সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০০৮

গাজার প্রতিটি মৃত্যু যখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়

1 টি মন্তব্য :
 
ছবি সত্বঃ বিবিসি
দেশের সংবাদপত্রগুলো যখন নির্বাচন নিয়ে মহাব্যস্ত তখন প্যালেস্টাইনের গনহত্যা অনেকের চোখকে এরিয়ে যাচ্ছে ইচ্ছে করেই, কিন্তু মানুষের বিবেকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে নোংরা রাজনীতির কাছে মানবতা কতটুকু অসহায়।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ২৭৫, যা ক্রমাগত বাড়ছেই। টিভির খবরে নিহত-আহত মানুষ নিয়ে অসহায় ছুটোছুটির ফাঁকে আকাশ থেকে ধেয়ে আসছে মৃত্যুবান। মানবতা সেখানে অসহায় - শান্তির বাণী সেখানে অদৃশ্য -ধর্মের বাণী যেখানে অচ্যুত।

গাজার এই মানুষগুলো কি আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো শান্তিতে বাঁচতে চায়নি ?
নৈতিকতারর কোন মানদন্ডে এই হত্যাকে সমর্থন করা যায় ?
আইনের কোন দৃস্টিকোনে এ হত্যাযগ্যকে সমর্থন করা যায় ?
এ গনহত্যা কি আসলেই প্রয়োজনীয় ছিলো ?
সীমান্তের এপার-ওপারের সাধারন মানুষ কি এ হত্যা- সন্ত্রাসকে সমর্থন করে ?



এইসব প্রশ্নের উত্তর কখনোই পাওয়া যাবে না, যায় না। নোংরা ক্ষুদ্র রাজনীতি, যুদ্ধকৌশল, নিরাপত্তা ও সীমান্ত প্রতিরক্ষা, রাষ্ট্রনীতি এবং একই সাথে সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিবেচনার উপরে নির্ভর করে এইসব প্রশ্নের উত্তর। তবুও উত্তর মেলে না।





 ছবি সত্বঃ বিবিসি

শান্তির মা আজ মৃত। ইশ্বর আজ বধির-মৌন।

গাজার এই সব মানুষগুলোর জন্য সমবেদনার সাথে সাথে সৌহার্দ পোষন করছি। এ চরম অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাই। প্রতিরোধের সাথে সহমর্মিতা জানাই প্রতিটি মুহুর্তে।

শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০০৮

নিদারুন কস্টের এক গল্প

কোন মন্তব্য নেই :
নাম করনে গল্প হলেও পৃথিবীর কোনো এক অংশে অভিনীত এক নাটকের ছোট্ট একটি অংশ এটি। জীবনের চলার পথে জনৈক বন্ধুর কাছ হতে শোনা ঘটনাটি শুনতে শুনতে ভাবছিলাম এমনোও কি হয় !

জীবনে কতো কিছুই না ঘটে। কিছু ঘটনা হয়তো স্মৃতি হতে ধীরে ধীরে মুছে যায় , কিছু স্মৃতি মনের গহীন অতলে ঠিকই ধিকি ধিকি করে জ্বলতে থাকে। গল্পটি না হয় সেই বন্ধুর মুখ থেকেই শোনা যাক।

" সারা রাত কাজ শেষে বাসায় যখন এসেছিলাম ঘড়িতে তখন ভোর ৪ টা। প্রচন্ড ক্লান্ত, ততোধিক ভয়াবহ খিদে। দু প্যাকেট নুডুলস সেদ্ধ করে তাতে সামান্য কিছু মিক্সড ভেজি মিশিয়ে ঘুমুতে যাবার সময় ঘড়িতে এলার্ম সেট করতে ভুলিনি। সকালে দূর শহর হতে আমাকে দেখতে আসবে। এতোদিন জানতাম মেয়েদেরই দেখতে আসে, এখন ছেলেদেরও দেখতে আসে। মেয়েদের যদি আনুস্ঠানিক/অনানুস্ঠিক ভাবে দেখতে যাওয়া যায় তবে ছেলেদের ব্যপারে কেনোইবা তার ব্যতিক্রম হবে ?

প্রচন্ড টেনশন হচ্ছিলো। সুন্দর কাপড় পড়তে হবে, ভালো করে নিজেকে তাদের সামনে উপস্থাপিত হতে হবে। আচ্ছা কি ভাবে কথা বল্লে তারা ইমপ্রেসড হবেন ! ইত্যাদি নানান সব ভাবনা। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টেরই পাইনি।

মোবাইলের রিঙের শব্দে ঘুম যখন ভাঙলো তখন ঘড়ির কাঁটা কোন ঘরে ছিলো সেটাও মনে নেই। আজকালকার ডিজিটাল ঘড়িতে অবশ্য কাঁটার বদলে সংখ্যা ভাসে। অচেনা নাম্বার থেকে ঘুম জড়ানো গলায় হ্যালো বলতেই শুনতে পেলাম উনারা আর মাত্র ১ ঘন্টার দূরত্বে রয়েছেন। ক্লান্ত শরীরে এটা শোনার পরও আবার কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। ঘুম যখন ভাঙলো তখন দড়জায় উনারা দাঁড়িয়ে। গরীবের ভাঙা কুটির দেখে আশাহত যে হয়েছিলেন সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। চা এর কথা বলতেই উনারা বল্লেন বাহিরে কোথায় খেতে খেতেই না হয় আলাপ সারা যাবে।

পকেটে একাউন্ট নিংরে বের করা সবটুকু টাকা নিয়ে রেস্টুরেন্ট গিয়ে ভাবছিলাম কি কথা হবে। মানুষের চোখ নাকি অনেক কিছু বলে দেয়। আমি তাদের চোখ পড়বার চেস্টা করছিলাম। চেস্টা করছিলাম তাদের গলার স্বর থেকে মনের ভাব বোঝার। আপ্রান চেস্টা ছিলো তাদের সন্তুস্ট করবার। কত কিছু ভেবে রেখেছিলাম। কিছুই জানতে চাইলেন না। কথায় দায়সারা ভাব, যেনো ইন্টারভিউ বোর্ডে আগেই সিলেক্ট করা প্রার্থীকে চাকুরি দেবার জন্য অন্য সব প্রার্থীকে অবান্তর অপ্রাসংগিক সব প্রশ্ন করা।"

তার পর কি হলো বস ?

