বুধবার, ১১ মে, ২০১১

ব্লাডি ফেয়ার ডিংকুম ১৪

২টি মন্তব্য :
বিয়ের জন্য প্রচুর টাকার দরকার ছিলো। সেমিস্টার ব্রেকের ২ মাসে সময়ও ছিলো অফুরন্ত। ল্যান্ডলেডি এক রেস্টুরেন্টের ঠিকানা দিলো যেখানে গেলে কাজ পাওয়া যাবে। দূপুরে শেফের সাথে কথা বলে সন্ধ্যায় কাজে যোগ দিলাম। কাজ বলতে সেই গতানুগতিক কাজ। "এল রেন্চ" যাকে আমরা সংক্ষেপে রেন্চ বলতাম, সেই রেস্টুরেন্টে দু মাস কাজ করেছিলাম। ওদের স্পেশালিটি ছিলো "স্টেক"। দু মাসে ওদের মেন্যুতে যত রকম স্টেক ছিলো তার স্বাদ গ্রহন করবার সৌভাগ্য হয়েছিলো। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে হয়তো অতো স্টেক খাওয়াই হতো না।

দেশ থেকে ঘুরে আসবার পর এল রেন্চ এ যোগ দেবার পর হঠাৎই রেস্টুরেন্টটি বন্ধ হয়ে গেলো। রেস্টুরেন্ট বিক্রি হয়ে যাবে এ রকম একটা কথা হাওয়ায় ভাসলেও হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাবে সেটা হেড শেফও জানতো না। সন্ধ্যায় কাজে গিয়ে শুনি সেটাই তাদের শেষ রাত। ওখানে কাজ করবার সময় রিচার্ড নামে এক জার্মান-অজি শেফের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। পাগলা কিছিমের সেই শেফ মধ্যবয়সে এসে নার্সিং এ পড়া শুরু করেছিলো। শেফ হবার আগে সে ছিলো একজন রয়্যাল অস্ট্রেলিয়ান এয়ারফো্সের এয়ারক্রাফট মেইনট্যান্স ইনজিনিয়ার।
পাশের রেস্টুরেন্ট "কর্কে" লোক খুঁজছিলো। কিছু দিন সেখানে কাজও করলাম। ভালো লাগছিলো না রেস্টুরেন্টের কাজ। "কর্কের" স্পেশালিটি ছিলো "পিৎজা" । প্রাণ ভরে পিৎজা খাওয়া হয়েছিলো। রেস্টুরেন্টের মালিক ছিলেন 'লুসি' নামে এক ভদ্রমহিলা। রেস্টুরেন্ট বন্ধ হবার সময় মাঝে সাজে এক মধ্যবয়সী লোককে দেখতাম চেয়ার টেবিল গুছিয়ে রাখতে , ঝাড়ু দিতে। পরে জানতে পেরেছিলাম সেই ভদ্রলোক ছিলেন "লুসির" ২য় স্বামী , যিনি অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপিটাল টেরিটরি ল্যাজেসলেটিভ এসেমব্লির একজন এমএলএ ছিলেন লেবার পার্টি থেকে।
যে দিন লুসিকে বল্লাম যে আমি কাজ করতে চাচ্ছি না, লুসি খুব অবাক হয়েছিলো। মন খারাপ করে বলেছিলো " সবাই কাজ ছেড়ে চলে যাচ্ছে"। অনেক খারাপ লেগেছিলো কথাটা শুনে। কর্কে কাজ করবার সময় ন্যাথান নামে একজন শেফের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। সে এক বছর পড়াশুনার গ্যাপ দিয়ে পিৎজা বানানোর কাজ করছিলো। এএনইউতে ব্যবসা প্রশাসনে পড়া তুখোর ছাত্র ন্যাথানের এই কান্ড দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম যেখানে সবাই পড়াশুনা তাড়াতাড়ি শেষ করতে মরীয়া হয়ে যায়। শেষ যখন ন্যাথানের ই মেইল পাই তখন সে প্রাইস ওয়াটার হাউসে কাজ করে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ায়।
দুদিনের জন্য "লা ডলসে ভিটা" নামে একটা ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টে কাজ করেছিলাম। ওটা ছিলো অন্য একজনের বদলি। ওদের স্পেশালিটী ছিলো হোম মেইড "পাস্তা"। অসাধারন পাস্তার স্বাদ মনে হয় এখনো মুখে লেগে আছে।

