি ক্যাম্পে আমি, এম. পি. এ. ফজলুল করিম সাহেব, নূরুল হক সাহেব, কামরুল হোসেন সাহেব, রশীদ করিম সাহেব সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন সময় গেছি। রশীদ করিম সাহেব প্রথমে তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলেন। পরে কিষণগঞ্জের একটা ক্যাম্পে ছিলেন বলে আমি জানি।

প্র: ক্যাম্প গুলোর অবস্থানে কেমন ছিলো ?
উ: ক্যাম্প গুলো ভারত সরকার চালাতো। ইসলামপুরের তখনকার যে এ.ডি.সি. ছিলেন, তার নামটা এখন ভুলে গেছি। এরা ক্যাম্পের জন্য প্রচুর কাজ করেছেন। তবে এটা ঠিক, প্রয়োজনের তুলনায় ভারত যেটা দিয়েছিলো সেটা খুব বেশি ছিলো না। ইসলামপুরের যে এ.ডি.সি. রিলিফের চার্জে ছিলেন তাকে আমি একদিন বললাম, আপনারা যে সব কম্বল বরাদ্দ করেছেন তা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত। আমি এই কথা বলাতে এডিসি-র সাঙ্গপাঙ্গ যারা ছিলো তারা আমার উপর খুবই অসন্তুষ্ট হলো। আমরা তো শরণার্থী। আমাদের মান অপমান বলে তখন কিছু নেই। ওরা আমার ওপর একটু উম্মা প্রকাশ করলেন এই কারণে যে, এতো দেয়া হচ্ছে তারপরও আমরা সমালোচনা করছি। কিন্তুযতোই দেয়া হোক, লোক তো আমাদের অনেক। যেখানে লক্ষ লক্ষ লোক সেখানে এক হাজার বা দুই হাজার কম্বলে কি হয় ? খুব কষ্ট করেই আমরা ছিলাম।

প্র: স্বাস্থ্য সেবা সেখানে কেমন ছিলো ?
উ: স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থানে আমাদের এলাকার ক্যাম্প গুলোতে খুব একটা খারাপ ছিলো না। খারাপ থাকলে তো মহামারী জাতীয় কিছু হতে পারতো। কিন্তু এ সব ক্যাম্প গুলোতে তেমন কিছু হয়নি। ছোট-খাটো অসুখ বিসুখ ছাড়া তেমন কিছু হয়নি। ডাক্তার, ওষুধ তারা রেখেছিলেন। প্রতিটি ক্যাম্পের সাথে একটা অস্থায়ী হস্‌পিটাল ছিলো। তারা পর্যাপ্ত ওষুধ-পত্র দিয়েছিলো। প্রয়োজনের তুলনায় কম হলেও একেবারে কম নয়।

প্র: বিভিন্ন সময় ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ করতে হয়েছে, কাজও করতে হয়েছে। এ সব ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক কেমন ছিলো ?
উ: প্রথম দিকে আমাদের সঙ্গে ভারতের স্থানীয় জনগণ ও নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সম্পর্ক এতই মধুর ছিলো যে, আমরা বাংলাদেশ থেকে যে সমস্যা লোক সেখানে গিয়েছিলাম- তাদেরকে ট্রেনে, বাসে কোনো টিকিট কাটতে হতো না। ‘জয় বাংলা’ থেকে এসেছি বললেই ছেড়ে দিতো। যেখানেই আমরা গেছি,বিশেষ করে ব্যক্তিগতভাবে আমি, ফজলুল করিম সাহেব এবং আমাদের সাথে অন্য যারা ছিলেন তারা ভারতীয়দের কাছ থেকে যে আতিথেয়তা, ভালোবাসা, সম্মান পেয়েছেন তা তুলনাহীন। কিন্তু শেষের দিকে লক্ষ্য করলাম এই সম্পর্কটা যেন কমে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের মনের মধ্যে হয়তো একটা ধারণা সৃষ্টি হতে লাগলো যে, আমরা এতোগুলো লোক হয়তো আর দেশে ফিরে যেতে পারবো না। আমরা তাদের উপর বোঝা হয়ে থাকবো। এ রকম একটা ভাব পরবর্তীকালে আমি তাদের অনেকের কাছে থেকেই শুনেছি। কিন্তু ইতোমধ্যেই তো দেশ স্বাধীন হয়ে গেলো। যুদ্ধটা ঠিক সময় মতো শেষ হওয়ায় আমাদের খুব একটা অসুবিধা হয়নি।

প্র: ভারত সরকার বিশেষত: ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে আপনাদের সম্পর্ক কেমন ছিলো ?
উ: সত্যি কথা বলতে কি আমরা কিছু আর্মি অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলাম কিংবা তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলো মূলত: আমাদের দেশের রাস্তাঘাট সম্পর্কে জানার জন্যে। আমাকে এবং ফজলুল করিম সাহেবকে অনেক আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো বাংলাদেশের রাস্তাঘাট সম্বন্ধে জানার জন্য। তারা আমাদের পরামর্শ নিয়েছেন বা রাস্তা ঘাটের, এলাকার ম্যাপ করিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া এ.ডি.সি. একজন চার্জে ছিলেন। তাঁর সাথে জিনিসপত্র লেন-দেন ছাড়া প্রশাসনিক অন্য কোনো কর্মকর্তা বা লোকজনের সাথে আমাদের তেমন যোগাযোগ ছিলো না। এ সময় আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক খুবই ভালো ছিলো। আমাদের ২/১ জন ভুল করে গ্রেফতার হয়েছিলো। আমরা তাদের জামিনের জন্য যখন কোর্ট কাচারিতে দৌঁড় ঝাপ করেছি। তখনও সবার কাছ থেকেই সহযোগিতা পেয়েছি।

প্র: তারা গ্রেফতার হয়েছিলো কেন ?
উ: আমাদের এলাকার ভাসানী ন্যাপের জিয়াউল হক নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। তিনি অনেকদিন ভারতের জেলখানায় ছিলেন। তাঁকে আমরা অনেক কষ্টে পরবর্তীকালে রিলিজ করেছিলাম। এই রিলিজের ব্যাপারে আমি, ফজলুল করিম সাহেবসহ আরো অনেকেই মুজিব নগরে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তাকে রিলিজ করা হয় শেষপর্যন্ত সবার সহযোগিতায়। সিরাজুল ইসলাম নামে আর একজন সাউথ ইন্ডিয়াতে ধরা পড়লো। তাকে সেখান থেকে রিলিজ করা হলো। এ সব ব্যাপারে একটু যোগাযোগ হয়েছিলো সরকারি লোকজনের সঙ্গে। তাদের কেন গ্রেফতার হয়েছিলো-তা বলা মুস্কিল।

প্র: ভারতে যাওয়ার পর আপনার মূল কাজটা কি ছিলো ?
উ: আমার মূল কাজটা ছিলো সমন্বয় সাধন করা, মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করা, রিলিফ ক্যাম্প গুলোতে নিয়মিত যাওয়া এবং সেখানে কার কি অসুবিধা হচ্ছে, কার কি নেই- এ সব খোঁজ খবর নেয়া। কালিয়াগঞ্জের কাছে তরঙ্গপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক ট্রেনিং দেয়া হতো। সেখানে আমাকে ফজলুল করিম সাহেব মাঝে মধ্যেই পাঠাতেন খবর নেয়ার জন্যে। মনে হয় আমি তখন ইয়াং ছিলাম বলে সমন্বয় সাধনের কাজটি আমাকে দেয়া হয়। নয় মাস আমি আমার পরিবারের সঙ্গে কোনো দিনই থাকতে পারিনি। স্বত:স্ফূর্তভাবে সার্বক্ষণিক কাজই করেছি। আমি এই নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের কাজের সঙ্গে বিশেষত: মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহের কাজে, রিলিফ ক্যাম্পে জনগণের দুঃখ দুর্দশা লাঘবে সার্বক্ষণিক কাজ করেছি। ভারত- বাংলাদেশ সরকারের কোনো কোনো কাজের ক্ষেত্রেও সমন্বয় সাধন করেছি। আর আমি থাকতাম ইসলামপুর বেইস করে, এদিকে জলপাইগুড়ি আর ওদিকে তরঙ্গপুর।
চলবে...

মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর, ২০০৮

রঙিলা দুনিয়ার ঢঙিলা মানুষরে তুই

1 টি মন্তব্য :
১.
ঘটকালীর সুযোগ না পেলেও মাঝে সাজে গোয়েন্দাগীরি করতে হয়। তেমন বিশাল কিছু না; অমুক ছেলের খোজ, তমুক মেয়ে কি রকম এই সব আর কি। জিনিসটা ভালো না লাগলেও অনেক সময় এক রকম বাধ্য হয়েই করতে হয়। ঘটনা বেশ কবছর আগের। পাশের এক বড় শহর থেকে লতায় পাতায় এক বড় ভাই উনার বোনের জন্য হবু জামাই খুঁজতে খুঁজতে কিভাবে জানি বের করলেন হবু জামাই আর আমি একই শহরের বাসিন্দা। তো যাই হোক, উনি ছেলের পাত্তা লাগাতে বল্লেন, আমিও লাগালাম।
উনি ফোন করে বলেন " ছেলে কি রকম ? "
আমি বলি " ছেলে ভালোই তবে হালকা পাতলা পানাভ্যাস আছে।"
"চলবো না"
"ক্যানে বাহে ?"
"মদ খাওয়া ছেলে চলবো না, এইটাই ফাইনাল"
আমি বলি " হ "
" হ মানে ?"
"হ, মাইনে হইলো আপনে খাইলে সমস্যা নাই, আর ওই পোলায় খাইলে সমস্যা ? "
" কি বলো ? "
" ছেলে এক অজি মাইয়ার লগে লিভ টুগেদারও করে, যেমনটা আপনে করতেন শম্পা ভাবীরে বিয়া করার আগে ! "
২.
পানাভ্যাসের কথা যখন আসলই তখন আরেকটা গল্প বলি। বৈদেশে আসার পর টের পাইলাম অনেকের কাছেই ড্রিংক করা স্মার্টনেসের লক্ষন। আমার অভ্যাস নাই বল্লে অনেকেই এমন ভাবে তাকায় যেনো আমি এই মাত্র বড়িশালের লন্চে সদরঘাটে নেমে ডাক পারছি " ও মনু "।

একবার এক আড্ডায় ' টাকিলার' কথা শুনে আমিতো ভেবেছিলাম যাদের টাক আছে তারাই টাকিলা খেতে পারে। পরে অবশ্য বারে কিছুদিন কাজ করায় এসব ধন্ধ কেটে গিয়েছিলো। সব ককটেল পার্টিতেই শক্ত পানীয়ের সাথে নরম পানীয়ও থাকে। কেউ কাউরে যাইত্তা ধরে না যে খাইতেই হইবো, তোমার ইচ্ছা হলে খাইবা - নাইলে নাই, নো চাপাচাপী ( এই জিনিসটা অনেক দেশী ভাই করে, চাপাচাপী, না খাইলে বলে ' হালায় ক্ষ্যাত' )।

৩.
এবারেরটা অজএইড স্কলারশীপে আসা এক ভদ্রলোককে নিয়ে। ভদ্রলোক দেশের কোনো এক সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নামটা না হয় নাই বল্লাম। ভদ্রলোক আর আমি একই কলেজ থেকে পাশ করা বলে পরিচয় আগে থেকেই ছিলো। দু বছরের শিক্ষা ছুটি শেষ করে উনি এখানে এসেছিলেন। তো পড়া শেষ করে যথাসময়ে উনি দেশে ফেরতও গিয়েছিলেন। শুনেছি দেশে গিয়ে নাকি উনি বড় গলায় বলতেন " দেশের ছেলে দেশে ফেরত এসেছি। ওখানে বড় চাকুরির অফার পেলেও সেটা গ্রহন না করে অল্প টাকার মাস্টারীতে ফেরত এসেছি" । অবশ্য সেটা গোপন করতেন যে অজএইড স্কলারশীপে এখানে আসলে কেউ পিআর এর এপ্লাই করতে পারেন না, দেশে ফেরত যেতে বাধ্য। ১ বছর হলো উনি আবারো এসেছেন, এবার পিএইচডি করতে। মাঝে সাজে কথা হয়। কথার মাঝে টের পাই, উনি এবার থেকে যাবেন।
"দেশের অবস্থা খারাপ, ছেলে- মেয়ের স্কুলের ঠিক নাই, চাকুরীতে বেতন কম " ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি উনাকে বল্লাম " বস, এইবার কি সব পাক্কা ! ফেরত তাইলে যাইবেন না ? "

৪.
পার্থের এক সুশীলের সাথে হালকা পাতলা বাতচিত হয়। সুশীল সাহেব আবার নাস্তিক, যদিও নিজেকে মুক্তমনা হিসেবে পরিচয় দেন। তবে উনার একটা ভালো দিক হলো, উনি উনার নাস্তিকতা আমার উপর চাপায় দেন না। আমিও তেমন গা করি না, উনি নাস্তিক - কি আস্তিক। যার যার বিশ্বাষ তার তার কাছে। সেই দিন ফেসবুকে উনার বিয়ের ছবি দেখে আমি পুরা টাস্কি খেয়ে গেলাম।
ফোন দিয়া বল্লাম " বড় ভাই, টুপি মাথায় মোনাজাত ধরা আবুলটা কি আপনে ? "
" হ, বিয়ার দিনে সবার চাপাচাপিতে পড়তে হইছিলো "
আমি কই " মোনাজাতও দেখি করছিলেন ?"
" হ"
" তাইলে আপনের নাস্তিকতা সেই দিন কই আছিলো বস ? "

৫.
বেশ কমাস আগে সিডনীর এক বাঙালী বাসায় গিয়েছিলাম। সাথে বউ ছিলো। জাতি সত্বায় বাঙালী হলেও উনারা অবশ্য নিজেদের বাঙালী বলেন কি না সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে আমার। উনাদের কাছে বাঙালী পরিচয়ের চাইতে নাকি মুসলমান পরিচয়টাই বড় !! আজিব চিন্তা-চেতনা। যাই হোক গল্পে ফেরত আসি। আরো কিছু অতিথী অবশ্য সেখানে ছিলো। আংকেল আমাকে আর আমার বউকে ডাইনিং এ নিয়ে গেলেন তখন ভেবেছিলাম উনার বাসার অন্যদের সাথে অন্তত পরিচিত হওয়া যাবে। খাওয়া হলো- দাওয়া হলো; তবে বাসার অন্য কারো সাথে দেখা হলো না। আমার সামনে আসলে নাকি পর্দা রাখা যাবে না। অথচ আংকেল ঠিকই আমার বউয়ের সামনে এসেছেন, যেখানে আমার বউয়ের পর্দার কথা উনার চিন্তায়ও আসেনি। কি অদ্ভুত বৈপিরত্য। পর্দা শুধু নিজের পরিবারের জন্য ?