" কি আর হবে, সব কিছু শেষে উনারা আমাকে নামিয়ে চলে গেলেন। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম উনাদের গাড়ি আস্তে আস্তে ধীরে দূরে হারিয়ে যাচ্ছে।"

তার পর?

" তারপর আর কি, জীবন জীবনের মতো চলতে থাকে। স্বপ্ন দূস্বপ্নে পরিনত হলো। এক সময় সব কিছুই স্বাভাবিক হয়ে এলো তবুও সে সব ঘটনা ভুলতে পারি না। মাঝে মাঝে শেখ সাদির সেই গল্পের কথা মনে পরে; পোষাক দিয়ে মানুষ যাচাই। টাকা দিয়ে মানুষ যাচাই, চেহারা দিয়ে মানুষ যাচাই। অথচ কেউই মানুষের ভেতরটাকে দেখতে চায় না, জানতে চায় না, বুঝতে চায় না। "

তার পর ?

"জীবনতো আর থেমে থাকে না। ভালো আছি, সুখে আছি, শান্তিতে আছি । সে সময় সব কিছুই বুজতে পেরেছিলাম, প্রসন্ড কস্স্ট লাগছিলো কিন্তু সবসময় জানতে ইচ্ছে হয় ঠিক কি কারনে উনারা আমাকে অপছন্দ করেছিলেন।"

টেলিফোনে হাজার মাইল দূর থেকেও উনার দীর্ঘনিঃশ্বাষ শুনতে পাচ্ছিলাম। জীবনটা আসলেই বড্ড বিচিত্র। বিশাল এক নাট্য মন্চ, আমরা যার যার ভুমিকায় অভিনয় করে যাচ্ছি সুনিপুন ভাবে।

শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০০৮

মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও - ১.৭ শেষ ( একটি কথ্য ইতিহাস)

কোন মন্তব্য নেই :
প্র: আপনি ১৫ এপ্রিল ঠাকুরগাঁওয়ের পতন হয় বলেছেন। পুনরায় রি-অরগানাইজ হয়ে কবে থেকে আপনারা যুদ্ধ শুরু করলেন ?
উ: এরপর তো ভারতে গিয়ে আমরা পুনরায় সংগঠিত হতে লাগলাম। ভারতে এসে যোগাযোগ করতে করতেই তো এক মাস সময় লেগে গেলো। মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর আমরা দ্রুত সংগঠিত হতে শুরু করলাম। আমার মনে আছে, আমরা ছোট্ট একটা ঘরে ১৬ জন ঘুমিয়ে ছিলাম। চিৎ হয়ে শুলে চার আনা আর কাত হয়ে শুলে দুই আনা-এ রকম একটা অবস্থানে ছিলো সে সময়। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়ে আমরা পুনরায় অপারেশন শুরু করতে পেরেছিলাম সম্ভবত: জুন মাস থেকে।

প্র: মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের মানুষের ধারণা কেমন ছিলো ?
উ: মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে জনগণের ধারণা ভালো ছিলো বলেই তো দেশটা স্বাধীন হতে পেরেছে। মুক্তিযোদ্ধারা যখনই যে জায়গায় বা এলাকায় ঢুকেছে, তখনই সেই এলাকায় তারা আশ্রয় পেয়েছে। স্থানেনীয় জনগণ যদি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় না দিতো, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ কখনই এই পর্যায়ে শেষ হতে পারতো না। মুক্তিযোদ্ধারা যে সমস্ত জায়গায় পাক আর্মিদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিলো বা ব্রিজ-কালভার্ট ধ্বংস করেছিলো তার প্রত্যেকটাই স্থানেনীয় জনগণের সাহায্য সহযোগিতায় তারা করেছিলো। মুক্তিযোদ্ধারা সাধারণভাবে রাতে ঘুরে বেড়াতো। কারণ পাকিস্তানআর্মি গ্রামগঞ্জের কোথাও রাতের বেলা বেরুতো না। স্থানেনীয় জনগণের কারণেই আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা, খাওয়া বা ঘুরে বেড়ানোর কোনো অসুবিধা হয়নি।

প্র: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কি আপনি peoples war বলে মনে করেন ?
উ: অবশ্যই।

প্র: কিভাবে ?
উ: পূর্ব পাকিস্তানের আম-জনতা অনেকদিন যাবতই পাকিস্তান সরকারের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলো। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ থেকে তারা যে অর্থ শোষণ করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাচ্ছিলো সেই সম্পর্কে ক্ষোভ অনেকদিন থেকেই মানুষের মনে দানা বাঁধছিলো। এই ক্ষোভটা রাতারাতি সৃষ্টি হয়নি। এর পিছনে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের যথেষ্ট অবদান ছিলো। আওয়ামী লীগের ৬ দফা, ১১ দফা এগুলো বাংলাদেশের জনগণের প্রাণের দাবি ছিলো এবং শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী যখন হামলা চালালো তখন অন্য কোনো রাস্তা না দেখে তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। কেউ অস্ত্র হাতে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ করেছে আবার কেউ পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছে, সহযোগিতা করেছে, আশ্রয় দিয়েছে। যারা ভারতে গিয়েছিলো তারাও যুদ্ধের অংশীদার। কারণ তারা নিজেদের বাড়িঘর সহায় সম্পদ সব কিছু ছেড়ে বিদেশে রিলিফ ক্যাম্পে ছিলো। এটাও যুদ্ধের একটা অংশ। যারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছিলো, পাকিস্তানি আর্মির অত্যাচার সহ্য করেছিলো এবং তারপরও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলো- এটাও যুদ্ধের একটা অংশ। সর্বোপরি ১৯৭০ সালে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত মুজিবনগর সরকারই এ যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। সুতরাং এই যুদ্ধকে আমি peoples war বলেই মনে করি।