এই ছিলো আমার স্বল্পস্থায়ী কিচেনহ্যান্ড ক্যারিয়ার। এখন নিজের রান্নাঘরে বউয়ের কিচেন হ্যান্ড, বিনে বেতনে 'অনারারী কিচেন হ্যান্ড '। টাকার প্রয়োজনে কাজ করেছি কিন্তু শিখেছি অনেক। দেশে শেখা মিথ্যা অহমিকা ঝেড়ে ঝুড়ে নতুন মন মানসিকতা তৈড়ি হয়েছিলো কাজ করতে করতে। সেই রকম পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার বাতিক, সময়ানুবর্তিতা , কঠোর পরিশ্রম , হড়েক রকম মানুষের সাথে মেশা ও তাদের জানা-বোঝা, কাজকে সম্মান করা, মানুষকে সম্মান করতে শেখা, ম্যানার শেখা ইত্যাদি কত যে শিখেছি যার সুফল এখন ভোগ করছি।

সারা জীবন হোস্টেলে নারী বিবর্জিত পরিবেশ বড় হওয়া আমি যখন মেয়ে ওয়েট্টেসদের সাথে মিশেছি তখন মেয়েদের নিয়ে যে অহেতুক সংকোচ ছিলো তা কখন কেটে গিয়েছিলো টেরই পাইবি। ভেবেছিলাম এখানে বর্নবাদী আচরনের শিকার হবো, এক চারমার্সে বুড়ো ইহুদি এন্ড্রুর ছাড়া কারো কাছ থেকে এরকম আচরন লক্ষ্য করিনি। নতুন দেশে গেলে সেখানকার মানুষদের কাছ থেকে না মিশলে অনেক কিছুই অজানা রয়ে যায় যা অনেক বাংলাদেশীর মাঝে লক্ষ্য করেছি, আমি শিখেছি অনেক কিছু এদের কাছ থেকে। অনেক অনেক কিছুই শিখেছি। অনেক কিছু।

সোমবার, ৯ মে, ২০১১

ব্লাডি ফেয়ার ডিংকুম ১৩

1 টি মন্তব্য :
প্রবাসে বাঙালিদের মাঝে এক অদ্ভুত প্রবনতা নিয়ে ব্লগার রাগিব হাসানের লেখা ব্লগটা বেশ মজাদার। নিজের অভিজ্ঞতার সাথে দারুন মিল খায়। আমিতো মাঝে মাঝে মজা করি বাংলাদেশের সবাই বিদেশে গিয়ে ম্যানেজার পদ ছাড়া কাজই করে না। প্রবাস জীবনে প্রথম অবস্থার সংগ্রাম মুখর সময়টুকু কেনো যেনো সবাই এড়িয়ে চলতে ভালোবাসে। হতে পারে এটা হীমনন্যতা থেকে চলে আসে, কিন্তু এটায় আমি অসততাই খুঁজে পাই। ছাত্রাবস্থায় আমরা অনেক কিছুই করেছি। কেউবা সুপার মার্কেটে কাজ করেছি, কেউ বা রেস্তোরায়, কেউ বা ক্লিনারের। বিচিত্র সব কাজকে এক কথায় "কামলা" দেয়া বলি আমরা। আমিতো বলি যতদিন না স্বাধীনভাবে কিছু করা হচ্ছে ততদিন মানুষ কামলাই, সে সাদা কলার হোক না নীল কলারেরই হোক। গোলামী গোলামীই, হয়তো পরিস্থিতি ও পরিবেশ ভিন্ন।
যাই হোক, চারমার্সে কাজ করার সময় একটা ইন্ডিয়ান রেস্তোরায় কাজ করতাম সপ্তাহে দু দিন। পোস্ট ছিলো " তান্দুরী শেফ "। আদতে সেটা ছিলো একটা সব্যসাচী চাকরী। আমিই তান্দুরী শেফ, আমিই কিচেন হ‌্যান্ড, আবার আমিই ম্যানেজার ! ঘন্টায় বেতন ভয়াবহ কম, ঘন্টায় ৮ ডলার। আক্রার বাজারে সেটাই ছিলো অনেক বড় আমার কাছে। রেস্তোরায় কোনো কাস্টমার আসলে মালিককে ফোন দিতে হতো। তারা সপরিবারে এসে রান্না বান্নার কাজ শেষ করে টাকা পয়সার হিসেব নিয়ে রেস্তোরা বন্ধ করে যেতেন। অদ্ভুত এক রেস্তোরা ছিলো সেটা।
ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের খাবার দাবারের অনেক গল্প শুনেছিলাম, চেখে দেখবার সৌভাগ্য হয়নি কখনোই। সেই ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে কাজ করবার সুবাদের নিজেই চিকেন তান্দুরী বানাতাম, সেই সাথে গরম গরম নান। মাঝে সাজে ল্যাম্ব কাটলেট, তান্দুরী প্রণ আর নানা নামের কাবাব। নিজেই সেগুলো খেতাম, কি আর করা কাস্টমার নেই ! অবশ্য মালিকের অনুমুতিও নিয়ে নিয়েছি সব সময়। ফিজিয়ান ইন্ডিয়ান মালিকও আপত্তি করতো না। রেস্তোরা দেখে শুনে রাখছি, এতো কম বেতনে সেও লোক পাচ্ছে কাজ করাবার, একটু আধটু খেতে চাইলে সে হাসি মুখেই অনুমুতি দিয়ে দিতো।