পাত্র-পাত্রির নাম গোপন করা হলো আমার পিঠ রক্ষার জন্য। তবে ঘটনটাগুলো সত্য- লেখার স্বার্থে কিছুটা পরিবর্তিত।

সোমবার, ১ ডিসেম্বর, ২০০৮

মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও ১.৩ ( একটি কথ্য ইতিহাস- বলরাম গুহঠাকুরতা)

কোন মন্তব্য নেই :
প্র: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানিরা গোটা দেশেই নির্যাতন ক্যাম্প করেছিলো। আপনাদের ঠাকুরগাঁওয়ের কোথায় কোথায় এ জাতীয় নির্যাতন ক্যাম্প ছিলো ?
উ: তাদের মূল নির্যাতন ক্যাম্প ছিলো ঠাকুরগাঁও ওয়াপদা রেস্ট হাউসে। সেখানে তারা বাঘের খাঁচা করেছিলো। সেই বাঘের খাঁচায় জীবিত মানুষকে ঢুকিয়ে দেয়া হতো। এই বাঘের খাঁচা সম্পর্কে একটা ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে। পাক বাহিনী সালাহউদ্দীন নামে এক মুক্তিযোদ্ধাকে সেই বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলো। এই ঘটনাটা আমি লোকমুখে শুনেছি। সালাহউদ্দীন ১৯৭১ সালে দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর ছাত্র ছিলো। পাক সেনারা ১৩ এপ্রিল দিনাজপুর এবং ১৪/১৫ এপ্রিল ঠাকুরগাঁও দখল করে ১৮ এপ্রিল বীরগঞ্জে মর্মান্তিক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এই ঘটনা সালাহউদ্দীনের জীবন বদলে দেয়। এই ঘটনার পর এক রাতে সে ভারত চলে যায় এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে হয়ে ওঠে লড়াকু মুক্তিসেনা।
ঠোকরাবাড়ি, বালিয়াডাঙ্গা, ঠগবস্তি, বীরগঞ্জ, মেহেরপুর রণাঙ্গনে সে ছিলো অকুতোভয় এক যোদ্ধা। নভেম্বর মাসে সালাহউদ্দীন অবস্থান করছিলো জাবরহাট ক্যাম্পে। এখানে থাকার সময় সে সংবাদ পেলো যে, পাক সেনারা তার বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে। এই খবর জেনে সহযোদ্ধারা তাকে সমবেদনা জানায়। কিন্তু বাবার সংবাদ জেনে সে একটু বিচলিত হয়ে পড়ে। সালাহউদ্দীন ঐ দিনই গভীর রাতে একজন সহযোদ্ধাকে জানিয়ে রওনা দেয় বাড়ির উদ্দেশে। কথা ছিলো পরদিনই সে আবার ফিরে আসবে। পায়ে হেঁটে ভোর নাগাদ সে পৌঁছে যায় বাড়িতে। কয়েক ডাকেই দরজা খুলে দিলো তার মা। ঘরে ঢুকে দেখে বাবা দিব্যি রয়েছে। বাড়ি ফিরে জানতে পারে ঐ খবরটা সঠিক ছিলো না। সম্ভবতঃ পাকিস্তানিদের সহযোগী কেউ কারো মাধ্যমে তাকে এই খবর দিয়ে তার জন্য ফাঁদ তৈরি করেছিলো। এদিকে দ্রুত সালাহউদ্দীনের ঘরে ফেরার খবর চলে যায় ঠাকুরগাঁওয়ের পাক সেনাদের দপ্তরে। সম্ভবতঃ ১১ নভেম্বর সকাল ১০টার দিকে পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দীনদের বাড়িটা ঘিরে ফেললো। তারা সালাহউদ্দীনকে বন্দি করে নিয়ে গেলো তাদের ঠাকুরগাঁওয়ের সদর দপ্তরে। সেখানে প্রচন্ড নির্যাতন চলে তার ওপর। মুক্তিবাহিনী এবং তাদের আশ্রয়দাতাদের বিষয়ে সালাহউদ্দীনের কাছে তথ্য চায় পাক সেনারা। বুটের লাথি, চাবুকের চাবকানি, কোনোকিছুতেই নতি স্বীকার করেনি সে। মৃত্যুর ভয় দেখালে সালাহউদ্দীন দৃঢ়ভাবে নাকি জানিয়ে দিয়েছিলো আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। তার হাতের আঙুলগুলো পাক সেনারা জাতি (টিন কাটার বড় লোহার কাঁচি) দিয়ে কেটে ফেলে, হাতেপায়ে গজাল পেরেক ঠুকে দেয়। চোখের মণিতে বড়শি আটকিয়ে সুতো বেঁধে টানাটানি করে নিষ্ঠুরভাবে। তারপরও সালাহউদ্দীন ছিলো অবিচল, পাকিস্তানিদের কাছে কিছুই স্বীকার করেনি সে। পাকিস্তানিমেজর মাহমুদ হাসান বেগ নাকি মুক্তিযোদ্ধা সালাউদ্দীনের দৃঢ়তায় বিস্মিত এবং স্তম্ভিত হয়েছিলো ! সালাহউদ্দীনের মতো এতো দৃঢ়তা, এতো দেশপ্রেম এর আগে আর কারো মধ্যে সে কখনও দেখেনি। কোনো অবস্থানেতেই কোনো তথ্য না দেওয়ায় পরদিন ১২ নভেম্বর সকালে পাকিস্তানি মেজর জামানের নেতৃত্বে কয়েকজন পাক সেনা বের করে নিয়ে আসে ক্ষতবিক্ষত সালাহউদ্দীনকে। তার দুই হাত পিঠমোড়া করে বাঁধা। জিহ্বাতেও চালানো হয়েছে চাকু। ঐ অবস্থানেয় তাকে ঐ বাঘের খাঁচার সামনে আনা হয়। সেখানে তাকে আবার নাকি বলা হলো, হয় তথ্য দাও, নইলে বাঘের খাঁচায় মৃত্যু। তারপরও সে বাঘের খাঁচাকেই কবুল করে নিয়েছে। তার পরের দৃশ্যের কোনো বর্ণনা হয় না।
পিঠমোড়া করে হাত বাঁধা অবস্থানেয় সালাহউদ্দীনকে ফেলে দেয়া হয় বাঘের খাঁচায়। বীর মুক্তিযোদ্ধা তাকিয়ে ছিলো বাঘের দিকে। চারিদিকের রুদ্ধশ্বাস নিস্তব্ধতাকে ভেঙে বাঘ দু’টো ঝাঁপিয়ে পড়ে সালাহউদ্দীনের ওপর। নির্ভিক মুক্তিযোদ্ধার ক্ষীণ চিৎকারে প্রকৃতি কেঁপে উঠলেও পাকিস্তানিসেনা এবং তাদের দোসরা এটা দেখে উল্লসিত হয়েছিলো। এক সময় সব শেষ হয়ে গেলো। পাক বাহিনী যে কতটা নিষ্ঠুর ছিলো তা এই একটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায়।
তারপর ইপিআর ক্যাম্পেও তাদের একটা নির্যাতন সেল ছিলো। এ ছাড়া গ্রামে-গঞ্জে যেখানে যেখানে তারা বাংকার বা ঘাঁটি করতো- সেখানেই মানুষের ওপর বিশেষ করে মেয়েদের ওপর তারা নির্যাতন চালাতো। রাতে তারা কোথাও থাকতো না। সন্ধ্যার মধ্যে সব চলে এসে বাংকারে থাকতো এবং মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করতো। আমরা বহু বাংকার দেখেছি যেখানে মেয়েদের শাড়ি, চুড়ি, ব্লাউজ ছিলো অসংখ্য। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। আটোয়ারিতে এক পাগলীর সাথে আমাদের দেখা হয়েছিলো। পাকিস্তানিদের বার বার নির্যাতনের ফলে এক পর্যায়ে সে পাগল হয়ে যায়। স্বাধীনতার পরও সে বেঁচে ছিলো এবং বলতো, ‘আমাকে তোরা ব্যবহার করবি নি ? খাবার দিবি নি’ ? সে ছিলো অর্ধ উলঙ্গ অবস্থানেয়। মাঝে মাঝেই সে আমাদের কাছে আসতো এবং পাকিস্তানিদের খোঁজ করতো। পাগলী বলতো, আমাকে খাবারও দেবে আবার আমার সঙ্গে খারাপ কাজও করবে।
প্র: মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য ছিলো কি ? এ সম্পর্কে আপনি কি জানেন ?
উ: আমি জানি, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কোনো ছেলেকে ভর্তির ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেছিলো। এ জন্য পাল্টা একটা ইয়ুথ ক্যাম্প গঠিত হয়েছিলো। ক্যাম্পটা পরিচালনা করতেন মোজাফফর আহমদ এবং কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃবৃন্দ। ক্যাম্প টা ছিলো গঙ্গারামপুরে। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যান্য দলের ছেলেদের এখানে রিক্রুট করা হতো। এরপর তাদেরকে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হতো। ভারত সরকারের সাথে বাম নেতারা যোগাযোগ করেই আলাদাভাবে ক্যাম্প তৈরি করেছিলো। এ সব ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে গেছে এবং যুদ্ধ করেছে।
প্র: ১৯৭১ সালে ঠাকুরগাঁও-য়ে রাজাকার বাহিনীর ভূমিকা কি ছিলো ?
উ: এ সময় পাকিস্তানি আর্মি রাজাকার হিসাবে অনেককে রিক্রুট করেছিলো। আমাদের এলাকাতেও করেছিলো। আমি এই মুহূর্তে তাদের নাম বলতে পারবো না। তবে তাদের অনেকেই জামাতে ইসলাম এবং মুসলিম লীগের সমর্থক বা কর্মী ছিলো। এ ছাড়াও অনেককে তারা রিক্রুট করেছিলো। আমি তাদেরকে চিনি, কিন্তুএই মুহূর্তে তাদেরও নাম বলবো না। তারা মূলত: লুণ্ঠন, মেয়েদের উপর অত্যাচার এবং পাকিস্তানি আর্মিদের সহযোগী হিসাবে তাদের বিভিন্ন ধরনের রসদ যোগান দিতো।
প্র: ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিসেনা কর্তৃপক্ষ শান্তি কমিটি গঠন করেছিলো। ঠাকুরগাঁও এলাকায় এ সব কমিটিতে কারা ছিলো এবং তাদের ভূমিকা কি ছিলো ?
উ: সে সময় ঠাকুরগাঁও পঞ্চগড়সহ পুরো এলাকায় মহকুমা, থানা এবং ইউনিয়নভিত্তিক শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন মূলত: মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলাম দলীয় সদস্যরা। তাদের নাম আমি জানি। তাদের কেউ কেউ মারা গেছেন, কেউ কেউ বেঁচে আছেন। ওনাদের নাম এখন আমি বলতে চাচ্ছি না।
প্র: স্বাধীনতার পর নিজ এলাকায় ফিরে এসে আপনি এলাকার অবস্থানে কেমন দেখলেন ?
উ: ৪ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও মুক্ত হয় এবং তারপরই আমরা চলে আসি। আমরা যা দেখেছি তাকে সম্পর্ন একটা ধ্বংসস্তুপ বলা যেতে পারে। আমাদের এলাকায় পাকা বাড়ি তো খুব বেশি ছিলো না। ঘরের চাল পর্যন্ত তারা খুলে নিয়ে গিয়েছিলো। পাকা বাড়ি থেকে আসবাবপত্র, দরজা-জানালা সবকিছু তারা খুলে নিয়ে গিয়েছিলো। কারো কিছু ছিলো না। গরু, ছাগল, ভেড়া সবই তারা লুট করে নিয়ে গিয়েছিলো। আমাদের বাড়ির আসবাবপত্র বলতে কিছুই ছিলো না। দেশ স্বাধীনের পর লুট করা অনেক মালামাল আমরা পাকিস্তানি সহযোগীদের বাড়ি থেকে বা বিভিন্ন পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করেছিলাম। উদ্ধার করা মালামাল ঠাকুরগাঁও বি. ডি. হলে রাখা হয়েছিলো। যারা তাদের জিনিসপত্র সনাক্ত করতে পেরেছিলো তারা তাদের জিনিষপত্র নিয়ে গিয়েছিলো। বাকিগুলো আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গ কাকে কি দিয়েছেন আমরা তা জানি না। এই ডিস্ট্রিবিউশনের ব্যাপার থেকেই আমাদের ভূমিকা আস্তে আস্তে কমে গেলো। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে, স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত আমরা সবাই প্রতিটি কর্মকান্ডে এক সাথে ছিলাম। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পর রাজনীতি যখন এখানে প্রতিষ্ঠা লাভ করলো, আবার যখন নির্বাচন হলো তখন আমরা আস্তে আস্তে বিভিন্ন কর্মকান্ড থেকে সরে গেলাম বা সরে যেতে বাধ্য হলাম বলা যায়।
       
                         

বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর, ২০০৮

মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও, পর্ব ১.২ ( একটি কথ্য ইতিহাস- বলরাম গুহঠাকুরতা)