প্র: আমরা লক্ষ্য করেছি যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিবাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক হারেই অত্যাচার করেছে। আপনার এলাকায়ও কি এ রকম ঘটনা ঘটেছে ?
উ: আমার এলাকায় এ রকম তেমন ঘটনা ঘটেনি। এ কথা আমি বলতে পারি এই কারণে যে, আমার এলাকার তিন দিকেই ভারতীয় বর্ডার খুব কাছাকাছি ছিলো। প্রথম অবস্থানেতে যারা ভারতে চলে গিয়েছিলো তাদের বেশির ভাগই ছিলো হিন্দু। ফলে, হিন্দুদেরকে তারা খুব একটা পায়নি। প্রত্যেকটা এলাকা থেকে হিন্দুরা সব চলে গিয়েছিলো। ফলে, পাকিস্তানিরা আলাদা করে হিন্দুদের উপর অত্যাচার করার সুযোগ পায়নি। তবে কোনো কোনো এলাকায় সীমিতসংখ্যক মাইনোরিটি থাকলেও থাকতে পারে। তবে উল্লেখযোগ্য নয়। জাতিভাঙ্গাতে যে হিন্দুদের হত্যা করা হয়েছিলো সেটা পাক আর্মি করেনি। রাজাকার, বিহারী আর আল-বদর-রা এ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলো। ওখানে পাক আর্মির কোনো অংশ গ্রহণ ছিলো না।

প্র: স্বাধীনতার ৩২ বছর পর একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ণ করবেন ?
উ: আমার মনে হয়, পাকিস্তান আমলের মাঝামাঝি সময় থেকে শেষ দিন পর্যন্ত এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের পরেও নেতৃবর্গ এবং আমরা যারা বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলাম, আমরা যে মন-মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ ছিলাম, সেই মন মানসিকতা, চিন্তাধারা এখন এতোটাই নিচে নেমে গেছে যে, আজকে আমার সামনে হতাশা ছাড়া আর কিছু নেই। এমন বাংলাদেশ আমরা চাইনি। হিন্দু সমঙ্রদায়ের একজন সদস্য হিসাবে আমি বিশেষভাবে বলতে চাই যে, পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিলো দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। কায়দে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তখন বলেছিলেন যে,Muslims of India should have a separate state for their own cultural tradition. কিন্তু পাকিস্তান অর্জনের পর সেই কায়দে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বুঝতে পারলেন যে, রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে ধর্মকে প্রাধান্য দিলে সেই রাষ্ট্র চলতে পারে না। এই জন্যই পরবর্তীতে এক কনফারেন্সে তিনি বলেছিলেন, ধর্ম হিসাবে কোনো নাগরিককে বিচার করা হবে না, এ দেশের একজন নাগরিক হিসাবেই বিবেচনা করা হবে। এই ঘটনার ঠিক উল্টোটা ঘটে আমাদের দেশে। দেশটা স্বাধীন হওয়ার আগে চারটি স্বীকৃত রাজনৈতিক দাবি আমাদের ছিলো-১. গণতন্ত্র, ২. জাতীয়তাবাদ, ৩. ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ৪. সমাজতন্ত্র। স্বাধীনতার পর আমরা যারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছিলাম, আমাদের কাছে মূল বিষয়টা ছিলো ধর্মনিরপেক্ষতা। কারণ ধর্মের কারণে পাকিস্তান আমলে আমরা নিজেদেরকে প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে দেখতে পেতাম না। আমাদের অনেক আশা ছিলো যে, পাকিস্তানের হাত থেকে যদি দেশটা স্বাধীন হয় তাহলে সেই দেশটা হবে প্রকৃতপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ এবং আমি সংখ্যালঘু বলে আমাকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে ভাবতে হবে না। আর এ কারণেই আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। কিন্তুদেশটা স্বাধীন হওয়ার কিছু দিন পরই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও রাষ্ট্রীয় মূল চার নীতি বিসর্জন দেয়া হলো। পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে আমূল পরিবর্তন আনা হলো, ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দেয়া হলো। আমরা ধীরে ধীরে সেই পাকিস্তানি আমলের যে রাজনীতি, যে রাষ্ট্র ব্যবস্থানে ছিলো, সেই দিকেই ফিরে যাচ্ছি। অর্থাৎ ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসাবে পাকিস্তানি আমলে আমরা যে অবস্থানেয় ছিলাম এখন আবার সেই অবস্থানেয় ফিরে যাচ্ছি। পাকিস্তানি আমলে ফিরে যাচ্ছি বললে সত্যের অপলাপ করা হবে বরং ফিরে গেছি বলাই সঙ্গত।

প্র: যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলো- রাজাকার, আল-বদর যারা ছিলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এদের কি গ্রেফতার করা হয়েছিলো ? এ সম্পর্কে আপনি কি জানেন ?
উ: ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে ১৪৩ জনের একটা লিস্ট তৈরি করা হয়েছিলো। যাদেরকে আমরা বাংলাদেশ বিরোধী কার্যকলাপের সাথে জড়িত থাকার সন্দেহ করতাম- তাদের নাম এই তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরা হয়। তালিকায় শান্তি কমিটির লোকজনেরও নাম ছিলো। এদের মধ্যে অল্প কিছুসংখ্যক লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। পরবর্তীকালে এম. পি. এ. ফজলুল করিম সাহেবের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, এই লোকগুলোকে গ্রেফতার করা ঠিক হবে না। গ্রেফতার করা হলে দেশে স্বাভাবিক অবস্থানে বা শান্তি ফিরে আসবে না। সে জন্য খুব অল্পসংখ্যক লোককেই সে সময় ধরা হয়েছিলো। পরবর্তীকালে তো বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমাতে তারাও ছাড়া পেয়েছে। কয়েকজনকে মাত্র ধরা হয়েছিলো। যেমন- ওমর আলী, নূরুল হক চৌধুরী-এ রকম ১০/১২ জনকে বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরা হয়েছিলো। পরবর্তীকালে এদেরকেও ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো কোনো মামলা মোকর্দ্দমা ছাড়াই।

আসলে সে সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা ছিলেন তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে খুব একটা তৎপরতা আমি লক্ষ্য করিনি। ’৭১-এ যে হত্যাযজ্ঞ চলেছিলো, যে অত্যাচার চলেছিলো, সে ব্যাপারে মোর্কদ্দমা হয়েছিলো বটে, কিন্তু সাক্ষি পাওয়া যায়নি। ধীরে ধীরে লোকজনও কেমন যেন নির্লিপ্ত হয়ে পড়লো এবং আমরাও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লাম। অপরাধীরা এমনিভাবেই ছাড়া পেয়েছে। কারোরই জেল হয়নি। কিছুদিন আটক ছিলো মাত্র। কিন্তুবিচার করে শাস্তি দেয়া এ রকম কারো ক্ষেত্রেই ঘটেনি । আমি তো একজন আইনজীবী আমি জানি।