কাজের শুরুতেই তান্দুরীতে কয়লা দিয়ে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দিতে হতো। এর পরে সব গুছিয়ে রাখতে হতো কিচেনে। আমার কাজ ছিলো মুলত তান্দুরী কেন্দ্রীক। সপ্তাহে একদিন একজন পেশাদার ভারতীয় শেফ এসে নান রুটির ডো, সিংগাড়া যাকে ভারতীয়রা সামুচা বলে,সব রকমের সস, মাংস গুলো আধা রান্না করে যেতেন। সপ্তাহের বাকি সময়টুকু সেই আধা রাঁধা মাংসের সাথে সস মিশিয়ে কাস্টমারদের সার্ভ করা হতো। রান্না বান্নার এ কাজটি মালিক বা মালিকের বউই করতেন। ভারতীয় রেস্তোরায় এটা একটা খুবই প্রচলিত ব্যপার। যেমন বাটার চিকেন সস, কোরমা সস, রোগেন জশ সস ইত্যাদি সস বানিয়ে রাখা হতো বড় বড় কনটেইনারে। কাস্টমার ল্যাম্ব রোগেন জশ চাইলে রোগেন জশ সসের সাথে আধা রান্না করা ল্যাম্ব মিশিয়ে সস প্যানে চড়িয়ে দেয়া হতো, সাথে তাজা কাটা পেঁয়াজ , ধনে পাতা কুচি আর সামান্য কিছু তাজা মশলা। আবার বিফ রোগেন জশ চাইলে ল্যাম্বের বদলে বিফ। কোরমার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এভাবেই একই সস দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন নামের আইটেম চালিয়ে দেয়া হয় ভারতীয় রেস্তোরা গুলোতে।
প্রথম প্রথম তান্দুরীতে নান বানানো বেশ ভয়ংকর ব্যপার হলেও সময়ে সেটা ঠিক হয়ে যায়। প্রথম দিনে প্রচন্ড গরম তান্দুরীতে হাত ডুকিয়ে নান বানানোর সময় ডান হাতে পোড়া দাগগুলো এখনো আছে। তান্দুরীতে অন্যান্য কিছু বানানোর সময়ও বেশ সাবধান থাকতে হয়, নচেৎ একটু দেরী হলেই পুড়ে যেতে পারে সব কিছু। একটা বিশাল কড়াইয়ে গরম তেলে সামুচা,পাকোড়া, পাপাদাম যাকে আমরা পাপড় বলি ভাজা হতো। আমি সেখানে মাঝে মাঝে নান ভাজতাম। প্রচন্ড গরমে এক নিমিশে পুরির মতো ফুলে উঠবার পরপরই নামিয়ে ফেলতে হতো। মালিক এটা দেখে আরেকটা নতুন আইটেম যোগ করে দিয়েছিলো মেন্যুতে।