কোন মন্তব্য নেই :
প্র: এই কনফারেন্সটা কোথায় হলো ?
উ: এটা হলো ডি. এন. ঘোষের হেনলী কেবলস্‌-এর যে ফ্যাক্টরি, তারই হলরুমে। প্রেস কনফারেন্সের শুরুতেই আমি বললাম, আমি জানি না আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ কি ? যদি আমাদের এই সংগ্রাম ফেল করে তাহলে আমরা দেশে ফিরে যাবো কেমন করে ? আমরা যে এ দেশে আসলাম- without any valid documents, আমরা তো তাহলে দেশের ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে চিমিত হবো। আমাদেরকে আইনের আমলে আসতে হবে। শুধু তাই না, আমরা যদি ফিরে নাও যাই, আমাদের পরিবারের যারা বাংলাদেশে আছে- তাদেরকে পাকিস্তানিআর্মিরা মেরে ফেলবে। কনফারেন্স সূত্রে আমাদের নামধাম প্রকাশ করলে আমাদের বা আমাদের পরিবারের পরিণতি হবে ভয়াবহ।
প্র: প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিকদের কাছে আপনি কি কি বিষয় তুলে ধরলেন ?
উ: পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের উপর যে অত্যাচার, অবিচার, অনিয়ম ও শোষণ চালাচ্ছিলো সেই চিত্রই তুলে ধরলাম ধারাবাহিকভাবে। আমাদের দেশের ৬ দফা এবং ১১ দফায় যে সব দাবি ছিলো সেগুলোও তাদের কাছে তুলে ধরলাম। আমি আরো বললাম, এখন আমরা স্বাধীনতার দিকে যাচ্ছি, আমরা যুদ্ধের দিকে যাচ্ছি এবং এই যুদ্ধটা প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানিসেনা শাসক ২৫ মার্চ আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানিআর্মি নিরপরাধ ও নিরস্ত্র অসংখ্য মানুষকে হত্যা করছে। কত লোককে হত্যা করেছে- আমরা এখনও তা জানি না। আমরা পূর্ব পাকিস্তানে এখন খুব অসহায় অবস্থানেয় আছি। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ জানি না। এই অবস্থানেয় আমরা আপনাদের কাছে এসেছিলাম কিছু হেভি অস্ত্র শস্ত্র নেবার জন্যে। কিন্তুআমরা যেটা বুঝলাম তাহলো আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ছাড়া এটা সম্ভব না। তারা এখানে এসে পৌঁছেছেন কিনা সেটাও আমরা জানি না। যাহোক, আমরা তাঁদের নানা প্রশ্নের জবাব দিলাম। প্রেস কনফারেন্স শেষ হবার পর ঠিক হলো যে, আমরা আমাদের দেশে ফিরে যাবো এবং আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ভারত সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন। ডি.এন.ঘোষ বললেন, অবশ্যই আমাদের সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের ঘটনার উপর দৃষ্টি রাখছেন। এরপর আমরা কলকাতা থেকে ঠাকুরগাঁওয়ে ফিরে আসলাম। ফিরে আসার পথে যখন আমরা ইসলামপুরে, তখন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী কর্পূরী ঠাকুরকে সেখানে দেখলাম। আমরা তাঁর কাছে গেলাম এবং তাঁকে আমাদের ঠাকুরগাঁওয়ের কথা জানালাম। কর্পূরী ঠাকুর অতো কিছু চিন্তা ভাবনার লোক ছিলেন বলে মনে হলো না। তিনি বলে দিলেন, Don’t worry, আমি দিল্লী যাচ্ছি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তোমাদের বিষয় নিয়ে আলাপ করবো এবং তোমাদের জন্য হেভি অস্ত্র শস্ত্রের ব্যবস্থা করবো। এ কথা বলে তিনি চলে গেলেন। এরপর আর কারো সাথে আমাদের আর যোগাযোগ হয়নি। আমরা ঠাকুরগাঁও ফিরে এলাম।



আমরা ঠাকুগাঁওয়েও পৌঁছে দেখলাম শহর প্রায় জনশূন্য। অবশ্য আমাদের কন্ট্রোল রুমটা আছে। কিন্তু চম্পাতলীতে আমাদের যে ডিফেন্সটা ছিলো সেটা ভেঙে গেছে এবং যে কোনো দিন পাকিস্তানিরা আমাদের ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করতে পারে। এই অবস্থানেয় আমি ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ঠাকুরগাঁও ছিলাম। ১৫ এপ্রিল সকাল থেকে পাকিস্তানিরা ঠাকুরগাঁওয়ে বোমাবর্ষণ শুরু করে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ২/৪ জন লোক নিয়ে সেই রাতেই ঠাকুরগাঁও ত্যাগ করলাম। আমরা মরাগতি দিয়ে প্রথমে ভারতের ইসলামপুর প্রবেশ করলাম। আমি খোঁজ খবর নিতে থাকলাম যে কে কোথায় আছে। এম. পি. এ. ফজলুল করিম সাহেব সেখানে আছেন জানতে পারলাম। তাঁর একটা গাড়ি ছিলো সেটা তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন। আমরাও বেশ কয়েকটা মটর সাইকেল নিয়ে গিয়েছিলাম। পরবর্তীতে এ সব যানবাহন আমাদের খুবই কাজে লেগেছিলো।


প্র: ১৪-১৫ এপ্রিল ঠাকুরগাঁও পতনের পূর্ব পর্যন্ত আপনারা কি ইন্ডিয়া থেকে কোনো অস্ত্র শস্ত্র পেয়েছিলেন ?
উ: আমার জানামতে কিছুই পাওয়া যায়নি। আমি সে সময় অবিবাহিত ছিলাম এবং সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করেছি, স্বাধীনতা সংগ্রামে ছিলাম সার্বক্ষণিক। এ সময় ভারতের কিছু জনগণ এসেছিলো আমাদের পরিস্হিতি দেখবার জন্যে। তাদের মধ্যে স্থানেনীয় রাজনৈতিক নেতা কর্মীসহ প্রভাবশালী লোকও ছিলো। বি.এস.এফ.-এর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। কিন্তুতারা কোনো অস্ত্র আমাদের দেয়নি, দেওয়া সম্ভবও ছিলো না। ঠাকুরগাঁও শহরে আমাদের যোদ্ধাদের কাছে যে সাধারণ রাইফেল ছিলো কেবল সেটা দিয়েই যুদ্ধ করা হয়েছে। পরবর্তীকালে এ সব রাইফেল অনেক বাজে লোকের হাতেও পড়েছে।


প্র: ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর আপনার ভূমিকা কি ছিলো ?
উ: কয়েকদিন পরই আমরা ভারতীয় খবরের কাগজের মাধ্যমে জানতে পারলাম যে, মুজিব নগরে বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়েছে এবং মন্ত্রি পরিষদে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবর্গ রয়েছেন। ফজলুল করিম সাহেবসহ আমরা একদিন কলকাতা গেলাম মন্ত্রি পরিষদ সদস্যদের সঙ্গে দেখা করার জন্য। আমরা তাদের সঙ্গে দেখা করলাম। বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে কিছুদিনের মধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় ইয়ুথ ক্যাম্প তৈরি শুরু হলো। আমাদের ঠাকুরগাঁওয়ের অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার এস. আর. মীর্জা জুন মাসের শেষথেকে ইয়ুথ ক্যাম্পের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়লেন। বাংলাদেশ সরকার প্রথমে তাঁকে পরিচালক ও পরে মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দিয়েছিলো। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় যে সব রিলিফ ক্যাম্প গড়ে উঠলো সেই সব ক্যাম্প থেকে আমরা মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করতে শুরু করলাম। ভারতে যাওয়ার পর থেকেই আমরা মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহের কাজ অব্যাহত রেখেছিলাম। তরঙ্গপুর থেকে জলপাইগুড়ি পর্যন্ত এই পুরো এলাকা থেকে আমি, ফজলুল করিম সাহেব ও অন্যরা মিলে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করেছি এবং ট্রেনিংয়ে পাঠিয়েছি। ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখে এই এলাকায় পঞ্চগড় প্রথম মুক্ত হয়। আমরা ইন্ডিয়ান আর্মির সঙ্গে পঞ্চগড় প্রবেশ করলাম। ঐ এলাকার ইন্ডিয়ান আর্মির কমান্ডিং অফিসার ছিলেন কর্নেল এলাহাবাদ, তিনি মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন। ইন্ডিয়ান আর্মির পিছনে পিছনে আমরা ফজলুল করিম সাহেবের ব্যক্তিগত জীপে করে পঞ্চগড় প্রবেশ করি। পঞ্চগড়ে ইন্ডিয়ান আর্মির সঙ্গে কথাবার্তা বলার এক পর্যায়ে আমরা কর্নেল সাহেবকে আমি বললাম যে, আমরা আশা করছি আগামীকাল ঠাকুরগাঁও পৌঁছাবো। তখন তিনি বললেন,Not it will be day after tomorrow.অর্থাৎ ৪ ডিসেম্বর। ৪ ডিসেম্বর আমরা ঠাকুরগাঁও প্রবেশ করলাম। ঠাকুরগাঁও আসার পর মিত্র বাহিনীর কর্নেল এলাহাবাদ ও অন্য অফিসাররা আমাদের বললো যে, আপনারা পাকা রাস্তা ছাড়া কোনো কাঁচা রাস্তায় নামবেন না। কারণ পাকিস্তানআর্মি হয়তো মাইন পুঁতে রেখেছে। ঐ অবস্থানেয় আমরা ঠাকুরগাঁও পৌঁছলাম। তারপরও ঠাকুরগাঁও থেকে ইসলামপুর যাওয়া আসা করছি। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। আমাদের সরকার পুনর্গঠিত হলো। শরনার্থীরা ফিরে এলো। কিছুদিন পর বর্ডারে কড়াকড়ি আরোপ হলো। আমাদের ভারতে যাতায়াত নিয়ন্ত্রিত হলো। আস্তে আস্তে আমাদের মূল্য কমতে লাগলো। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবেও আমাদের মূল্য কমতে লাগলো। কমতে কমতে এখন আর আমরা কোনো কর্মকান্ডের সঙ্গেই যুক্ত নই।


প্র: পাকিস্তান আর্মি ঠাকুরগাঁও আক্রমণ শুরু করলো কবে থেকে ?
উ: ১৪ এপ্রিল। ১৪-১৫ এপ্রিল তারা ঠাকুরগাঁও ঢুকে গেলো। পাকিস্তানিরা দূর থেকে গোলা নিক্ষেপ করেছে। কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিলো না। প্রতিরোধ হয়নি। আমাদের কোনো ডিফেন্স ছিলো না। আমাদের লাস্ট ডিফেন্স ছিলো চম্পাতলী। প্রকৃত অর্থে চম্পাতলীর পর আর কোনো ডিফেন্স ছিলো না।


প্র: ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ঠাকুরগাঁওয়ের নেতৃত্ব কাদের হাতে ছিলো বা কারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ?
উ: সংগ্রাম কমিটি। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা মিলে যে সংগ্রাম কমিটি করেছিলেন- সেই কমিটির নেতৃত্বেই কর্মকান্ড চলেছে, একক কোনো নেতৃত্ব ছিলো না।


প্র: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আপনার পরিবারের কেউ শহীদ হয়েছে কি ?
উ: না,আমরা তো আমাদের পরিবারের লোকজনকে ২৬ মার্চেই ঠাকুরগাঁও শহর থেকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তারা ভারত সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থান করছিলো। ১৫ এপ্রিল ঠাকুরগাঁও ফল করার পর তারা ভারতে চলে যায় এবং শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। ফলে, আমাদের পরিবারের কেউ শহীদ হয়নি।


প্র: ১৫ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঠাকুরগাঁও দখল করার পর থেকে পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের মিত্র অবাঙালিরা ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছিলো- এই গণহত্যা সম্পর্কে আপনি কি জানেন ?
উ: সবচেয়ে বড় গণহত্যা হয়েছিলো ঠাররগাঁও শহরের উত্তর পূর্ব কোণে বালিয়া ইউনিয়ন সংলগ্ন জাতিভাঙ্গা নামক স্থানে। স্থানীয় মানুষদের ছাড়াও অন্যান্য এলাকার নিরস্ত্র মানুষ যারা প্রাণে বাঁচার জন্য ঐ এলাকা দিয়ে ভারতে যাচ্ছিলো তাদের উপর রাজাকার বা ঐ ধরনের লোকজনেরা হামলা চালিয়ে সব কিছু লুটে নিয়ে পরে হত্যা করে। যারা এ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলো তাদের নাম ধাম জানি। কিন্তু আমি এই মুহূর্তে তাদের নাম বলতে চাই না নিরাপত্তার কারণে।
খুনীয়াদীঘি নামে রানীশংকৈলে একটা জায়গা আছে, সেখানেও অনেক লোককে হত্যা করা হয়। হত্যার পর লাশগুলোকে ঐ দীঘিতে ফেলে দেয়া হতো বলে ঐ দীঘির নাম খুনীয়াদীঘি হয়েছিলো। স্বাধীনতার পর পরই হাজার হাজার লাশ দেখেছি সেখানে। তারা প্রায় তিন থেকে চার হাজার লোককে এখানে হত্যা করেছিলো। ঠাকুরগাঁও শহরে ঢোকার আগে রামনাথের যে পুকুরটা আছে সেখানে মানুষ মারার জন্যে পাকিস্তানিরা একটা ফাঁদ মতো তৈরি করেছিলো। দু’টা ড্রাম একসাথে বেঁধে তার মধ্যে লোক চড়িয়ে দিয়ে উল্টো দিক থেকে দড়ি দিয়ে ড্রাম দু’টোকে টেনে পুকুরের মাঝখানে নিয়ে আসা হতো এবং তার পরই দূর থেকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হতো ঐ সব হতভাগ্য বাঙালিদের। এখানেও তারা অনেক লোককে হত্যা করে।


প্র: এ সম্পর্কে আরেকটু বিস্তারিত বলবেন কি ?
উ: ঠাকুরগাঁও শহরের উত্তর পশ্চিম কোণে রুহিয়া নামক স্থানে রামনাথ নামে একটা ঘাট আছে। সেখানে বড় একটা পুকুর আছে। সেই পুকুরে তারা দু’টা ড্রাম বেঁধে যাদেরকে হত্যা করবে তাদেরকে ঐ ড্রামের মধ্যে বসাতো এবং দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতো। এরপর ঐ ড্রাম দু’টোকে উল্টো দিক থেকে দড়ি দিয়ে টেনে পুকুরের মাঝখানে নিয়ে যাওয়া হতো এবং তার পরই পারে দাঁড়িয়ে থাকা রাজাকার বা পাক সেনা ঐ হতভাগ্যের কাউকে মাথায়, কাউকে বুকে গুলি করে হত্যা করতো। পাকিস্তানিরা দূরে দাঁড়িয়ে এই মৃত্যু দৃশ্য দেখতো আর উল্লাস প্রকাশ করতো। হত্যার পর তারা কাউকে কাউকে মাটি চাপা দিয়েছে আবার কাউকে দেয়নি। স্বাধীনতার পরপরই আমরা অসংখ্য কঙ্কাল দেখেছি খুনীয়াদীঘিতে এবং রামনাথ ঘাট এলাকায়। এ সব জায়গায় হত্যাযজ্ঞ চলেছে এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত।
যুদ্ধকালে আটোয়ারি থানার কিছু অংশে আমরা একবার গোপনে ঢুকেছিলাম পরিস্হিতি দেখবার জন্যে। সেখানে গিয়ে আমরা দেখি যে, পাকিস্তানিদের যে ক্যাম্প সেই ক্যাম্প থেকে কিছু লোকজন বাইরে যাচ্ছে আবার ক্যাম্পে আসছে। এ সব লোকের কাজ ছিলো মেয়ে মানুষ ধরে আনা, তাদের উপর অত্যাচার করা। আর যাদেরকে তারা মুক্তিযোদ্ধা বলে সন্দেহ করতো তাদের আত্মীয় স্বজনকে তারা হত্যা করতো। সোনা-রূপা, টাকা-পয়সা লুটপাট তো তারা করতোই। এরা পাকিস্তানিবাহিনীর সহযোগী বা রাজাকার ছিলো।
চলবে......