প্র: আপনি কি আমাদের আর কিছু বলবেন ?
উ: বাংলাদেশের মধ্যে আমার ধারণায় সবচেয়ে গরীব এলাকা হচ্ছে পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও। গ্রামে গেলে আপনি এমন একটা এলাকা পাবেন না যারা দু’বেলা পেট ভরে ভাত খায়। এক বেলা ভাত খায় আর আরেক বেলা অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে থাকে। এদের চাইতেও যারা নিচু বা গরীব যাদের সংখ্যা সবচাইতে বেশি তারা একবেলাও ভাত পায় না অনেক দিন। তারা কচু ঘেচু সেদ্ধ করে খায়। আমি প্রতি শুক্রবার গ্রামে যাই তাদের অবস্থানে দেখতে। চোখে না দেখলে আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না তাদের অবস্থানে। আবার যখন ঢাকায় আসি তখন আমার মনে হয় না এটা বাংলাদেশ। মনে হয়, আমেরিকার কোনো অঙ্গরাজ্য বুঝি ! যে দেশের লোক একবেলা পেট ভরে ভাত খেতে পায় না, সে দেশের এতো প্রাচুর্য ! গুটিকয়েক লোকের কাছে এতো অর্থ যে, তারা নিজেরাও জানে না তাদের টাকার পরিমাণ কত। আমাদের এলাকায় এখনো বহু লোক ৫০০ বা ১০০০ টাকা এক সাথে কোনোদিন দেখেনি। পাকিস্তান আমলে গুটিকয়েক কোটিপতি ছিলো। আর এখন বাংলাদেশে কয়েক’শ কোটিপতি। এটাই কি স্বাধীনতার মূল্যবোধ ? এর জন্যই কি দেশ স্বাধীন হয়েছিলো ? এটাই কি আমরা চেয়েছিলাম ?

শেষ

শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০০৮

বীরাঙ্গনা গুরুদাসীর জন্য একটি ভন্ড এলিজি

২টি মন্তব্য :
বীরাঙ্গনা গুরুদাসী তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাতের লাঠির আলতো বাড়ি মেরে আর এসে বলবেন না, ‘কেমন আছিস বাবা? ভালো আছিস তো? দে কয়ডা টাহা (টাকা) দে, তোরা না দিলি পাব কনে ক।’


স্বাধীনতার পর কোনো এক বিষন্ন দূপুরে বীরাঙ্গনা উপাধিতে ভূষিত করে আমরা উনাদের ধন্য করেছিলাম, যথাসময়ে ভুলেও গিয়েছিলাম। দীর্ঘ ৩৭ টি বছর ধরে উনাদের কেউ হয়তো বীরাঙ্গনা গুরুদাসীর মতো ভিক্ষের ঝোলা হাতে আমাদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেরিয়েছেন, কেউবা আত্নহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন আবার কেউবা আজো কস্টে নিভৃতে কাঁদেন। পাগলী বলে হয়তো অনেকের দিকেই ছুড়ে দিয়েছি ঢিল।

স্বাধীনতার জন্য নিজের সম্মান বিলিয়ে দিতে বাধ্য হওয়া এসব মানব সন্তানের খবর নেবার তাগিদ বা প্রয়োজন অবশ্য আমাদের নেই। আমরা উনাদের বীরাঙ্গনা বলে নিজেদের ধন্য করেছি কিন্তু সমাজে-পরিবারে গ্রহন করে নেইনি।

আজ পত্রিকার ভেতরের পাতার ছোট্ট কবরটি পড়ে কেউবা তাকে জননী ডাকছি, আমার মতো কেউবা ব্লগের পাতায় ভন্মামী করে এলিজি লিখে আত্মতৃপ্তিতে ভুগছি কিন্তু জীবদ্দশায় কেউ তাঁদের খোঁজ নেবার প্রয়োজনটুকু বোধ করিনি। জীবিত অবস্থায় কিছু না করে মারা যাবার পরে এসব করা ভন্ডামী ছাড়া আর কি !

বীরাঙ্গনা গুরুদাসীর নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় না থাকাতে রাস্ট্রীয় সম্মান অবশ্য উনার ভাগ্যে জুটেনি। যে মানুষটি ৩৭ টি বছর কোনো সম্মান পাননি দেশের কাছ থেকে, সমাজের কাছ থেকে, আমাদের কাছ থেকে; তার কাছে একদিনের লোক দেখানো সম্মানে কি এসে যায়।

বীরাঙ্গনা গুরুদাসী ওপার থেকে তাকিয়ে অভিশাপ দিয়ে বলছেন " ধিক এই অকৃতগ্য বাঙালী জাতি"।

------------------------------
বীরাঙ্গনা গুরুদাসী  আর নেই
নিজস্ব প্রতিবেদক( প্রথম আলো) , খুলনা

বীরাঙ্গনা গুরুদাসী তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাতের লাঠির আলতো বাড়ি মেরে আর এসে বলবেন না, ‘কেমন আছিস বাবা? ভালো আছিস তো? দে কয়ডা টাহা (টাকা) দে, তোরা না দিলি পাব কনে ক।’ সবার পরিচিত সেই অসহায় গুরুদাসী মন্ডল (৬৫) চিরবিদায় নিয়েছেন। খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনিতে নিজ বাড়িতে গত ৭ ডিসেম্বর গভীর রাতে তিনি পরলোকগমন করেন। ছাব্বিশে মার্চ, ষোলই ডিসেম্বর, একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে আর তাঁকে দেখা যাবে না।
গুরুদাসীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে খুলনার সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধারা কপিলমুনিতে হাজির হন। এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান খুলনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুর রউফ, পাইকগাছার নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। একাত্তরের এই দিনে কপিলমুনি হাইস্কুলের যে মাঠে গণ-আদালত বসিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল, সেই মাঠেই গুরুদাসীকে শেষ শ্রদ্ধা ও সালাম জানায় মুক্তিযোদ্ধাসহ উপস্িথত সাধারণ মানুষ। এ দৃশ্য দেখে কপিলমুনির হাজার হাজার শোকার্ত সাধারণ মানুষ।
গার্ড অব অনার দেওয়ার জন্য পুলিশের একটি চৌকস দল উপস্থিত থাকলেও মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় গুরুদাসীর নাম না থাকায় তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়নি। তবে মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল কাইয়ুমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা জাতীয় পতাকা দিয়ে তাঁর মরদেহ আচ্ছাদিত করে পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে শেষ সালাম জানান। পরে কপিলমুনি শ্মশানঘাটে তাঁকে দাহ করা হয়।

বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০০৮

মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও, পর্ব ১.৬ ( একটি কথ্য ইতিহাস-বলরাম গুহঠাকুরতা)

কোন মন্তব্য নেই :
প্র: আজকাল অনেকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতীয়দের ষড়যন্ত্র বলে মত প্রকাশ করছেন। এ বিষয়টাকে আপনি কিভাবে দেখেন ?
উ: ভারত তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য আমাদের দেশ স্বাধীন করার ষড়যন্ত্র করেছে- এটা যারা প্রচার করছেন তারা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থেই সেটা প্রচার করছেন। এ প্রশ্নে আমার যে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কেবল সেই অভিজ্ঞতারই পুনরুল্লেখ করবো। আমি বলেছি, এপ্রিল মাসের গোড়াতেই ভারতে গিয়েছিলাম এবং সে সময় বেশকিছু নেতৃস্থানেনীয় ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছিলাম। আমি কথা বলার আগ পর্যন্ত তারা আমাদের সম্পর্কে কিছুই জানতো না। আমি কথা বলেছিলাম ডি. এন. ঘোষ, শেরিফ অফ কলকাতার সঙ্গে। তিনি আমাদের প্রথমেই বললেন, আপনারা যে আমাদের কাছে আসলেন, Have you heard of any revolution that without making cell in the neighbouring country? Any revolution could be possible ? অর্থাৎ তিনি বলতে চাইলেন, আপনারা তো এই ঘটনার আগে আমাদের সাথে কোনো রকম যোগাযোগ করেননি। যেহেতু আপনারা যোগাযোগ করেননি সেহেতু প্রথমেই কিভাবে আপনারা আশা করেন যে, আমরা আপনাদের অস্ত্র দেবো ? তিনি শুধু কলকাতার শেরিফই নন, তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো ভারতের তখনকার রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরি এবং পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় রাজনীতিক প্রফুল্ল সেনের মতো লোকের সঙ্গে। কাজেই ভারতের সাথে কোনো রকম যোগাযোগ আমাদের ছিলো- এমন কথা বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিলো। যদি মূল্যায়ন করতে বলেন যে, দেশটা কিভাবে স্বাধীন হলো, তাহলে আমাকে একটা ছোট্ট গল্প বলতে হবে। গল্পটা হচ্ছে এ রকম :

লন্ডন থেকে একটা জাহাজ অনেক যাত্রী নিয়ে আমেরিকা যাচ্ছিলো। সেই জাহাজের তিন তলার এক মহিলা ডেকের রেলিং ঘেষে তার ছোট্ট এক শিশুকে বলছিলো, এই যে তুমি বিশাল জলরাশি দেখছো, এই জলরাশিই পৃথিবীর তিন চতুর্থাংশ জুড়ে রয়েছে। এই কথা বলার সময়ই শিশুটি হঠাৎ করে সমুদ্রে পড়ে যায়। শিশুটি সমুদ্রে পড়ে যাবার পর সবাই চারদিক থেকে চিৎকার করছে,help, help বলে। কিন্তু কেউই সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করবার চেষ্টা করছে না। তখন এক সরদারজী সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে বাচ্চাটাকে উদ্ধার করে আনলো। আমেরিকায় যখন জাহাজটা পৌঁছুলো তখন বহু সাংবাদিক, ফটো সাংবাদিক সরদারজীকে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি নিজের জীবন বিপন্ন করে যে পরের উপকার করলেন- কেন করলেন ? সরদারজী এ সব কথার উত্তর না দিয়ে বলেছিলো, বন্ধ করো সব বাজে কথা। আগে দেখ কে সে, যে আমাকে ধাক্কা দিয়েছিলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামটাও ছিলো কিছুটা সে রকম। আমার দৃষ্টিতে পাকিস্তানসরকার আমাদের ধাক্কা দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে ঠেলে দিয়েছিলো। আওয়ামী লীগ বা কোনো রাজনৈতিক দলের পৃথক কোনো দেশ গঠনের মনোভাব বা চিন্তাধারা ছিলো বলে জানি না। যদিও ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মাঠ পর্যায়ের কিছু নেতা সেটাকে স্বাধিকারের সংগ্রাম বলে চালিয়েছেন। কিন্তুতিনি প্রকৃত স্বাধীনতার সংগ্রাম বলেননি। আমি মনে করি, ২৫ মার্চ পাকিস্তানি আর্মি যদি জনগণের উপর এভাবে ঝাঁপিয়ে না পড়তো এবং নির্বাচনে জয়ী দলকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতো- তাহলে দেশটা স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে এগিয়ে যেতো না। আমি দৃঢ়তার সাথেই বলছি, কোনো রাজনৈতিক দলেরই ভারত সরকারের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ ছিলো না কিংবা ভারত সরকারও এদের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করেনি। এটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটেছে। সাধারণ মানুষ নিজেদের জীবন বাঁচাবার জন্যে, পাকিস্তানি আর্মিদের অত্যাচার, শোষণ, অবিচার থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য তখন স্বাধীনতা সংগ্রামে যেতে বাধ্য হয়েছে। এ যুদ্ধ কোনো বহির্শত্রু বা বাইরের কোনো সরকারের ইঙ্গিতে হয় নাই, দেশের জনগণই এটা করেছে। তবে ক্ষেত্রটা আওয়ামী লীগ দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তৈরি করেছিলো, মানুষকে তারা ঐ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলো- এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। সঙ্গে অন্য দলের ভূমিকাকেও খাটো করে দেখা ঠিক হবে না।