এই রেস্তোরায় কাজ করবার সময় একটা বাজে ব্যপার লক্ষ্য করেছি যা শুনেছি অন্য অনেক ভারতীয় রেস্তোরাতেই হয়ে থাকে। কাস্টমার হয়তো ৩ খানা সামুচার অর্ডার দিয়ে ২ খান কেলেন, বাকি সেই সামুচা ফেরত আসার পর মালিক সেটা রেখে দিতেন আরেক কাস্টমারের জন্য। অজি রেস্তোরা হলে এঁটো কোনো খাবার সোজা বিনে চলে যেতো। এ জিনিসটা অনেক বারই লক্ষ্য করেছি আমি এদের করতে।

কাজের শুরুতেই আমি বলে দিয়েছিলাম আমি হিন্দি জানি না। এটা বলার কারন হলো যদি তারা জানে আমি হিন্দি পারি ও বুঝি তবে আমার সাথে হিন্দিতেই কথা বলা শুরু করবে যা একটা অত্যাচারের সমান আমার কাছে। হিন্দি জানি না জানতে পেরে তারা আমার সামনে অনেক ব্যক্তিগত আলাপ করতো যা আমি বুঝতে পারলেও না বোঝার ভান করে থাকতাম। একবার কোনো এক কথার উত্তরে হিন্দিতে উত্তর দেয়ার পর তারা এতো অবাক হয়েছিলো যে আমার কাছেই খারাপ লেগেছিলো ব্যাপারটা।

ভারতীয় রেস্তোরার মালিকদের মাঝে খারাপ ব্যবহার করার দূর্নাম আছে খুব প্রকট ভাবে। আমি ভাগ্যবান যে সেই রেস্তোরার মালিক অসাধারন ভালো ব্যবহার করতেন আমার সাথে যা এখনো মনে আছে। আরেকটা জিনিস শিখেছিলাম সেখানে, সেটা হলো মুরগি কাটা ! "মহা রাজা'স ‌প্যালেস" নামে সেই রেস্টুরেন্টে কাজ করে আমি শিখেছিলাম কিভাবে, নান বানাতে হয়, কিভাবে তান্দুরী কিচেন - ল্যাম্ব কাটলেট - তান্দুরী প্ণ - হড়েক রকম কাবাব বানাতে হয়। সেই সাথে দারুন সব উত্তর ভারতীয় খাবার। মাঝে সাজেই আমরা সবাই মিলে এক টেবিলে বসে রাতের খাবার খেতাম যা ভারতীয় মালিকদের কাছে আশা করা বেশ কস্টকর।

একদিন সেই রেস্টুরেন্টের পাশে বিশাল এক কনটেইনার পড়ে থাকতে দেখে মালিককে জিজ্ঞেস করাতে বল্লেন উনার এক বন্ধু কিছু জিনিস রেখেছেন সেটায়। আগের পর্বে বলেছিলাম যে সিডনী বেড়াতে গিয়ে ‌ক্যানবেরায় ফেরত এসে চারমার্সের বেকার হবার কাহিনী। ক্যানবেরা এসে আবিস্কার করলাম "মহা রাজা'স প্যালেস" বিক্রি হয়ে গিয়েছে, যা মালিক ইচ্ছে করেই গোপন রেখেছিলাম আমার কাছে।

চারমার্সে চাকরী নেই, ভারতীয় রেস্তোরাও বিক্রি হয়ে গিয়েছে। পুরোদস্তর বেকার আমি তখন। হাতে টাকাও নেই। কি যে করি, ভয়াবহ অবস্থা তখন আমার।