বুধবার, ১৯ নভেম্বর, ২০০৮

মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও, পর্ব ১.১ ( একটি কথ্য ইতিহাস- বলরাম গুহঠাকুরতা)

কোন মন্তব্য নেই :
বাংলার মুখ  মুক্তিযুদ্ধের কয়েকজন সংগঠক ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছিলো ২০০৩ সালে।
সাক্ষাতকারগুলো নিয়েছিলেন ড. সুকুমার বিশ্বাষ।
মুল সাক্ষাতকারটি এখানে পাবেন বলরাম গুহঠাকুরতা
উনাদের অনুমতিক্রমে সাক্ষাতকারগুলো পর্বাকারে ব্লগে পূনঃপ্রকাশ করছি।
সাক্ষাতকারগুলোর পূর্নসত্ব ও কৃতিত্ব বাংলার মুখের।
---------------------------------------------
নাম : বলরাম গুহঠাকুরতা
পিতা : সুরেশচন্দ্র গুহঠাকুরতা
পাড়া : আশ্রমপাড়া,
ডাক : ঠাকুরগাঁও টাউন
ইউনিয়ন : নিশ্চিন্তপুর,
থানা : ঠাকুরগাঁও
জেলা : ঠাকুরগাঁও( ১৯৭১ সালে দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত মহকুমা)
শিক্ষাগত যোগ্যতা : বি.এ.,এল.এল.বি.
১৯৭১ সালে বয়স : ৩৫
১৯৭১ সালে পেশা : আইনজীবী,
বর্তমান পেশা : আইনজীবী
--------------------------------------------
প্র: ১৯৭০ সালের নির্বাচন ও তার পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে আপনি কি জানেন ?
উ: ১৯৭০ সালে আমি ঠাকুরগাঁওয়ে আইন পেশার সাথে জড়িত ছিলাম এবং রাজনৈতিকভাবে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি)-এর একজন সক্রিয় সদস্য ছিলাম। আমি ন্যাপ-এর ঠাকুরগাঁও মহকুমার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলাম। স্বাধীনতার পর এটা মোজাফফর ন্যাপ নামে অভিহিত হয়। ১৯৭১ সালে ঠাকুরগাঁও দিনাজপুর জেলার একটি মহকুমা ছিলো। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু তারপরও যখন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলো না, তখন গোটা দেশের সঙ্গে ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষও আন্দোলনে নেমে পড়ে। আমরা বিভিন্ন জায়গায় সভা মিছিল করে তৎকালীন পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করতে লাগলাম। ঠাকুরগাঁও মহকুমায় প্রাদেশিক পরিষদের তিনটা সিট ছিলো। একটা সিট হচ্ছে ঠাকুরগাঁও সদর আর অন্য একটা থানার কিছুটা অংশ নিয়ে। এই সিটে বিজয়ী এম. পি. এ. ছিলেন আওয়ামী লীগের মোঃ ফজলুল করিম সাহেব। তাঁর সঙ্গে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছিলেন মুসলিম লীগের সম্ভবতঃ মীর্জা রুহুল আমিন। বর্তমান প্রতিমন্ত্রী ফখরুল ইসলাম আলমগীর-এর পিতা। আরেকটা সিট ছিলো বীরগঞ্জ আর রানীশংকৈল এলাকা নিয়ে। এখানে নির্বাচিত সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের সম্ভবত: আকরাম। আরেকটা সিট ছিলো। সেটাও ছিলো আওয়ামী লীগের। এখানকার নির্বাচিত সদস্যের নামটা এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। এ সময় মুসলিম লীগ থেকে মীর্জা রুহুল আমিন নির্বাচন করেছিলেন- যে কথা আমি বলেছি। আর অন্যান্য জায়গা থেকে এ দলের উল্লেখযোগ্যদের মধ্য থেকে কনটেস্ট করেছিলেন নূরুল হক চৌধুরী সাহেব। ন্যাপ ওয়ালি থেকে কনটেস্ট করেছিলেন এফ. এ. মোহাম্মদ হোসেন সাহেব। ঠাকুরগাঁওয়ে তিনি ন্যাপের সভাপতি ছিলেন। তিনি ঠাকুরগাঁও সিট থেকে কনটেস্ট করেছিলেন। নির্বাচনে তিনটা সিট-ই আওয়ামী লীগ পেলো। তারপর তো ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে গোটা দেশে যখন আন্দোলন শুরু হলো তখন ঠাকুরগাঁওয়েও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন ভাষণ দিলেন যে, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তারপরই আমরা ঠাকুরগাঁওয়ে ‘সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করি। সংগ্রাম পরিষদে আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি) এবং কমিউনিস্ট পার্টি-এই তিন দলের নেতৃবর্গকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো।

প্র: সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যুক্ত সদস্যদের নামগুলো বলবেন কি ? সংগ্রাম পরিষদের কাজই বা কি ছিলো ?
উ: আওয়ামী লীগের মো: ফজলুল করিম সাহেব এম. পি. এ. ছিলেন। ঠাকুরগাঁও আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি আবদুর রশিদ সাহেব ছিলেন। এ দিকে কমিউনিস্ট পার্টির কামরুল হোসেন, মেরাজুল হোসেন এবং ওয়ালি ন্যাপ-এর ছিলেন এফ. এ. মোঃ হোসেন, মোঃ নূরুল হক আর আমি বলরাম গুহঠাকুরতা। আরো কয়েকজন ছিলেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁদের নাম আমার মনে পড়ছে না। সংগ্রাম পরিষদ অনেক কাজই করেছিলো।

৭ মার্চের পরে আমরা কিছু লিফলেট ছাপিয়েছিলাম। পাকিস্তান সরকার যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করছে না এবং এরই প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু যে ৭ মার্চের ভাষণ দিলেন সেই প্রেক্ষিত মনে রেখেই আমরা কিছু লিফলেট ছেপেছিলাম এবং সেই লিফলেট ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যেকটি অংশে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিলো। সে সময় তো পঞ্চগড় ঠাকুরগাঁও মহকুমার অন্তর্ভুক্ত অন্তর্ভুক্ত ছিলো। অর্থাৎ পঞ্চগড়, তেঁতুলিয়া, আটোয়ারি, দেবীগঞ্জ-এ সব এলাকা আমাদের ঠাকুরগাঁওয়ের অধীনে ছিলো। আমরা অর্থাৎ নেতৃবর্গ যাঁরা ছিলাম তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে ঐ সমস্যা লিফলেট বিলি এবং সভা-সমিতি করতে লাগলাম। আমরা জনতাকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম যে, আমাদের এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম। সংগ্রাম পরিষদে আমাদের সঙ্গে আরো একজন ছিলেন এম. পি. এ. সিরাজুল ইসলাম- যিনি পঞ্চগড় আটোয়ারি থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমরা সবাই ভাগ ভাগ করে বিভিন্ন থানায় মিটিং করতে লাগলাম।

প্র: ৭ মার্চের পরে আপনার কি কোনো উল্লেখযোগ্য জনসভার কথা মনে পড়ে ?
উ: এমন কোনো থানা নেই যেখানে আমরা মিটিং করিনি। প্রত্যেকটি থানাতে এমন কি ইউনিয়নেও আমরা মিটিং করেছি। ২/১ দিন পর পর আমরা মিটিং করেছি আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাপ মিলে। এভাবে মিটিং মিছিল চলাকালে ২৫ মার্চ পাকিস্তান আর্মি হঠাৎ করেই ব্যাপকভাবে আক্রমণ শুরু করে। এ সংবাদ আমরা ২৫ মার্চ রাতেই পেয়ে যাই। পর দিন ২৬ মার্চ বেলা ১০টায় এর প্রতিবাদে আমরা বিশাল এক মিছিল বের করলাম ঠাকুরগাঁও শহরে। এই মিছিলে সর্বস্তরের জনগণ আমাদের সাথে ছিলো। সব রাজনৈতিক দলই এই মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিলো। এ দিন বিকালে আওয়ামী লীগ দলীয় এম. পি. খাদেমুল ইসলামের ভাড়া বাড়ির মালিক রফিউল এহসান-এর বাড়ির ভিতর ছোট্ট একটি ঘরে আমরা অত্যন্ত গোপনে মিটিং করলাম। এই সভাতেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা বা নেতৃত্ব দেয়ার জন্য একটা সেল গঠন করা হয়। আমরা সভায় বসেছিলাম ২৬ মার্চ বিকাল পাঁচটায়।

প্র: কারা কারা এই মিটিংয়ে ছিলেন ?
উ: আমার যতদূর মনে পড়ে আওয়ামী লীগের এম. পি. এ. ফজলুল করিম সাহেব, আবদুর রশীদ সাহেব, ন্যাপের এফ. এ. মোঃ হোসেন সাহেব, ন্যাপের সেক্রেটারি মোঃ নূরুল হক সাহেব, ন্যাপের ভাইস প্রেসিডেন্ট আমি ছিলাম, কমিউনিস্ট পার্টির কামরুল হোসেন এবং আলা বলে একটি ছেলে ছিলো। কমিউনিস্ট পার্টির সৈয়দ মেরাজুল হোসেন ছিলেন কিনা আমার ঠিক মনে পড়ছে না। ঐ সভায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, এখন যে সংগ্রামটা শুরু হলো সেটা পুরোপুরি যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে সংগ্রাম বা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য আমরা আমাদের নেতা এবং নেতৃত্ব ভাগ করে নেই। একটা চার্ট আমরা তৈরি করলাম। সেই চার্টে আমরা প্রথম নেতৃত্বে রাখলাম এফ. এ. মোঃ হোসেন সাহেব এবং আওয়ামী লীগ দলীয় এম. পি. এ. জনাব ফজলুল করিম সাহেবকে। যদি এরা দু’জন মারা যান তাহলে পরবর্তীতে আবদুর রশীদ সাহেব ও কামরুল হোসেন সাহেব নেতৃত্ব দেবেন। এরা দু’জন মারা গেলে আমি বলরাম গুহঠাকুরতা ও নূরুল হক নেতৃত্ব দেবো। আরো সিদ্ধান্ত হয় যে, এই রাতেই আমরা প্রতিটি থানা থেকে জনগণকে With Arms অর্থাৎ তাদের কাছে যে বন্দুক, গাদাবন্দুক, লাঠি সোটা- যা আছে তাই নিয়ে আমরা ঠাকুরগাঁও শহরে আসবো এবং তারপর আমরা ই.পি.আর ক্যাম্পে যাবো। এই শো ডাউনের কারণ ছিলো। ই.পি.আর. ক্যাম্পের কিছু বাঙালি জওয়ান ৭ মার্চের পর থেকেই আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখছিলো। তারা আমাদের এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলো যে, আমরা যদি ই.পি.আর.-বাহিনীর ৯ নম্বর উইং-এর গেটে বিশাল জনতার মিছিল নিয়ে যেতে পারি তাহলে বাঙালি ইপিআর-রা আমাদের সাথে যোগ দেবে। তাদের সেই আশ্বাসের ভিত্তিতেই আমরা সব থানাতেই ২৬ মার্চ সারা রাত জেগে অরগানাইজ করলাম। আমার দায়িত্ব পড়েছিলো আটোয়ারি থানা। আমি একটা মটর সাইকেলে সাথে একজনকে নিয়ে আটোয়ারি থানার চরেয়া, মীর্জাপুর, রসেয়াসহ পুরো আটোয়ারি থানার যে সব বয়স্ক রাজনীতিক ছিলেন তাঁদের সাথে যোগাযোগ করলাম। তাঁরা তাদের বন্দুক, লাঠিসোটা, চাল-ডাল নিয়ে প্রস্তুত হলো শহরে যাবার জন্য। চাল-ডাল নেয়ার কারণ হলো যারা শহরে থাকবে তাদের খাবার প্রয়োজন হবে। তাই তারা তাদের সামর্থ্য মতো যে যা পারলো তাই দিলো। আমি চাল-ডাল, জিনিসপত্র এবং লোকজন নিয়ে ট্রাকে করে ২৭ মার্চ সকাল ৯টায় ঠাকুরগাঁও শহরে এলাম। আমরা ঠাকুরগাঁও চৌরাস্তা থেকে মিছিল বের করলাম। আমাদের লক্ষ্য ছিলো এই মিছিল নিয়ে আমরা ইপিআর ক্যাম্পে যাবো এবং তারা আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে। বড় আশা নিয়েই আমরা ইপিআর উইং হেডকোয়ার্টার গেটে গিয়েছিলাম। আমি যেমন আটোয়ারি থানা থেকে লোকজন নিয়ে এসেছিলাম। সে রকমভাবে বিভিন্ন থানা থেকেই লোকজন নিয়ে আসা হয়েছিলো। মোঃ নূরুল হক সাহেব পঞ্চগড় থেকে ব্যক্তিগতভাবে এসেছিলেন। কিন্তু পঞ্চগড়, তেঁতুলিয়া থেকে তার পক্ষে লোকজন আনা সম্ভব হয়নি দূরত্বের কারণে। তবে আশ পাশের যত থানা ছিলো- সকল থানা থেকেই লোকজন আসলো। সর্বস্তরের জনগণ মিলে এমন কি মুসলিম লীগ, যাদেরকে আমরা স্বাধীনতা বিরোধী বলে মনে করি তাদেরও অনেক সমর্থক ও কর্মী আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলো। আমরা ঠাকুরগাঁও শহর থেকে মিছিল করে ইপিআর ক্যাম্পের গেটে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি ইপিআর বাহিনী মেশিনগান, থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও অন্যান্য অস্ত্র হাতে পজিশন নিয়ে বসে আছে। ওখান থেকেই কয়েকজন বাঙালি ইপিআর সদস্য আমাদেরকে ইশারা করলো চলে যাবার জন্যে। চলে যাবার ইশারাটা আমরা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তারা আমাদের চলে যেতে বলছে না আসতে বলছে সেটা বুঝতে পারিনি। সেই মুহূর্তে একজন পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন একটি রাইফেল নিয়ে ফায়ার শুরু করে ইপিআরদের আমাদের দিকে তাক করে পজিশন নিতে বললো। ওরা যখন পজিশন নিতে আরম্ভ করলো আমরা তখন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলাম। কথা ছিলো, বাঙালি ইপিআর-রা আমাদের সাথে যোগ দেবে। কিন্তু যোগ না দিয়ে যখন গুলি চালাতে আরম্ভ করলো তখন আমরা ওখান থেকে ব্যাক করে শহরে ঢুকলাম। কিন্তু শহরে ঢুকেই দেখতে পেলাম যে, অন্য রাস্তা দিয়ে ইপিআর বাহিনী ঠাকুরগাঁও শহরে এসে বিভিন্ন রাস্তার কোণে অবস্থান নিয়েছে মেশিনগান, রাইফেল ইত্যাদি নিয়ে। প্রতিটি গ্রুপের সাথেই দু’জন করে পাঞ্জাবি জেসিও ছিলো। তাদের কাছে পিস্তল ছিলো, এস. এল. আর-ও থাকতে পারে। ইপিআর-এর যারা বাঙালি জোয়ান ছিলো তারা সামনে ছিলো এবং তারা পজিশন নিয়ে ছিলো।