প্র: ইদানিংকালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কতিপয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার বলার চেষ্টা করছেন যে, তাদের নেতৃত্বেই যুদ্ধটা হয়েছে- এ সম্পর্কে আপনি কি বলেন ?
উ: কোনো সামরিক অফিসার বা ব্যক্তিত্ব কোনোভাবেই স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার দাবি করতে পারেন না। সেটা সঠিকও নয়। আমি মনে করি,তারা যদি তাদের নিজের জীবন বিপন্ন হতে না দেখতো, তাহলে তারা এই সংগ্রামে আসতো কি না বলা মুস্কিল। এখানে কোনো পলিটিক্যাল মোটিভেশন ছিলো না। তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে-এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা। এ প্রসঙ্গে আমি ঠাকুরগাঁওয়ের কথা বলতে পারি। শেষ দিন পর্যন্ত ইপিআর জোয়ানরা বলে গেলো যে তারা আমাদের সাথে যোগ দেবে। কিন্তুতারা আসেনি, যে কথা আমি পূর্বেই বলেছি। ইপিআর উইং কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ হোসেন যখন প্রত্যেককে আর্মস জমা দিতে বললেন, যখন তিনি সাধারণ জওয়ানদের কাছ থেকে আর্মস জমা নেওয়ার নির্দেশ দিলেন, কেবল তখনই তারা আর্মস নিয়ে বেরিয়ে আসলো এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলো। কিন্তুতার আগ পর্যন্ত তারা এই কাজটা করেনি। অর্থাৎ আমি যেটা বলতে চাই, তাহলো তাদের ব্যক্তিগত জীবন যখন বিপন্ন হতে লাগলো তখনই তারা এসেছে। এর সাথে অন্যান্য বিষয় ছিলো যেমন- তাদের উপর অবিচার করা হয়েছে, বৈষম্য করা হয়েছে; বাঙালি সোলজার হিসাবে তাদের ওপর অন্যায় করা হয়েছে- এগুলো সত্যি। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনেই তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে। এটা army revolution নয়, political revolution । পরবর্তীতে মুজিবনগর সরকারই সব কিছু পরিচালনা করেছে। এই সরকারের নেতৃত্ব ও নির্দেশেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। এখন কতিপয় সেনা অফিসার যদি নেতৃত্বের দাবি করেন তাহলে সেটা হবে অন্যায় দাবি এবং এই দাবি কখনই ইতিহাসের অংশ হতে পারে না।

প্র: বর্তমানে অনেকেই বলছেন যে, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই ভাষণ শুনেই নাকি বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো- এ সম্পর্কে আপনি কি জানেন ?
উ: আমাদের এলাকার খুব কম মানুষই কালুরঘাটের এই রেডিও বার্তা শুনেছে। আমরা যেহেতু পলিটিক্যালি খুব সচেতন ছিলাম এবং আমরা লোকমুখে যখন শুনলাম যে, আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোকজনও যুদ্ধে যোগদান করছে তখন অনেক কষ্টে কালুরঘাটের রেডিও বার্তাটা পরে শুনেছিলাম। কিন্তুআম-জনতা, শতকরা ৯০ ভাগ লোকই এ রকম কোনো কথা শোনেইনি। জনগণের বেশিরভাগ হয়তো দেশ ত্যাগ করতো না, যদি না তাদের জীবনের ভয় থাকতো। যখন পাকিস্তানিআর্মি আক্রমণ শুরু করলো, তখন তারা তাদের নিজেদের জীবন ও মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষার্থে দেশ ত্যাগ করলো। তারা কালুরঘাটের বক্তৃতা বা অন্য কোনো সামরিক কমান্ডারের বক্তৃতা শুনে দেশ ত্যাগ করেছে বা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে- এটা আমি মনে করি না।

আগামী পর্বে এই সাক্ষাতকার পর্ব সমাপ্য

রবিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০০৮

মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও, পর্ব ১.৫ ( একটি কথ্য ইতিহাস-বলরাম গুহঠাকুরতা)

কোন মন্তব্য নেই :
প্র: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তো আপনি অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। এ সময়ের এমন কিছু স্মরণীয় ঘটনার কথা কি বলবেন যা এখনও আপনার মনে স্মৃতি হয়ে আছে ?
উ: সেই স্মৃতি কিছুটা বেদনাদায়ক। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন আমাদের এলাকায় বেশ কিছু অবাঙালি বাঙালিদের হাতে নিহত হয়েছিলো, যেটা আমার কাছে অমানবিক বলে মনে হয়েছে। ছোট ছোট বাচ্চাদের পর্যন্ত যেভাবে মারা হয়েছিলো তা ছিলো বেদনাদায়ক। এমন ঘটনাও দেখা গেছে যে, অবাঙালি ইপিআর অফিসারের বউকে গোল পোস্টের বারে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে সাধারণ মানুষকে দেখাবার জন্যে। এই সমস ঘটনা আমার কাছে পৈশাচিক বলে মনে হয়েছিলো। আমাদের ইপিআর-এর সাথে আনসার ও মুজাহিদরা মিলে এই খুন-খারাবিগুলো করেছিলো বলে জানি। আমি তাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে বাধা দিতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তুতারা বলেছিলো উকিল সাহেব আমাদের রাইফেলটা কিন্তুউল্টো দিকে ঘুরে যেতে পারে। কথা বলবেন না। তখন আমি তাদেরকে আর কিছু বলিনি। কিন্তু মর্মাহত হয়েছিলাম।

প্র: কোন্‌ সময়টাতে এ সব ঘটনা ঘটেছিলো ?
উ: মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের ১২ তারিখের মধ্যে।

প্র: কোন্‌ কোন্‌ এলাকায় এ সব ঘটনা ঘটেছে ?
উ: দিনাজপুর জেলার গোটাটাতেই ঘটেছে। কিন্তু সব ঘটনা আমি নিজের চোখে দেখিনি। ঠাকুরগাঁওয়ের ঘটনা আমি নিজের চোখে দেখেছি।

প্র: ঠাকুরগাঁওয়ের কোন্‌ কোন্‌ এলাকায় দেখেছেন, নির্দিষ্ট করে নামগুলো বলবেন ?
উ: ঠাকুরগাঁও শহরের উত্তর পাশে গার্লস স্কুলের পাশে নদী ছিলো। সেই নদীর পারে নিয়ে গিয়ে তাদের গুলি করে মারা হতো।