শনিবার, ৭ মে, ২০১১

ব্লাডি ফেয়ার ডিংকুম ১২

২টি মন্তব্য :
চারমার্সে কাজ শুরু করবার দিনটার কথা এখনো মনে আছে। প্রবাস জীবনের প্রথম চাকুরি। অনেকে হয়তো অডজব / প্রপার জব বলে চিন্তিত হতে পারেন তবে আমার কাছে সবগুলোই চাকুরি। দূপুরে ইন্টারভিউ দেবার পর থেকেই মনে হচ্ছিলো কখন সন্ধ্যে আসবে আর কখন কাজ শুরু করবো। পকেট ছিলো গড়ের মাঠ। "ক্যাশ ইন হ্যান্ডে" এ কাজটা ছিলো আমার কাছে চৈত্রের প্রচন্ড দাবদাহে এক পশলা বৃস্টির মতোই আশির্বাদ।
সন্ধ্যা ৫ টার আগেই হাজির হলাম কিচেনে। ছোট্ট এক কিচেনের এক কোনায় আমার আপিস, থুক্কু ডিশ ওয়াশিং মেশিন। "ক্লোভার" নামের এক মেয়ে আমাকে দেখিয়ে দিলো কি করতে হবে। কাজ বলতে কাস্টমারের রেখে যাওয়া প্লেট-গ্লাস ডিশ ওয়াশারে দিয়ে পরিস্কার করা, ধোয়া শেষ হলে পরিস্কার তোয়ালে দ্বারা মোছা, শেফের হাড়ি পাতিল ধোয়া এবং পেছনের শেলফ ও ফ্রিজারে স্টক সাজিয়ে রাখা আর সব কিছু শেষ হলে কিচেন পরিস্কার তকতকে করে রাখা। ডিশ ওয়াশারটা ছিলো আদিম কালের। রেস্টুরেন্ট মালিক পোলিশ মাইগ্রেন্ট এন্ড্রু যে বছর অস্ট্রেলিয়া এসেছিলো সেই ষাটের দশকে কেনা বলে সবাই হাসাহাসি করতো। কিছু ক্ষন কর পরই তাতে গরম পানি দিতে হতো, নাহলে সেটা পুড়ে যাবে !

কাজের শুরুতেই স্যুট থুক্কু এপ্রোন পড়িয়ে দিলো ক্লোভার। লান্চ শিফটের কিচেন হ্যান্ড এক গাদা ডিশ রেখে গিয়েছিলো আমার জন্য। সেগুলো ধুয়ে শেষ করতে না করতেই ডিনারে আসা কাস্টমারদের ডিশ আসা শুরু করলো, সাথে শেফের দেয়া ফ্রায়িং প্যান ও সস প্যানতো আছেই। সব কিছু শেষ করে যখন ঘড়ির দিকে তাকালাম তখন দশটা বাজতে ৫ মিনিট বাকি। ক্লোভার ক্যাশ থেকে ৫০ ডলার বের করে হাতে দিতেই অন্যরকম এক অনুভূতি ছিলো। অনেক দিন টাকার অভাবে সিগারেট খাওয়া হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার জীবনের প্রথম উপার্জনে এক প্যাকেট ডানহিল ব্লু কিনলাম। কি যে অপার্থবি শান্তি লেগেছিলো তা বলে বোঝানো যাবে না।

পরের দিন মালিক এন্ড্রুর সাথে দেখা হলো। সে বল্লো পেছনের কড়িডোর ভালো ভাবে ঝাড়ু দিয়ে ও পানি ঢেলে ভালো ভাবে পরিস্কার করতে। সে বল্লো এটা নাকি আমাকে প্রতিদিনই করতে হবে। করলাম পরিস্কার ভালো ভাবে। সে এতেও সন্তুস্ট হতে পারে না। দিনের পর দিন পরিস্কার না করা করিডোর পরিস্কার করা যে ঝামেলার সেটা তাকে বোঝানোর সাহস হয়নি। কিছু দিন পর সে বল্লো গেস্ট টয়লেটের দিকে লক্ষ্য রাখতে। মাঝে মাঝে সময়করে সেটাও নাকি আমাকে পরিস্কার করতে হবে !