তখন বেলা বারোটা কিংবা একটা হবে। আমরা যখন মিছিল নিয়ে ফিরছিলাম তখন মোহাম্মদ আলী নামে একজন রিক্‌সাওয়ালা এবং তার সাথে আরো কয়েকজন মিছিলে সামিল হতে যাচ্ছিলো। তারা মিছিলের শেষভাগে ছিলো। এ সময় তাদেরকে ইপিআর-রা চেজ করলো। ওদের তারা বললো, ‘রুখ যাও, কেয়া মাংতা, ? তখন তারা বললো, ‘জয় বাংলা’। হাত তুলে ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করতে শুরু করলো। তখন ইপিআররা মোঃ আলীকে লক্ষ্য করে গুলি করে। ফলে, সে সেখানেই মারা যায়। যেখানে সে মারা যায় পরবর্তীতে সেখানেই তার কবর হয়েছে। যাহোক, গুলি হওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমরা খবর পেলাম যে, নরেশ চৌহান নামে অপর একটা ছেলেও গুলিতে নিহত হয়েছে। যদিও ছেলেটা ঘরের মধ্যে ছিলো। গুলিটা বেড়ার ভিতর দিয়ে ঢুকে তাকে বিদ্ধ করায় সে মৃত্যুবরণ করে। স্বাধীনতার পর তার স্মরণেও একটা স্মৃতি সৌধ হয়েছে। এই দু’টো মৃত্যুর পর ঠাকুরগাঁও-য়ের লোকজন পালাতে শুরু করে। তখন থেকেই ঠাকুরগাঁওয়ে কার্ফু শুরু হলো। এ সময় আমার বাড়িতে কিছু আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং এফ. এ. মোহাম্মদ হোসেন সাহেব সহ আরো কয়েকজন ছিলেন। আমরা বাড়ি থেকে বের হবার কোনো রাস্তা পাচ্ছিলাম না। কারণ আমার বাড়ির চারদিকেই ইপিআরদের মেশিনগান ফিট করা ছিলো। আমরা তখন চিন্তা করছি কিভাবে কোথায় থাকবো। এভাবে যখন ভাবছি তখন রাত্রি বারোটার দিকে আমরা গুলির আওয়াজ পেলাম ইপিআর ক্যাম্প থেকে। ইপিআর ক্যাম্পের এই আওয়াজ আস্তে আস্তে প্রচন্ড আকার ধারণ করলো। এদিকে ইপিআর যারা শহরে অবস্থান নিয়েছিলো তারা উইথড্র করে চলে গেলো। ইপিআর-রা চলে যাবার পর আমরা যারা ইয়াং ছিলাম তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম এবং ইপিআর ক্যাম্পের দিকে গেলাম।

তখন রাত দু’টো আড়াইটে হবে। দূর থেকে আমরা দেখছি গোলাগুলি হচ্ছে। কিন্তু সাহস করে এগুতে পারছি না। যুদ্ধটা যে কাদের মধ্যে হচ্ছে, কে করছে এ সব কিছুই জানা যাচ্ছে না। এর মধ্যে হঠাৎ করে আমরা ইপিআর-এর চারজনকে দেখতে পেলাম যারা রীতিমতো যুদ্ধের পোষাক পড়ে অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসছে। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। বুঝতে পারছিলাম না, এরা পাকিস্তানের সমর্থক না আমাদের সমর্থক। আমরা গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম। কিছদূর এগিয়ে এসে তারা ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে উঠলো। ‘জয় বাংলা’ চিৎকার শুনে আমরা দৌঁড়ে তাদের কাছে গেলাম এবং তাদের সাথে হাত মেলালাম। তারা বললো, ‘আমরা অনেক দুশমনকে খতম করেছি এবং এখনও খতম করা হচ্ছে। আপনারা শহরের দুশমনদের মারেন।’ শহরের দুশমন কথাটার অর্থ হচ্ছে যখন অসহযোগ আন্দোলন চলছিলো তখন আমাদের কাছে খবর আসে যে, ইপিআর ক্যাম্প থেকে কিছু অস্ত্র শহরের অবাঙালিদের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে। এটা আমরা কেউ কেউ দেখেছি এবং এটা আমাদের নলেজে ছিলো। এরা আমাদের ইঙ্গিত করলো ঐ সমস্যা লোকজনদের মেরে ফেলার জন্য। দু’টো কারণে তারা আমাদের এ কথা বলেছিলো। একটা হলো অবাঙালিরা আমাদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। দ্বিতীয়ত এই আন্দোলনটা কোথায় যাবে কেউ তা বলতে পারে না। যদি এটা ফেল করে তাহলে ঐ সমস্যা অবাঙালিরাই আমাদের চিনিয়ে দিতে পারে। তখন আমি তাদের বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে, আপনারা যদি এখন এ কাজে এগিয়ে যান তাহলে এ সংগ্রাম নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আপনারা আপনাদের জায়গায় যান। সেখানে আমি সবার সিনিয়র ছিলাম বলে তারা আমার কথা শুনলো এবং ফিরে গেলো। ২৭ মার্চ রাত থেকে ২৮ মার্চ দিনভর গোলাগুলি চলতে থাকে। এই সংঘর্ষে ইপিআরদের অবাঙালি কমান্ডিং অফিসারও প্রাণ হারায়। একজন পাঞ্জাবি মেজর ছিলো ইপিআর উইংয়ে, মোঃ হোসেন তার নাম, তিনি শেষ পর্যন্ত বাঙালিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে প্রাণ হারান। তার ছেলে নিহত হয়। তার সঙ্গীও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। তার ছোট একটা ছেলে বেঁচে যায়। তাকে কেউ হয়তো ক্যাম্প থেকে নিয়ে আসে। শামসুজ্জোহা কাদের বক্‌স, যিনি মীর্জা রুহুল আমিনের চাচাত ভাই তার কাছে তাকে দেওয়া হয়েছিলো। পরে পাকিস্তানি ফোর্স যখন এই এলাকা দখল করে নেয় তখন তারা ঐ বাচ্চাটাকে পাকিস্তানিফোর্সের কাছে হস্তান্তর করে। যাহোক, ইপিআর-জনতা ঠাকুরগাঁও মুক্ত করলো। এরপর আমরা চিন্তা করলাম যে, চারিদিক থেকে ঠাকুরগাঁও শহরে ঢোকার যে রাস্তাগুলো, সেগুলোতে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

প্র: তখন কি আপনাদের কোনো কন্ট্রোল রুম ছিলো ?
উ: হ্যাঁ, ছিলো। সংগ্রাম পরিষদের প্রথম কন্ট্রোল রুম ছিলো ফজলুল করিম সাহেবের কাছারি ঘরে। এটা ঠাকুরগাঁও চৌরাস্তার দক্ষিণ দিকে। সেটাকে এখন মোহাম্মদ আলী সড়ক বলা হয়। কিন্তুপরবর্তীকালে যখন স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়ে যায় এবং যুদ্ধবস্থানে সৃষ্টি হয় অর্থাৎ ২৬ মার্চের পর আমরা ঠাকুরগাঁও এস. ডি. ও. কোর্টের একটা রুম তাদের কাছ থেকে নিয়েছিলাম কন্ট্রোল রুমের জন্যে। সেখানে সার্বক্ষণিকভাবে আমাদের লোক ডেপুটেড করা ছিলো। তখন আমাদের কাজ ছিলো চারিদিকে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা। এ সময় ঠাকুরগাঁওয়ের এস. ডি. ও. ছিলেন তসলিম উদ্দীন সাহেব। প্রথম দিকে আমাদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিলো না। কিন্তু এস. ডি. ও. সাহেবের অফিস সংলগ্ন ট্রেজারি বিল্ডিংয়ের মধ্যে কিছু রাইফেল ছিলো। এ সব অস্ত্র আমরা জোর করে বের করে নিলাম এবং আমাদের ছেলেদের মধ্যে বিলি করলাম। তখন ঠাকুরগাঁওয়ে কোনো বৈদ্যুতিক আলো ছিলো না।

নিরাপত্তার কথা ভেবে এ সময় বিবাহিত ও বয়স্কদের অধিকাংশকেই ঠাকুরগাঁও টাউন থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তারা গ্রামে গঞ্জে নিরাপদ দূরত্বে আশ্রয় নিয়েছিলো। আমরা ইয়াংরা শুধু ঠাকুরগাঁও শহরে ছিলাম। ইয়াংদের মধ্যে আবার আমি সিনিয়র ছিলাম। এইভাবে আমরা যখন চারিদিকে ব্যারিকেড দিচ্ছি সে সময় একদিন বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আশরাফ-এর নেতৃত্বে কিছুসংখ্যক বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ান ঠাকুরগাঁও শহরে আসে। তারিখটা ঠিক মনে নেই। বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঘ মার্কা মনোগ্রাম দেখে ওদেরকে আমরা শহরে স্বাগত জানালাম। জনতা উল্লসিত হলো। কিন্তু তারা আমাদের সাথে তেমন কোনো কথাবার্তা না বলে আবার শহর ছেড়ে চলে গেলো। তাদের মূল ক্যান্টনমেন্ট ছিলো সৈয়দপুরে। পাকিস্তানি আর্মি সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলো। সৈয়দপুর থেকে তারা আস্তে আস্তে ঠাকুরগাঁও শহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছিলো। আমরা চারিদিকে রাস্তাঘাট কেটে ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছিলাম। প্রকৃতপক্ষে ২৭ মার্চ থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত চম্পাতলী থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত এই গোটা এলাকা মুক্ত ছিলো। ঠাকুরগাঁওয়ে বস্তুত: তখন কোনো প্রশাসন ছিলো না। বাংলাদেশের যে মূল ভূ-খন্ড তা থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন ছিলাম। মূল নেতৃত্ব থেকেও আমরা বিচ্ছিন্ন ছিলাম। আমরা তখন জানতাম না যে, আমাদের কেন্দ্রীয় নেতারা কোথায়, বঙ্গবন্ধু কোথায় ? তাঁরা কে কোথায়, কি করছেন, এ সবের আমরা কিছুই জানতাম না। আমরা কিছু মানুষ সম্পূর্ণ অন্ধকারের মধ্যেই লোকালি এই সংগ্রামটা চালাতে লাগলাম।