প্র: কাদের কাদের মারা হয়েছে ? কোনো নাম কি আপনার মনে পড়ে ?
উ: অনেকের নাম আমার মনে পড়ে। হায়াত আশরাফ ও তার ছেলে। আমাদের বন্ধু আনোয়ার, কমর সেলিম, ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার, সাইফুল্লাহ, কুদ্দুস। এদের কেউ কেউ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলো। বখতিয়ার খাঁ ও তার ছেলে-পেলেরা। তার এক ছেলে অবশ্য বেঁচে আছে।
অবাঙালিদের হত্যার ব্যাপারে ন্যাপ, আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি বা আর যারা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন- তাদের কোনো হাত ছিলো না। প্রকৃতপক্ষে সেই সময় ইপিআর ক্যাম্প থেকে যারা অস্ত্র সহ বেরিয়ে আসলো এবং আনসার ও মুজাহিদ- যাদের কাছে রাইফেল ছিলো, গুলি ছিলো- তারাই এ সব কাজ করেছে। তাদের সঙ্গে অবশ্য কিছু দুষ্কৃতিকারীও ছিলো। তাদের উপর প্রকৃতপক্ষে কারোরই কোনো নিয়ন্ত্রন ছিলো না। কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রনই ছিলো না। যারা অবাঙালি নিধন করেছিলো- তাদের কয়েকজনের সঙ্গে আমি তখন বা পরে কথা বলেছি। তাদের ভীতিটা ছিলো এই রকম--পরবর্তীকালে দেশে যদি শান্তি ফিরে আসে এবং সরকার কাজ করে তখন এই অবাঙালিরাই সরকারের কাছে তাদের চিনিয়ে দেবে। এই ভয়টা সাংঘাতিকভাবে ওদের ওপর ভর করেছিলো। দেশটা যে এ ভাবে স্বাধীন হবে তারা সেটা ভাবতেই পারেনি। আমি যখন ব্যক্তিগতভাবে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম, মানুষকে যে এ ভাবে তোমরা হত্যা করলে সেটা কি ভালো ? তখন ওরা বললো, উকিল সাহেব আপনি জানেন না, পরবর্তীকালে আমাদেরকে কে চেনাবে ? বাঙালিরা আমাদের চেনাবে না। এই অবাঙালিরাই আমাদের চিনিয়ে দেবে যে এরা ইপিআর ছিলো। এরা এই কাজ করেছে। তখন আমাদের কোর্ট মার্শাল হবে। আমরা মারা যাবো।

কমর সেলিমের বাড়িতে বহু অবাঙালি আশ্রয় নিয়েছিলো, সেখানে গিয়ে গুলি করে করে হত্যা করা হয় তাদেরকে। পাশবিক অত্যাচার করে গুলি করা হয়েছে-এমন ঘটনা আমাদের এলাকায় কম। জেলখানায় কিছু লোক রাখা হয়েছিলো। জেলখানা থেকে বের করে তাদের গুলি করে মারা হয়েছিলো। আমি এবং কমিউনিস্ট পার্টির কামরুল হোসেন আমরা দু’জনেই চেষ্টা করেছিলাম খুন খারাবিটা বন্ধ করতে। কিন্তুতারা বন্ধ তো করেইনি, উল্টো আমাদের ভীতি প্রদর্শন করলো যে, তাদের রাইফেলের নল আমাদের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে। বস্তুত: সে সময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব কার্যকর ছিলো না, ছিলো রাইফেলধারীদের নেতৃত্ব। আজ আমার নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয়। এই সমস্ত লোককে আমরা আশ্বাস দিয়েছিলাম যে, চিন্তা করো না, কোনো অসুবিধা হবে না। আসলে আমাদেরও ধারণা ছিলো না যে, তাদেরকে এভাবে গুলি করে মারা হবে। আমরা যদি তাদেরকে বলতাম যে, রাতের অন্ধকারে যে যেদিকে পারো পালিয়ে যাও, তাহলেও হয়তো অনেক জীবন রক্ষা পেতো। কিন্তু আমরা তাদের বলেছি চিন্তা করবেন না, আমরা তো আছি। কিন্তু প্রয়োজনের সময় আমরা তাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি।

প্র: ঠাকুরগাঁওয়ে প্রকৃত অর্থে অস্ত্রের লড়াই যখন শুরু হলো- তখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা নিয়ন্ত্রন কাদের হাতে ছিলো ?
উ: নিয়ন্ত্রন রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে ছিলো না। যার হাতে অস্ত্র তার হাতেই ক্ষমতা। আমি বাধা দিতে গিয়ে বিপদগ্রস্ত হয়েছিলাম। আমরা পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা।

প্র: হত্যার সঙ্গে কি সম্পদ লুণ্ঠনের কোনো ব্যাপার ছিলো ?
উ: হ্যাঁ।

প্র: এর পিছনে কি কোনো বিশেষ কারণ কাজ করেছে ?
উ: লুন্ঠনটা কোনো বিশেষ অর্থে কাজ করেছে বলে মনে হয় না। লুণ্ঠনটা যে কেবল গুটিকয়েক অস্ত্র ধারীরাই করেছে তা নয়, বরং আমার জানা মতে, লুণ্ঠনটা করেছে সাধারণ মানুষ। গ্রাম-গঞ্জ থেকে লুণ্ঠনকারীরা এসে বিভিন্ন জায়গায় তারা লুট করেছে। এ সব আমরা নিজ চোখেই দেখেছি। এরা পলিটিক্যালি মটিভেটেড নয়। তারা কোনো রাজনৈতিক দল বা সেই দলের কোনো অঙ্গ-সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলো না। তাদের মূল কাজটাই ছিলো লুট করা। গ্রাম থেকে লোকজন এসে পাগলের মতো সব লুট করেছে। আর আমরা অসহায়ের মতো তা দেখেছি, কিছুই করতে পারিনি।

প্র: লুট কি কেবল অবাঙালিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘরে হয়েছে ?
উ: অবাঙালিদের তো বটেই। তারপর আমরা যখন চলে গিয়েছি বা যাচ্ছি তখন আমাদেরগুলোও লুট হয়েছে। আমাদের সব জিনিসপত্র নিয়ে গেছে।