মন প্রাণ দিয়ে কাজ করেছি সেখানে। সব সময়ই ভয় ছিলো এই বুঝি চাকুরি চলে যাবে। চলেও গিয়েছিলো হঠাৎই। সে কথায় পরে আসছি। ইংরেজী মোটামুটি ভালো হলেও ওখানে ওদের কথা বুঝতে অনেক সময়ই খুব সমস্যা হতো। ওরা একটা বলতো আর আমি বুঝতাম আরেকটা। ভাবতাম ওরা বুঝি হাসাহাসি করবে এটা নিয়ে। কিন্তু তা না করে ওরা আমাকে বুঝিয়ে বলতো, অনেক সময়ই ধীরে ধীরে বলতো যাতে আমি বুঝতে পারি। কাজ শুরু হতেই ওয়েট্টেস মেয়েরা এসে জিজ্ঞেস করতো কি খেতে চাই। শুরুতেই কফি বা কোক দিয়ে যেতো, কাজের ফাঁকে এসে বলতো আর কি চাই বা কোনো সাহায্য দরকার কি না। দেশে আমরা ধন্যবাদ জানাতে চাই না, দূঃখিত হতে জানি না ভুল করলে। ওখানেই শিখেছি কিভাবে ধন্যবাদ জানাতে হয়, দূঃখ প্রকাশ করতে হয়, অনুরোধ করবার সময় "প্লিজ: বলতে হয়। ক্লোভার ছাড়া আর কারো নাম মনে নেই। এএনইউ এ পড়া একটা মেয়ের কথা মনে আছে। কি মায়া ভরে জিজ্ঞেস করতো কি কফি খেতে চাই। নাম ভুলে যাওয়া এক ওয়েটারের কাজই ছিলো নিজের জন্য শর্ট ব্লাক বানানো আর আমার জন্য একটু নিয়ে আসা। অজি মানুষদের সাথে কাজ করে কাছ থেকে দেখে এদেশের সংস্কৃতি - মননকে যে চেনায় ছিলাম তার প্রভাব এখনো আছে আমার মাঝে।

স্যু ছাড়াও আরো দুই মহিলা ও আরেক ছেলে শেফ কাজ করতো চারমার্সে। ইজিপশিয়ান মহিলার কথা মনে আছে এখনো। উনি তার প্রথম জীবনের গল্প বলতেন কাজের ফাঁকে ফাঁকে। কিভাবে একজন কোয়ালিফায়েড নার্স হয়ে উনি কিচেন হ্যান্ডের কাজ করতেন, কিভাবে উনার ম্যাকানিক্যাল ইন্জিনিয়ার স্বামী ক্লিনারের কাজ করতেন। বছরের পর বছর সংগ্রামের পর উনি যখন ক্যালভারী হাসপাতালের রিটায়ার্ড নার্সিং ম্যানেজার বা উনার স্বামী স্নোয়ী যখন মাউন্টেইন হাইড্রো ইলেকট্রিক প্লান্টের কনসালট্যান্ট ইন্জিনিয়ার সেই গল্প করে বলতেন আমাকেও কস্ট করতে। সময়ে সবকিছুই উন্নতি হয় , আমারো হবে এটা বলে মনে সাহস দিতেন। চিলিয়ান আরেক মহিলার সাথে দু একবার কাজ করেছিলাম। এন্ডু না থাকলে সে এক গাদা রান্না বান্না করতো নিজের বাসায় নিয়ে যাবার জন্য, আমাকেও ঘুষ সাধতো যাতে আমি কাউকে না বলি। পিটার নামে যে ছেলে শেফ ছিলো সে ছিলো পুরোদস্তর বর্নবাদী। তার সাথে এক রাত কাজ করেই সু'কে বলেছিলা যে আমি পিটার এর সাথে কাজ করতে চাই না।

চারমার্সে কাজ করতে করতে রান্না শিখে গিয়েছিলা, করতে করতে না; দেখতে দেখতে। হড়েক রকম আইটেম যার নাম শোনাতো দূরের কথা চোখেও দেখিনি। আগেই বলেছি অনেক মন প্রান দিয়ে কাজ করতাম। এক সময় দেখা গেলো ৫ ঘন্টার শিফটে যে কাজ করতে হয় সেটা আমি ৪ ঘন্টাতেই শেষ করে ফেলি। এন্ড্রু এসে বল্লো এখন থেকে শিফট ৪ ঘন্টার হবে, টাকাও পাবো ৪ ঘন্টার। ব্যস্ত শিফটে আমি ৪ ঘন্টার টাকা পেতাম, তুলনামুললক ভাবে হালকা শিফটে কাজ করে অন্যরা পেতো ৫ কি সাড়ে ৫ ঘন্টার টাকা।