এপ্রিল মাসের ৪/৫ তারিখের দিকে আমাদের মনে হলো যে, আমরা এটা আর ধরে রাখতে পারবো না। পাকিস্তানিরা ক্রমশ: এগিয়ে আসছে হেভি আর্টিলারি নিয়ে। যখন আমরা ইপিআর ক্যাম্প টাকে পুরোপুরি দখলে আনলাম তখন বাঙালি সৈনিকদের মধ্যে সুবেদার কাজিমদ্দীন নামে একজন ছিলেন। ঠাকুরগাঁওয়ে ইপিআর বাহিনীর মধ্যে তিনি তখন সিনিয়র সুবেদার ছিলেন। তার কাছ থেকে আমরা শুনলাম যে, তাদের কাছে কেবল থ্রি নট্‌ থ্রি রাইফেল, কিছু এস. এল. আর, এস.এম.জি. আর চারটা নাকি ফোর অথবা সিক্স পাউন্ডার গান আছে। আমরা এই ‘গান’ সম্পর্কে আগে জানতাম না। দেখলাম, একটা পাইপ তার মধ্য দিয়ে কোয়ার্টার মাইল পর্যন্ত গোলা ছোঁড়া যায়। হেভি হাতিয়ার বলতে অন্য কোনো গান ছিলো না। যখন পাকিস্তানিবাহিনী এগিয়ে আসতে লাগলো এবং দ�র থেকে গোলা ছুঁড়তে থাকলো তখন আমি, ইপিআর সুবেদার কাজিমদ্দীন সাহেব, এস. ডি. ও. বা মহকুমা প্রশাসক তসলিমউদ্দীন সাহেব এবং সংগ্রাম পরিষদে যারা ছিলাম তারা মিটিং করে বললাম, এভাবে তো আমরা বাঁচবো না। পাকিস্তানিরা এক পর্যায়ে আমাদের মেরে ফেলবে। এস. ডি. ও. তসলিমউদ্দীন সাহেব প্রথম দিকে আমাদের সাথে ছিলেন। কিন্তুপরে অর্থাৎ ঠাকুরগাঁও ফল করার পর পাকিস্তানিআর্মির সাথে যোগ দিয়েছিলেন, যদিও তিনি বাঙালি ছিলেন। যাহোক, যে কথা বলছিলাম- ঠাকুরগাঁও থেকে ইন্ডিয়ান বর্ডার ছিলো কাছে। তাই আমরা ঐ সভাতেই ঠিক করলাম ইন্ডিয়াতে লোক পাঠানো হবে। উদ্দেশ্য, সেখান থেকে হেভি আর্মস ও অন্যান্য সাহায্য সামগ্রী আনা যায় কিনা। এটা এপ্রিল মাসের ৪ কি ৫ তারিখের কথা। তখন ওই সভাতেই সিদ্ধান্ত হলো যে, আওয়ামী লীগের যে সেক্রেটারি ছিলেন রশীদ মোক্তার সাহেব তিনি এবং আমি ভারতে যাবো। আমি যেহেতু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ, অ্যাডভোকেট, রাজনীতি করি, তাই তারা আমাকে বললেন যে, আপনি ইন্ডিয়াতে এই গ্রুপের অন্যতম প্রতিনিধি হিসাবে যাবেন এবং তাহলেই হয়তো একটা স্কোপ পাওয়া যেতে পারে। সেভাবেই সেখানে তারা রেজুলেশন নিয়ে আমাকে আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি হিসাবে দেখানো হলো। এর কারণ ছিলো- ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা জনগণ ন্যাপ কিংবা অন্য রাজনৈতিক দলকে তেমন চিনতো না। ’৭০-এর নির্বাচনের কারণে, আন্দোলনের কারণে তারা তখন চেনে আওয়ামী লীগকে। এখন যেহেতু যুদ্ধাবস্থানে তাই আমরা কে কি দল করি- এ সব চিন্তা ভাবনা না করে লিখিত সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, বলরাম গুহঠাকুরতা ঠাকুরগাঁও আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি এবং আবদুর রশীদ প্রেসিডেন্ট- এদের দু’জনকে ভারতে পাঠানো হলো। এরা ভারত সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে হেভি আর্মস ও অন্যান্য সামগ্রী আনা যায় কিনা তার ব্যবস্থানে করবে।

এই সিদ্ধান্তের পর আমাকে এবং আবদুর রশীদ সাহেবকে টাকা পয়সা দিয়ে একজন ইপিআর-এর জওয়ানসহ আমাদেরকে মরাগতি নামক একটা জায়গা দিয়ে ইন্ডিয়ার বর্ডারে পৌঁছে দিলো। ওপাশে বি. এস. এফ.-এর একজন ক্যাপ্টেন দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরে জানতে পারি তাঁর নাম ক্যাপ্টেন ধীলন। আমি এ পাশ থেকে তাঁকে ইংরেজিতে জোরে জোরে বললাম,We are in problem, we are detached from the main land. But we are not able to keep our position this way. We want to talk your government. আমার কথা শুনে তিনি একটা ছোট নদীর ওপার থেকে আমাদের ইশারা করলেন ওপারে যাওয়ার জন্য। তখন আমি আর রশীদ মোক্তার সাহেব ওপারে গেলাম। সেখানে যাবার পর আমি তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, আমাদের বর্তমান অবস্থা এবং ইলেকশনের পর থেকে গোটা বাংলাদেশের অবস্থা। আমি বললাম, চম্পাতলী থেকে তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, আটোয়ারি এবং বীরগঞ্জ পর্যন্ত আমাদের যে এলাকা, সেটা যদিও মুক্ত আছে কিন্তুআমাদের সেখানে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধে হেভি আর্মস নেই। আমরা main land থেকে সম্পূর্ন detached. Main land-এ আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কে কোথায় কিভাবে আছেন তাও আমরা জানি না। আমাদের কাছে তেমন উল্লেখযোগ্য অস্ত্র ও নেই যে, আমরা পাকিস্তানি আর্মিকে প্রতিহত করতে পারবো। পাকিস্তানিরা কিন্তু ধীরে ধীরে আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তখন তিনি বললেন যে,We can not do anything, but one thing I can do. I can arrange for you, if you go to kolkata. আপনি কলকাতা গিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কারো সাথে কথা বলেন। তার প্রস্তাবে আমরা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলাম। তখন তিনি আমাদেরকে বি. এস. এফ.-এর একটা গাড়ি দিয়ে কিষণগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন এবং সেখান থেকে তারা কলকাতাগামী একটা বাসে তুলে দিলেন।

আমরা কলকাতা এলাম সম্ভবত: ৬ এপ্রিল। কলকাতা বিরাট শহর। এখানে কার সাথে কোথায় যোগাযোগ করতে হবে আমরা জানি না। আমাদের তো ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আগে থেকে কোনো যোগাযোগ ছিলো না। আর আমরা গেলেই যে, ওখানকার উচ্চ পর্যায়ের কেউ যে আমাদের সাথে কথা বলবেন- এমন গ্যারান্টি কে দেবেন ? তখন আমাদের একটা সুযোগ হলো। ঠাকুরগাঁওয়ের একজন আইনজীবী ছিলেন, তার নাম শরৎ দত্ত। ভারতে তাঁর এক জামাতা ছিলেন হেনলী কেবলস নামে একটা ইলেকট্রিক ওয়্যার কোম্পানির চীফ একাউন্টস অফিসার, তাঁকে আমরা চিনতাম। তাঁর কাছে আমরা গেলাম এবং তাঁকে সব কথা বলে তার সাহায্য চাইলাম। তখন তিনি বললেন, আমাদের কোম্পানির যিনি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, তিনি শেরিফ অব কলকাতা, তাঁর নাম ডি. এন. ঘোষ, তিনি রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরির ঘনিষ্ঠ বন্ধুও বটে। তিনি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কারো সাথে আপনাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থানে করতে পারবেন। শরৎ দত্ত বাবুর জামাতা বললেন, আমি এটুকু করতে পারি যে, আপনাদের দু’জনকে আমি ডি. এন. ঘোষের কাছে নিয়ে যেতে পারি। তখন তার মাধ্যমে একটা সময় ঠিক করে আমরা দু’জন ডি. এন. ঘোষের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে আমাদের সমস্যার কথা বললাম। তিনি প্রথমেই বললেন, Have you heard any revolution that without making cell in the neighbouring country ? Any revolution could be possible? আমি এ প্রশ্নের উত্তর দিতেই তিনি আমাকে বসতে বললেন। তারপরই বললেন, Where are your leaders ? শেখ মুজিব কোথায় ? অন্যান্য বড় বড় নেতারা কোথায় ? আমি তখন আমাদের পজিশনটা তাঁর কাছে আবার তুলে ধরলাম। তাঁকে বললাম, সৈয়দপুর থেকে কয়েক মাইল দূরে চম্পাতলী। এরপর থেকে দিনাজপুর জেলার যে অংশটা সেটা যদিও মুক্ত আছে কিন্তু main land থেকে আমরা সম্পূর্ন detached। যদি পাকিস্তানিরা আমাদের দিকে অগ্রসর হয় তাহলে আমরা তাদেরকে রুখতে পারবো না। কারণ আমাদের কাছে কোনো ভারী অস্ত্র নাই। তখন তিনি বললেন, ঠিক আছে, আমি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলি। তবে, আমি মনে করি না যে, আপনারা কোনো অস্ত্র পেতে পারেন। কারণ আপনাদের কি identity আছে ? কি কারণে একটা সরকার আপনাদের মুখের কথার ওপর নির্ভর করে অস্ত্র দেবে ? মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ডি. এন. ঘোষ কথা বললে তিনি বলেন, এটা সম্ভবই না। এটা তো কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাপার। এটা রাজ্য সরকারের কোনো ব্যাপার নয়। এটা একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী করতে পারেন। মুখ্যমন্ত্রী তাকে একথা জানিয়েছেন। ডি. এন. ঘোষ আরো বললেন, আর এটা করতে হলেও আপনাদের দেশের জনগণের যারা প্রতিনিধি তাঁদেরকে আসতে হবে। একটা অ্যাগরিমেন্ট হবে। তারপরে অস্ত্র দেয়ার প্রশ্ন। আমিও তখন দেখলাম, আসলে এটাই ঠিক। আমাদের কথা মতো তারা কেন অস্ত্র দেবে ? সে দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, ন্যাপ বা অন্য কোনো পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কলকাতায় এসেছেন কিনা সেটা জানাও আমাদের পক্ষে সম্ভব হলো না। এরপর ডি. এন. ঘোষ আমাদের বললেন, আপনাদেরকে দিয়ে আমি একটা সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করতে পারি, আপনারা যদি রাজি থাকেন। আমরা তার এই প্রস্তাবে রাজি হলাম। ডি. এন. ঘোষ দ্রুতই সেই প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করলেন। ঐ প্রেস কনফারেন্সের অভিজ্ঞতা বা সৌভাগ্য জীবনে আমার আর হবে না। কারণ প্রেস ট্রাস্টের চীফ এডিটর বোধহয় তখন সুধীর মুখার্জী ছিলেন, তিনি এবং আনন্দবাজার পত্রিকার চীফ এডিটরসহ প্রায় প্রত্যেকটি পত্রিকার চীফ এডিটররা সেই প্রেস কনফারেন্সে উপস্হিত ছিলেন।

চলবে...

সোমবার, ১৭ নভেম্বর, ২০০৮

ক্রেডিট ছিনতাইয়ের নোংরা রাজনীতির কাছে যখন পরাজিত হয় মানবতার বাণী

1 টি মন্তব্য :
সামহোয়্যার ইন ব্লগে ব্লগার ভাস্কর চৌধুরির পোস্ট পড়ে সযতনে এড়িয়ে গিয়েছিলাম। মানবীর পোস্ট পড়েও এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম। নিজের স্বামর্থের দিকটা চিন্তা করেই অনেক সময় এড়িয়ে যাই। এড়িয়ে যেতে চাইলেও অনেকসময়ই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। দেশ হতে হাজার মাইল দূরে বাস করে কত টুকুই বা করতে পারি ? হয়তো কিছু আবেগ ভরা বাক্যবর্ষন করে নিজের বিবেককে বোঝানোর চেস্টা, কখনো কিছু টাকা দান করে নিজেকে বাহাবা দেবার শিশুসুলভ চেস্টা। তারপরো অনেক মানুষ থেমে থাকে না। নিজের স্বামর্থের শেষ বিন্দু দিয়ে চেস্টা চালান তারা কোনো রকম প্রতিদানের আশা না করেই।
যে যার মতো চেস্টা চালান। কেউ বা ব্লগে পোস্ট দিয়ে সচেতনতা স্মৃস্টি করে , কেউবা ইমেইল করে প্রচার চালিয়ে, কেউবা ফান্ড রেইজ করে, কেউবা মাঠে নেমে স্বশরীরে।
এর মধ্যেও শুরু হয় ক্রেডিট নেবার নোংরা চেস্টা। ক্রেডিট না পেয়ে কারো শিশুসুলভ আচরন ! মানবীর পোস্টে যেটা লক্ষ্য করেছি। মানবীর শেষ পোস্ট আমার কাছে ভালো লাগেনি। আমারব্লগে ফান্ড রেইজ করার চেস্টা উনি বেমালুম চেপে করলেন সামহোয়্যারইন ব্লগকে প্রশংসা ! সামহোয়্যার ব্লগ ছাড়াও অন্য ব্লগের অবদানকে উনি এড়িয়ে গেলেন অনেকের দেখিয়ে দেয়া সত্বেও। এটা না করলেই ভালো হতো। মূল সমস্যা শুরু হলো যখন আরিফ জেবতিক ' সাহায্য করার উদ্যোগ প্রত্যাহার করলাম " জাতীয় পোস্ট দিয়ে যেকোনো উদ্যোগ থেকে নিজেকে প্রতাহার করলেন, প্রকারন্তরে অন্যদেরকেও করতে বাধ্য করলেন। "আমার ব্লগ" থেকেও ফান্ড রেইজ করার ডোনেশন লিংক বন্ধ করে দেয়া হলো সাথে সাথে। যারা সেখানে জনির জন্য কিছু ডোনেট করেছিলেন তাদের সাথে কোনোরকম যোগাযোগও করা হলো না। বলা দরকার, জনির জন্য তোলা টাকা এখনো জনির কাছে পৌছেনি।
জনি যখন ঠান্ডায় নিউমোনিয়ায় ভুগছে, তখন অনেকে ভুগছিলেন ইগো সমস্যায়। জনি যখন ক্ষুধার তাড়নায় মুড়ি খেয়ে বাঁচার চেস্টায় তখন আমরা অনেকেই ব্যস্ত ছিলাম প্লাস/মাইনাস দেবার প্রতোযোগীতায়। জনি যখন ঠান্ডা মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছে তখন আমরা অনেকেই ব্যস্ত ছিলাম কাদা ছোড়াছুড়িতে। অথচ সব কিছু ভুলে আমাদের সবার উচিত ছিলো জনির পাশে দাঁড়ানো। ছোট্ট শিশুটির জীবনের চাইতেও জরুরী ছিলো আমাদের ইগো। জনির জন্য পর্যাপ্ত সাহায্য এসে পৌছিয়েছে বলে ঘোষনা করে সাহায্যের উদ্যোগ বন্ধ করতেও আমাদের বিবেকে বাধেনি।
এর পরো কি জনির জন্য কিছু করার উদ্যোগ থেমে থেকেছে ? থামেনি, থামবেও না। যারা সত্যিকারেই কিছু করার ইচ্ছে রাখেন তারা নিভৃতে কাজ করে যাবেন। যারা দেবার তারা দিবেন কোনো রকম ক্রেডিটের আশা না করেই। ক্রেডিট নেবার রাজনীতির কাছে "জনির" জন্য কিছু করার উদ্যোগ থেমে থাকবে না, কিন্তু থেমে যায় কিছু সাধারন মানুষের কিছু করার আকুতি। যে মানুষটি জনির বাড়ীতে তার দুধের সংস্থান করার জন্য গাভী পৌঁছে দিয়েছেন তিনিতো নাম কামানোর জন্য কিছু করেন নি ! জনির জন্য সব করা হয়েছে বলে উনার সাহায্য বন্ধ করেননি ! তবে আমরাইবা কেনো বন্ধ করবো ?
ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকি। অসহায় ক্রোধে মনটা ভরে উঠে।
জনি কি তার মায়ের হত্যার বিচার পাবে ?
জনি ও তার ছোট্ট বোনটি কি একটি সুন্দর জীবন ফীরে পাবে ?
অল্প সময়ের জন্য নিজের ইগোকে ভুলে, নেতা হবার শিশুসুলভ ভাবনা কে পাশে সরিয়ে রেখে কি আমরা মানবতার কথা ভাবতে পারি না ?

শনিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০০৮

হাবিজাবি ২

কোন মন্তব্য নেই :
প্রচন্ড গরম পড়েছে, হাড় কালা হবার উপক্রম। যখন লিখছি তখন তাপমাত্রা ২৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস, দূপূরে তা ছিলো ৩৩+। আবাসে- নিবাসে এ.সি. থাকাতে গরমের প্রভাব অনেকটুকুই টের পাই না। দূপুরে একটা কাজে বাহির হতে হয়েছিলো। দেখলাম রাস্তায় প্রচন্ড রোদের মাঝেও কিছু লোক কাজ করছে। এসি গাড়িড়ে বসে ভাবছিলাম কি কস্টই না করছে লোকগুলো ! জীবন সংগ্রাম বলে কথা। আরামে বসে- নিরাপদে বসে হয়তো জীবনের অনেক কস্টই টের পাওয়া যায় না কিন্তু জীবনের কোনো এক সময়ে সেই কস্টের সামান্য অভিগ্যতা থাকলে অন্যের কস্ট কিছুটা হলেও অনুভব করা যায়, যা তখন নিজে কিছুটা হলেও করতে পারছিলাম।

নিজের নামটা নিয়ে মাঝে মাঝে দারুন সব মজার সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এক অফিসে কিছু মাস কাজ করার দূর্ভাগ্য হয়েছিলো। কোনো এক দূপুরে নিজের ডেস্কে কাজ করছি, হঠাৎই বসের ডাক। যে সে বস নয়, একেবারে সিইও। "আবদুল" বলে ডাল দেবার পরও আমি সারা দিচ্ছি না, ভাবছিলাম অন্য কাউকে মনে হয় ডাকছে। পরে তাকিয়ে দেখি আমাকেই ডাকছে........"আবদুল"। যতদিন কাজ করেছিলাম ততদিন আমি সেখানে "আবদুল" বলে পরিচিত ছিলাম। যতই বলি আমার নাম "আবদুল্লাহ" ততই তারা বেশী করে "আবদুল" বলে ডাকতো।
এখন যেখানে কাজ করছি সেখানে সবাই চেনে "মাহবুব" হিসেবে। সেটা নিয়েও কম মজা হয় না বিশেষ করে মেয়েদের সামনে। একবার বস আমাকে ডেকে মেয়েদের একটি বিশেষ অংগকে ইংগিত করে , অভিনয় করে দেখিয়ে দেখিয়ে সবার সামনে ডাকছেন। আমিও এক মফিজ , সাড়া দিয়েছিলাম। মজাই লাগে এসব।

অনেকদিন পর মেজো মামা- সেজো মামার সাথে কথা হলো। শুনে প্রচন্ড অবাক হলাম, নানু বাড়ীর সেই অজ পাড়াগাঁয়েও এখন ক্যাবল টিভির কানেকশন !! আবার সেটা নাকি দারুন ব্যবসাও করছে। একসময় নানু বাড়ীতে পারিবারিক পাঠাগার ছিলো। কত্ত বই যে পড়েছি, কত্ত বই যে সেখান থেকে চুরি করেছি সেখান থেকে। শুনলাম কেজানি সেখানে একটা ডিভিডি ক্লাবও করেছে, ১০ টাকা দিয়ে ডিভিডি ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে সেখান থেকে। যে গ্রামে একসময় পারিবারীক পাঠাগার ছিলো বেশ কটা সেই গাঁয়েই সেই পাঠাগার একটিও নেই, আছে ডিভিডি ক্লাব। "ভাবতে ভালোই লাগে, দেশে এগিয়ে যাচ্ছে" গাজী ট্যাংকের বিগ্যাপনে গোলাম মুস্তফা যখন বলতেন তখন বেশ লাগতো। কিন্তু আসলেই কে দেশে এগিয়ে যাচ্ছে? হাতে বইয়ের বদলে রগরগে হিন্দি সিনেমার ডিভিডি !

প্রতিটা বছর শেষ হয় জীবনের হালখাতা খুলে বসি। ২০০৮ যে কি দ্রূত শেষ হয়ে যাচ্ছে টেরই পাচ্ছি না। এবারো হালখাতা খুলেছি। বছরের ডেবিট- ক্রেডিটের হিসেব চুকিয়ে ফাইনাল একাউন্ট মেলাবার আপ্রান চেস্টা। মেলাতেই হবে, যদিও অনেক হিসেবই মেলানো হবে না।

বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০০৮

ক্যানবেরার খেরোখাতা ১০

কোন মন্তব্য নেই :
গত কিছুদিন দারুন ব্যস্ততা গেলো। রেসের পাগলা ঘোড়ার মতো চোখে ঠুলি বেঁধে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সব কিছু করবার আপ্রান চেস্টা। ব্যস্ততা উপভোগ করি কিন্তু মাঝে মাঝে বড্ড ক্লান্ত লাগে, মনে হয় ব্যস্ততা কবে কমবে? কবে একটু শান্তিমত ঘুমুতে পারবো ? ঘুমন্ত সন্তানের মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ভাবি ! আহ কি শান্তির ঘুম ঘুমুচ্ছে আমার বাবালা ! ইচ্ছে হয় শৈশবে ফীরে যাই। নিশ্চিন্তে মায়ের বুকে মাথা রেখে ঘুমুই। অনেকদিন শান্তির ঘুম হয় না।

ছেলে আমার বড় হচ্ছে। দেখতে দেখতে কিভাবে যে ওর বয়স ১ মাস হয়ে গেলো ভাবতেই পারি না। আজ কাল হাসতে শিখেছে, স্বর্গীয় হাসি। ছেলের ফোকলা মুখের ভোকলা হাসি দেখলে সব কস্ট ভুলে যাই। মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকি ছেলের দিকে। মাঝে মাঝে নিজেকে চিমটি মেরে নিজের মনেই বলে উঠি, সত্যিই আমি বাবা হয়েছি।
অনেকদিন পর একটা মুভি দেখে আরাম পেলাম। Nyfes, গ্রীক মুভি। সিনোপসিসটা তুলে দেই একটু
"It is 1922, the year of the ASIA MINOR catastrophe, Greek men are at war and young Greek women (as well as from other impoverished countries) unable to find a husband are forced to accept arranged marriages and to emigrate in America where Greek men have emigrated before in search of jobs. They travel onboard King Alexander, a ship that does the regular transatlantic passing. All the brides-to-be have a picture and a name of the man they are going to marry. They are sad, leaving their country and family behind, but also apprehensive, trying to figure out their future life. The main characters are NIKH and NORMAN, who have the chance to get to know each other and whose lives are going to be affected by this trip." মুভির ট্যাগলাইনটা মনে ধরেছে " It's not a punishment to remember someone you love. The punishment is to forget "। একটা মুভি মনের মাঝে কতোটুকু নাড়া দেয় সেটা অনেকসময় আন্দাজ করা যায় না। মুভিটা অনুভব করতে হয়, মুভির গভীরে যেতে হয়। Nyfes এর থিম সংটা এখনো কানে বাজছে। ভাষা বুঝি না কিন্তু কেমন যেনো মন খারাপ করে দেয়া উদাস সুর।

নলেজ ম্যানেজম্যান্ট সিস্টেমের বিশাল এসাইন্টমেন্টা মনের মাঝে এঁকে ফেলেছি। ডিসকাশন পেপারের উপর ভিত্তি করে এখন এর সামগ্রিক নকশা তৈড়ি করা সময়ের ব্যপার। এদিকে হাতে সময় কম। শুধু বানালেই হবে না ম্যানেজম্যান্টকে খুশি করাতেও হবে। আবার সেই রেসের ঘোড়ার মতো চোখে ঠুলি বেঁধে রেস ট্ট্যাকে দৌড়ুতে হবে। কিন্তু, এত কস্টের ফল কি পাবো !? ইনশাল্লাহ।

আজ পোলাও রাঁধলাম। আফসোসের ব্যপার, আজো নরম হয়ে গিয়েছে। পানি কতটুকু দিতে হবে সেটার হের ফের করি ফেলছি আজ কাল। অথচ আগে এটা হতো না একদমই। পোলাওয়ের সাথে লালচে ঝাল মুরগী ভুনা , ফ্রেন্চ ড্রেসিং দেয়া কাঁচা-পাকার টমাটোর সালাদ। অনেকদিন পর বেশী খাওয়া হয়ে গেলো। নড়তেও পারছি না। ওপস........

আদার ব্যপারির মতো অর্থনীতি নিয়ে মাথা ঘামানোর চেস্টা করি মাঝে সাজে। আজ সাব প্রাইম মর্টগেজ ক্রাইসিস নিয়ে বউয়ের ছোটখাটো লেকচার শুনে জিনিসটা বেশ পরিস্কার হলো। স্টক মার্কেটে কোনো স্টক না থাকলেও স্টক এক্সচেন্জের ইনডেক্স নিয়ে আগ্রহ দেখাই যদিও স্টক সম্পর্কে কিছুই বুঝি না। এদিকে অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিও ভালো যাচ্ছে না। অজি ডলারের ডাল হুহু করে কমে যাওয়াতে একসময় আবিস্কার করলাম নিজের আয় মাসে ৫০ হাজার টাকা কমে গিয়েছে। দেশে টাকা পাঠাতে হলে অতিরিক্ত ডলার পাঠাতে হবে কিন্তু আয়তো বাড়েনি একবিন্দু, ১ মাস আগে যা ছিলো সেই রয়ে গিয়েছে। শাঁখের কড়াতের মতো অবস্থা। এদিকে জিনিস পত্রের দামও বাড়ছে। সংসার করতে এসে এখন হারে হাড়ে বুঝতে পারছি স্বল্প ও নির্দিস্ট আয়ে কি কস্টেই না আমার বাবা-মাকে সংসার চালাতে হয়েছে।

এখানে এখন বসন্ত। এদিক সেদিক বেড়াতে গেলে দারুন লাগে। সবকিছুতেই তারুন্যের ছোঁয়া। গাছে গাছে নতুন পাতা, হরেক রকমের বাহারী ফুল। দারুন লাগে। সন্ধ্যা নামার পর হাঁটতে বেরুলেই ফুলের সুবাস ভেসে আসে। মনটা কেমন জানি উদাস হয়ে যায়। অনেক ছোট বেলা রংপুরে এক বাসায় সবাই মিলে ভাড়া থাকতাম। সে বাসার পাশেই একটা কামিনী ফুলের ঝাড় ছিলো। কিছু দিন আগে সন্ধ্যায় হাঁটবার সময় মনে হচ্ছিলো কোথায় যেনো কামিনী ফুল ফুটেছে। ধুর ছাই, এই পান্ডব বিবর্জিত দেশে কামিনী ফুল আসবে কোথা থেকে !

আজ সকালে এক কাবুলীওয়ালার সাথে কথা হচ্ছিলো। একগাদা আফগান এম.পিকে অস্ট্টেলিয়ান সরকার কাবুল থেকে ক্যানবেরায় উড়িয়ে নিয়ে এসেছে গনতন্ত্র শেখাবার জন্য। হায়রে গনতন্ত্র ! এভাবে কি গনতন্ত্র শেখানো যায়? তাও আবার কাবুলীওয়ালাদের যারা গনতন্ত্রের স্বাদ পায়নি হাজার বছর ধরে। নিজের দেশের কথা ভাবছিলাম সে সময়। আমাদের দেশেও গনতন্ত্রের নামে এক অদ্ভুত রংগলীলা চলছে। পতিত স্বৈরাচারের সাথে জোট করে নির্বাচন, স্বাধীনতা বিরোধী পশুদের সাথে জোট করে নির্বাচন, ধর্ম ব্যবসায়ীদের সাথে জোট করে নির্বাচন। খেলারাম খেলে যায়, দেখারাম দেখে যায়। দেখছিতো দেখছিই। গতকাল ছিলো শহীদ নুর হোসেন দিবস। আচ্ছা, শহীদ নুর হোসেন অন্য জগত থেকে কি অবাক হয়ে দেখছে না তার রক্তদানের কি অসাধারন প্রতিদান ?