একবার সিডনী বেড়াতে গেলাম। বেড়িয়ে এসে রোস্টার চেক করতে গিয়ে দেখি আমার নাম নাই। সউ'কে জিজ্ঞেস করাতে সে বল্লো আমার কাজ ভালো না তাই আমি ছাঁটাই। কদিন বাদে বাসে ইজিপশিয়ান শেফের সাথে দেখা হলে উনি বলেছিলেন , সু তার নাতিকে চাকরি দেবার জন্য আমাকে বাদ দিয়েছিলেন।

হঠাৎই বেকার হয়ে গেলাম

(চলবে)

বুধবার, ৪ মে, ২০১১

খুনির চেহারা দেখি

কোন মন্তব্য নেই :
নিজস্ব প্রাতিস্ঠানিক পেশার পাশাপাশি একটা ৪.৫ তারকা হোটেলে রাতের পালা দেখাশোনা করার চাকরি করি। এখানে কাজ করতে ভালো লাগে, হড়েক রকম মানুষের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়, হাতে বাড়তি কিছু টাকাও আসে। কাজের সূত্রে মন্ত্রি থেকে শুরু করে রাজমিস্ত্রি সবার সাথেই ডিল করতে হয়। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা জমে নিজ ভান্ডারে। এসব নিয়ে লিখতে গেলে বলা যায় প্রায় প্রতি রাতেই একটা করে ব্লগ লেখা যাবে।

২৫শে এপ্রিল অস্ট্রেলিয়ায় এনজ্যাক ডে পালন করা হয়। বরাবরের মতো আমার হোটেলেও একদল ভেটার্ন উঠেছিলো। এনজ্যাক ডে প্যারেডে অংশ নিতে আসেন , সাথে পূর্নমিলনী। একদল মধ্যবয়স্ক ও বৃদ্ধ মানুষ। হাসি খুশী ফুর্তিবাজ একদল লোক নিজেদের বয়স ভুলে মেতে উঠেন শিশুসুলভ আচরনে। দেখে মনেই হয় না এরাই একসময় হাতে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পরেছিলো ভিয়েতনামের মতো অন্যায় একটা যুদ্ধে, এদের হাতেই মারা গিয়েছিলো অসংখ্য নিরোপরাধ ভিয়েতনামীজ। হয়তো এদের মাঝেই কেউ হয়তো ঠান্ডা মাথায় কোনো ভিয়েতনামীজ শিশুকে হাসতে হাসতে গুলি করে তার মাকে নিয়ে মেতে উঠেছিলো ধর্ষনে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে এদের প্রশ্ন করা বিপদজনক। অনেকেই স্বাভাবিক ভাবে নেয় না। একজনকে প্রশ্ন করেছিলাম কেনোইবা সে সেই যুদ্ধে গিয়েছিলো, তার উত্তর ছিলো তারা বাধ্য ছিলো যুদ্ধে যেতে। সে যুদ্ধের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন করা আরো বিপদজনক। এরকম এক প্রশ্নের উত্তরে বর্নবাদী বাক্য যেমন শুনতে হয়েছিলো তেমন একজনের কাছ থেকে শুনেছিলাম তার যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের কথা। বৃদ্ধ মানুষটি কাঁপতে কাঁপতে বলেছিলেন ' রাতে তার এখনো ঘুম হয় না'। বিবেকের তাড়নার কথা মনে হয় বলতে চাননি।

২৭ এপ্রিল যখন তারা চলে যায় তখন তাকিয়ে দেখছিলাম একদল মানুষকে যাদের মাঝে লুকিয়ে আছে খুনির প্রেতাত্মা। নিস্পাপ হাসির মাঝে লুকিয়ে হাসছে খুনির হাসি। হ্যান্ড শেক করে বিদায় নেবার পর সিংকে হাত ধুতে ধুতে মনে হচ্ছিলো এরাও কারো পিতা - এরাও কারো প্রিয় জন, আবার এরাই কারো হত্যাকারী। হাত ধোয়া যায় কিন্তু এসব মন থেকে মুছতে পারা যায় না। জীবনে পেশাগত কারনে কত কিছুই যে করতে হয়।