আজ বিকেলে সম্তাহের বাজার সদাই করে বাসায় ফিরছিলাম। বাসার কাছেই দারুন সব দামী রেস্টুরেন্টের বিশাল হাট। ফিরতি পথে দেখলাম একটা পরিবার রেস্টুরেন্টের বাহিরে দাঁড়িয়ে মেনু দেখছে। আমি দেখছি তাদের চোখ। কি অপার আগ্রহ নিয়ে তারা মেনু দেখছে কিন্তু চোখে একরাশ হতাশা। শখ আছে, সাধ্য নেই। এরকম চোখ দেখলে কস্ট লাগে, বুকের মাঝে কেমন জানি খচ করে উঠে। ইচ্ছে হচ্ছিলো ছুটে গিয়ে বলি " কি খেতে চাও, আমি খাওয়াবো" । হয়ে উঠে না, এখানেও সাধ ও সাধ্যের বিরোধ।

বাহিরে বেশ ঠান্ডা পরেছে। এই এক অদ্ভুত আবহাওয়া এখানকার। দিনে প্রচন্ড গরম কিন্তু রাতে ঠান্ডা। এসিতে মনে হয় জমে যাচ্ছি, হিটার ছাড়লে মনে হয় সওনায় সেদ্ধ হচ্ছি। ধ্যাত্তারি, জীবনটা লাইফ হয়ে গেলো।

সোমবার, ১০ নভেম্বর, ২০০৮

ছবি যখন কথা বলে ( উৎসর্গঃ শহীদ নুর হোসেন)

কোন মন্তব্য নেই :
দেখতে দেখতে ২১ টি বছর কেটে গেলো। বেঁচে থাকলে নূর হোসের বয়স হতো ৪৭ বছর। ২৬ বছরের সেই দূরন্ত ছেলেটি বুকে পিঠে " স্বৈরাচার নিপাত যাক, গনতন্ত্র মুক্তি পাক " শ্লোগান সাদা অক্ষরে লিখে পুলিশের গুলির সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো অকুতোভয়ে, সেই ছেলেটে কি আজ অন্য এক জগত থেকে তাকিয়ে দেখছে না তার রক্তের প্রতিদান !

গনতন্ত্র আসলেই মুক্তি পেয়েছে (? !)

ছবিই যখন কথা বলে তখন আর বলার বাকিই বা রইলো কি ?

নূর হোসেন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে 

নূর হোসেন (১৯৬১ - ১৯৮৭) বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সবচেয়ে স্মরণীয় নাম । ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্বৈরাচার এর বিরুদ্ধে সংগঠিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে নূর হোসেন নিহত হন।

নূর হোসেন ১৯৬১ সালে ঢাকার নারিন্দায় জন্মগ্রহন করেন। পিতা মুজিবুর রহমান ছিলেন পেশায় আটো-রিকশা চালক। অথর্নৈতিক অসচ্ছলতার কারনে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনার পর নূর হোসেন পড়াশুনা বন্ধ করে মোটর চালক হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। নূর হোসেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সারা বাংলাদেশে অবরোধ কর্মসূচী চলাকালে নূর হোসেন ঢাকায় স্বৈরাচার বিরোধী এক মিছিলে অংশ নেন। প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে বুকে পিঠে সাদা রঙে লিখিয়ে নেনঃ ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। মিছিলটি ঢাকা জিপিও-র সামনে জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি আসলে স্বৈরশাসকের মদদপুষ্ট পুলিশবাহিনীর গুলিতে নূর হোসেন নিহত হন। নূর হোসেনের মৃত্যুতে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ফলে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন আরোও ত্বরান্বিত হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ পদত্যাগ করেন।

নূর হোসেনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার নামে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়া তিনি যে স্থানে পুলিশের গুলিতে নিহত হন, তার নামানুসারে সেই জিরো পয়েন্টের নামকরন করা হয়েছে নূর হোসেন স্কয়ার।

বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর, ২০০৮

Obama "ওবামা" একটি নতুন যুগের সূচনা

1 টি মন্তব্য :

হয়তো কোনোই পরিবর্তন আসবে না এই পৃথিবীতে,
হয়তো বরাবরের মতো শান্তির বদলে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠবে এই ছোট্ট পৃথিবীর আনাচা কানাচে ।
তবুও
আমেরিকার ইতিহাসে এক নতুন যুগের , এক নতুন ধারার সূচনা করতে যাচ্ছেন বারাক ওবামা।
আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান প্রেসিডেন্ট, সাদা বাড়ীতে একজন কালো রাস্ট্র নায়ক।
"আমরাও পারি" , "পরিবর্তনের" ঘোষনা দিয়ে নির্বাচিত বারাক ওবামার সাফল্য কামনা করছি।
শান্তির অন্বেষায় কাতর মানুষ কি পাবে একটুখানি শান্তির প্রতিশ্রুতি ?

শনিবার, ১ নভেম্বর, ২০০৮

যা কিছু ভালো তার সাথেই প্রথম আলো - হরলিক্স আপনার সন্তানকে বানাবে........... ? বিবেক বিক্রি !!

কোন মন্তব্য নেই :
ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছি হরলিক্সে নাকি সব কিছু রয়েছে। এটা আপনার সন্তানকে "আরো লম্বা , আরো শক্তিশালী, আরো শার্প করবে "। এডের সেই পুঁচকে ছোড়াঁর ব্যাটের এক বাড়িতে ছক্কা হয়ে যাওয়া বা পরীক্ষায় প্রথম হওয়া যাওয়া নিমিষেই। মুগ্ধ হয়ে স্বপ্ন স্বপ্ন দেখতাম সেরকম হবার। পরিক্ষায় অতি সহজেই প্রথম হয়ে যাচ্ছি, লাফিয়ে লাফিয়ে মাঠে মাঝ খান দিয়ে দৌড়ুচ্ছি, এডের সেই ছেলকেটির মতো পেশী বৃদ্ধি পাচ্ছে, হাড় শক্ত হচ্ছে । বাহ বাহ !!!
যাই হোক একটা খবর শুনে টাসকি খেলাম। ও মা ; এ মহান বাণী নাকি অসত্য ! পুস্টি সম্পর্কে মিথ্যে তথ্য দেয়া হয়েছে নাকি এতে। এসবকে অসত্য বলে ঘোষনা দিয়ে ব্রিটেনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে সব রকমের বিজ্ঞাপনটিকে। শুনলাম নেসলের ম্যাগি নুডলসও নাকি মিথ্যে কথা বলেছে। ওরা বলছে ওসব নাকি ব্রিটেনের জন্য বানালো হয়নি, বানানো হয়েছে আমাদের মতো গরীব দেশের জন্য। তাই তো...........
কথায় আছে গরিবের বউ সবার ভাবী - সবাই সুযোগ নিচ্ছে। মেরেও দিচ্ছে ........আমরাও পেতে দিচ্ছি। আহ উঁহ্‌..........শান্তি।
ভালোই দেখালেন গুরু, যা কিছু ভালো তার সাথেই নাকি প্রথম আলো।
কিন্তু এটা কি ?
এটাও কি ভালো?
হায়রে টাকার কাছে বিবেক বিক্রি।

গত শুক্রবারে প্রথম আলোতে প্রকাশিত হরলিক্সের বিজ্ঞাপনের ছবি যুক্ত করলাম।
বাংলাদেশে সরকারও নাকি আইনের অভাবে কিছুই করতে পারছে এ ব্যপারে। বেশ বেশ !! ধন্য সরকার বাহাদুর।









এই খবরের বিস্তারিত বর্ণনা আছে  এ সংক্রান্ত খবরের জন্য এ লিংকে ক্লিক করুন
লেখাটি প্রথম আলো ব্লগে পূর্বে প্রকাশিত প্রথম আলো ব্লগ

হাবিজাবি ১

কোন মন্তব্য নেই :
জরুরি কাজ জমে আছে, ধরবো ধরবো বলে ধরা হয়ে উঠে না। কি যে আছে ভাগ্যে। শেষ মুহুর্তে এসে বরাবরের মতো মনে হবে, ইস্‌ আরেকটু সময় যদি হাতে পেতাম ! কি ভালোই না হতো। এবারেও এমনটি ভাব্বো। সামনের সপ্তাহটি দারুন ব্যস্ত যাবে। দারুন ব্যস্ততা।

দিনগুলো মজাতেই কেটে যাচ্ছে। ছেলের হাসি দেখলে সব কস্ট-দূঃখ ভুলে যাই। নতুন কাজ পেয়েছি, ছেলের দেখাশোনা করা। প্রথমে ভেবেছিলাম কাজটা অনেক সহজ কিন্তু এখন বুঝতে পারছি যা ভেবেছিলাম ঠিক ততটুকু সহজ নয় আদৌ। সবচেয়ে বড় ব্যপার হলো , ছেলের দৈহিক ভাষা বুঝতে পারছি। কোন কান্না খিদের কান্না আর কোন কান্না কোলে ওঠবার সেটাও বুঝতে পারছি। গতকাল প্রথম বারের মতো জিপির কাছে নিয়ে গেলাম রুটিন চেকআপের জন্য। ছেলে আমার বড্ড শান্ত, একটুও কাঁদেনি।

আজ মানিক ভাইদের দাওয়াত করলাম। এমনিতে বেছে বেছে মানুষের সাথে মেশাতে খুব কম মানুষের সাথেই মেশার সৌভাগ্য হয়। মানিক ভাই ও উনার পরিবারকে আমার অনেক ভালো লাগে। বয়সের পার্থক্য বেশ হলেও একজন মানুষ যখন বয়সের বাধা পেড়িয়ে সমসবয়সী আচরন করেন তখন মিশতে সহজ হয় , যেটা উনার ক্ষেত্রে হয়েছে। আয়োজন তেমন কিছু নয়। প্রচন্ড গরমে তরমুজের শরবত জমবে বলে তরমুজের শরবত;  সাথেতেহারী, সালাদ, মাছের কাবাব, ডেজার্ট হিসেবে পায়েস আর যথারীতি কোক। চায়ের ব্যবস্থা ছিলো কিন্তু উনাদের ব্যস্ততা ছিলো বলে দেয়া হয়ে উঠেনি।

বিরক্তিকর এক আবহাওয়া এখানে। দিনে গরম - রাতে ঠান্ডা। এসি ছাড়লে মনে হয় জমে যাচ্ছি আর হিটার ছাড়লে সেদ্ধ হবার উপক্রম। এমন পাগলাটে আবহাওয়ায় ছেলে আমার না অসুস্থ্য হয়ে পড়ে, বেশ চিন্তায় আছি।

মাঝে মাঝে পেছনের কথা ভাবি। কি কস্টের দিনটা না পার করেছি। সামনের হয়তো আরো কস্টের দিন আসবে তবে সেই সব কস্ট পেছনের সব কস্টগুলোকের ছাপিয়ে উঠতে পারবে না। দিন এভাবেই এগুতে থাকে, জীবন চলে যায় জীবনের মতো।

রবিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০০৮

প্রথম আলো ব্লগ নিয়ে অল্প কিছু কথা

২টি মন্তব্য :
সামহোয়্যার ইনের " বাঁধ ভাঙার আওয়াজের" মাধ্যমে বাংলা ব্লগিং এর যে সুচনা হয়েছিলো তারই ধারাবাহিকতায় প্রথম আলো ব্লগের আগমন। সামহোয়্যারইনের পথ ধরে সচলায়তন, প্যাঁচালী , আমার ব্লগ, নির্মান ব্লগের আগমন। হয়তো ভবিষ্যতে আরো ব্লগিং প্লাটফরম আসবে।

প্রথম আলো ব্লগের আগমনকে আমি বাংলা ব্লগিং এর আরেকটি ধাপ এগিয়ে যাওয়া বলেই মনে করছি। এর আগমনে  নতুন ধারার সুচনার সাথে সাথে হয়তো একটি সুস্থ্য/ অসুস্হ্য প্রতিযোগীতাও শুরু হবে ব্লগগুলোর মাঝে। যে ব্লগ ব্লগারদের বেশী সুযোগ সুবিধা দেবে, স্বাধীন মত প্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না সেই ব্লগ ততই জনপ্রিয়তা পাবে এবং টিকে যাবে। এটাই যুগের চাহিদা ও নিয়ম।

অনেকেই এর নীতিমালা সম্পর্কে কঠোর ও তীর্যক সমালোচনা করছেন। আমার নিজের কাছেও এটাকে বড্ড কঠিন ও হাস্যকর নীতিমালা মনে হয়েছে। নীতিমালা কাগজে কলমে থাকলেও এর প্রয়োগের উপরই এর সফলতা ও স্বার্থকতা নির্ভর করে। ব্লগের বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে মাহবুব মোর্শেদ যদি ব্যক্তিগত আক্রোশ বা পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভর করে কোনো স্বীদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন সে ক্ষেত্রে তার দায়ভার একান্তই তার ও এটার উপরও ব্লগের সফলতা বা বিফলতা নির্ভর করবে। নীতিমালার ক্ষেত্রে এটা বলতে পারি, ভবিষ্যতে ব্লগারদের মতামত ও পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে এর পরিমার্জনা অবশ্য আবশ্যক।

ব্লগস্ফিয়ারের অনেকের মাঝেই প্রথম আলো ব্লগ সম্পর্কে এক ধরনের বিবমিষা ও বিতৃষ্ণা লক্ষ্য করলেও সুকৌশলে এর ভবিষ্যত প্রভাবকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবনতা লক্ষ্য করছি, যেটা আমার চোখে লাগছে। অনেকের কাছেই ব্যক্তি মাহবুব মোর্শেদের প্রতি আক্রোশ এবং হিংসা কাজ করছে। অনেকের কাছেই ইগো সমস্যা ও প্রথম আলো ব্লগে লিখতে না পারার সম্ভাবতাও কাজ করছে। অনেকেই জিনিসটাকে পুরোপুরি ব্যক্তিগত হিসেবে নিয়ে তা সামস্ঠিক হিসেবে দাঁড় করাবার চেস্টায় রত। যেটা হাস্যকর লেগেছে।

প্রথম আলো ব্লগের কাছে সবচাইতে বড় প্রত্যাশা " মত প্রকাশের পূর্ন স্বাধীনতা"। ব্লগে দেশের রাজনীতি বা সরকারের এবং যেকোনো বিষয়ে মত প্রকাশের পূর্ন স্বাদীনতা এবং অবশ্যই সমালোচনা করার পূর্ন স্বাধীনতা থাকতে হবে। ব্লগের মাধ্যমে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সমালোচনা আসলেও সেটার প্রতি মর্যাদা দিতে হবে। এসব না করে এসব সমালোচনাকে গলাটিপে মেরে ফেলে আরেকটি অচলায়তনে পরিনত করলে সেটার ফলাফল কখনোই ভালো হবে না। ব্লগের ভবিষ্যত অনেক কিছুর উপরই নির্ভর করছে।

হাঁটি হাঁটি পায়ে পথ চলা "প্রথম আলো ব্লগের" শুভকামনা করছি। এর পেছনে যারা আছেন তাদেরও শুভকামনা।