সে দিন একদল খুনিকে দেখেছিলাম।

সোমবার, ২ মে, ২০১১

অসহ্য ১১টি ঘন্টা

৩টি মন্তব্য :
হঠাৎই বুকের ব্যথা। ছোটো ছেলেটাকে নিয়ে ঘরে পায়চারী করবার সময় হঠাৎই ব্যথা। বুঝে উঠতে পারছিলাম না কেনো। তেমন কিছু না ভেবেই সাবধানের মার নেই ভেবে হাসপাতালে গেলাম। হাসপাতালের জরুরী বিভাগে গিয়ে বুকের ব্যথা বলতেই সোজা হুইল চেয়ারে তুলে দিলো। যতই বলি হেঁটে যেতে পারবো ততই সেবিকা বলে তাদের প্রটোকল মেইনটেইন করতে হবে। হুইল চেয়ারে বসিয়ে ভেতরের বিছানায় শুইয়ে ইসিজি করলো, তড়িঘড়ি করে রক্ত নিয়ে পরীক্ষাও করতে দিলো। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে খুব সম্ভবত ইন্জেকশনও দিয়েছিলো একটা। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েচিলাম টেরই পাইনি।

৩ ঘন্টা পর পাশের ওয়ার্ডে নিয়ে গিয়েছিলো। ঘুম অবশ্য ভেঙে গিয়েছিলো তার আগেই। বিছানায় শুইয়ে এক ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে নিয়ে যাবার সময় নিজেকে রোগী ভাবতে ভালো লাগছিলো না। ঘন্টায় ঘন্টায় এসে এটা ওটা চেক করছিলো সেবিকারা। মাঝ খানে ওয়ার্ড ক্লার্ক বালিকা এসে ঠিকুজি নিতে ভুলেনি, এখানেও অর্থ। বুকের মাঝে এক গাদা তার লাগানো - মনিটরের টিক টিক শব্দে বড্ড অসহায় লাগছিলো। মাঝে খানে ডিনারে অখাদ্যও গিলতে হয়েছিলো। মশলাহীন- লবনহীন খাবার খেতে খেতে মনে হচ্ছিলো কতকাল ভাত খাই না।

কিছুক্ষন পর পর বাসা থেকে ফোন আসছিলো। উদ্বীগ্ন সহধর্মীনির ফোন পেয়ে যেমন ভালো লাগছিলো তেমনি নিজেকে বড্ড একা লাগছিলো। চারপাশে আমার মতোই এক গাদা অপরিচিত মানুষ শুয়ে আছে; জীবন - মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে যুথরত একদল মানুষ। রাত ১০ টার দিকে এক্স রে করালো। রাত ১২ টা নাগাদ আরেক দফা ইসিজি করা হলো, সাথে রক্ত নেয়া। ঘন্টা দেড়েক পর ডাক্তার এসে বল্লো বড় কোনো সমস্যা নেই। বাসা চলে যেতে পারবো। সাবধানে থাকতে বল্লেন ডাক্তার। ওজন কমাতে হবে। বিড়ি টানা বন্ধ করতে হবে, হাবিজাবী খাওয়া বাদ দিতে হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি । ডাক্তার বল্লেন কে নিতে আসবে আমাকে। আমি বল্লাম, এই শহরে এই মধ্যরাতে নিতে আসবার মতো কেউ নেই আমার। নিজেকই ড্রাইভ করে চলে যেতে হবে।

হৃদযন্ত্রের অবস্থা সবসময়ই ভালো ছিলো, এখনো আছে।তারপরো সাবধান থাকতে হবে। মাঝে মাঝে কেনো জানি মনে হচ্ছে বুকের মাঝে চিন চিন ব্যথা। ইসিজি ধরতে না পারলেও আমি ধরতে পারি। নিজের জন্যই বাঁচতে হবে, নিজের প্রিয় জনের জন্য বাঁচতে হবে। বড্ড কঠিন এ পৃথিবীতে ক্লান্ত এই মানুষটি বাঁচতে চায়।