প্র: যুদ্ধকালের কোনো ঘটনা কি আপনাকে এখনো পীড়া দেয় ?
উ: আমার যেটা বেশি করে মনে হয় সেটা হলো- অবাঙালিদের কেউ কেউ আমাদের উপর অনেকটাই নির্ভর করেছিলো। তারা ভেবেছিলো, বিপদের সময় আমরা তাদের সাহায্য সহযোগিতা করতে পারবো। কিন্তুআমরা কিছুই করতে পারিনি। এটা আমাকে খুব কষ্ট দেয়। আমরা যখন দেশ ত্যাগ করে আসতে লাগলাম তার আগ পর্যন্ত অবাঙালিদের মারা হয় এবং তাদের সঙ্গে যে গহনা ও টাকা-পয়সা ছিলো সেই সব গহনা ও টাকা পয়সা কন্ট্রোল রুমে জমা হচ্ছিলো এবং সেটার পরিমাণ ছিলো প্রচুর। সোনাদানা, টাকা সব ট্রাঙ্কে রাখা হচ্ছিলো এবং সার্বক্ষণিক সেখানে পাহারাদার ছিলো।

প্র: এটা কিভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছিলো ?
উ: যাদের মারা হচ্ছিলো বিভিন্ন জায়গায় সেখান থেকেই সংগৃহীত অর্থ-সম্পদ কন্ট্রোল রুমে জমা করা হচ্ছিলো। যারা এ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলো তারা কিছু নিয়েছে এ কথা ঠিক। কিন্তু বেশির ভাগই জমা হয়েছিলো কন্ট্রোল রুমে। এক সময় এই জমার পরিমাণটা, সোনা-দানা এবং টাকা পয়সায় বেশ বড় আকার ধারণ করলো। ঠাকুরগাঁওয়ের যখন পতন হতে শুরু করলো তখন কতিপয় নেতা এ সব সমঙদ নিয়ে পালিয়ে গেলো। আমি তাদের নাম বলবো না। আমি নিজ চোখে দেখেছি কারা এ সব নিয়ে গেছে। ঐ সব ব্যক্তিরা কিন্তু ভারতে পালিয়ে গেলেও পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো অবদান রাখেনি। তারা ঐ সব গয়নাগাটি, টাকা পয়সা কিভাবে কোথায় রাখবে- এইসব নিয়েই ব্যস্ত ছিলো।

প্র: এরা কোন্‌ দলের সেটা কি আপনার জানা ?
উ: হ্যাঁ, জানা। কারণ ঠাকুরগাঁও ছোট জায়গা। আমি সবাইকে বিশেষভাবে চিনি। কি ন্তুআমি তাদের নাম বলবো না। কারণ আমার নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে। কোন্‌ ব্যক্তি, কোন্‌ দলের, কারা কারা ব্যাঙ্ক লুট থেকে টাকা নিয়েছে এ সবই আমি জানি। কিন্তু তাদের সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারবো না।

প্র: আপনি বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে অবাঙালিদের উপর অত্যাচার করা হয়েছে। কিন্তুএই অবাঙালিরাই তো পাকিস্তানিদের সঙ্গে থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে এবং বাঙালি নিধন ও নারী ধর্ষণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে- এ সম্পর্কে আপনি কি বলবেন?
উ: আমাদের এলাকার অবাঙালিরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে তখন- যখন পাকিস্তানিরা ঠাকুরগাঁও দখল করলো। তারা এটা করেছে জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য। আমি জানি, ঠাকুরগাঁওয়ে এ সময় রাজনৈতিকভাবে এমন কোনো অবাঙালি নেতৃত্ব ছিলো না যে, তারা রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানের পক্ষে বা আমাদের বিপক্ষে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে পাকিস্তানিআর্মিরা যখন আমাদের এলাকা দখল করে নিলো এবং আমরা আমাদের এলাকা ছেড়ে চলে আসলাম তখন তারা অনেক অন্যায় কাজ করেছে। কেউ অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠনের জন্যে করেছে আবার কেউ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে করেছে এ কথা আমরা বলতে পারি।
চলবে.....

বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০০৮

মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও ১.৪ ( একটি কথ্য ইতিহাস-বলরাম গুহঠাকুরতা)

কোন মন্তব্য নেই :
প্র: মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আপনার এলাকার সীমান্ত বরাবর অনেক শরণার্থী ক্যাম্প গড়ে উঠেছিলো। এ সব ক্যাম্প কোথায় কোথায় গড়ে উঠলো, ক্যাম্পের অবস্থানে কেমন ছিলো। এ ব্যাপারে আপনি কিছু বলবেন কি ?
উ: কালিয়াগঞ্জের তরঙ্গপুর থেকে শুরু করে বিহারের কিষণগঞ্জ এবং সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গের ইসলামপুর এবং সেখান থেকে জলপাইগুড়ি পর্যন্ত অনেকগুলি ক্যাম্প ছিলো। তার মধ্যে দাড়িভিট বলে একটা ক্যাম্প ছিলো অনেক বড়। তরঙ্গপুরের ক্যাম্প ও অনেক বড় ছিলো। কিষণগঞ্জের ক্যাম্প ও বেশ বড় ছিলো এবং ইসলামপুরের মরাগতির ক্যাম্প ও অনেক বড় ছিলো। ক্যাম্প গুলোতে বাংলাদেশ থেকে আসা লোকজন আশ্রয় নিয়েছিলো। ভারত সরকার চাল, ডাল, তেল, নুন সব দিতো। আশ্রয় নেয়া মানুষ কেবল রান্না করে খেতো। খড়ের একেকটা ঘরে ৪/৫ জন করে শরণার্থী থাকতো। প্রতিটি ক্যাম্পে আমি, এম. পি. এ. ফজলুল করিম সাহেব, নূরুল হক সাহেব, কামরুল হোসেন সাহেব, রশীদ করিম সাহেব সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন সময় গেছি। রশীদ করিম সাহেব প্রথমে তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলেন। পরে কিষণগঞ্জের একটা ক্যাম্পে ছিলেন বলে আমি জানি।

প্র: ক্যাম্প গুলোর অবস্থানে কেমন ছিলো ?
উ: ক্যাম্প গুলো ভারত সরকার চালাতো। ইসলামপুরের তখনকার যে এ.ডি.সি. ছিলেন, তার নামটা এখন ভুলে গেছি। এরা ক্যাম্পের জন্য প্রচুর কাজ করেছেন। তবে এটা ঠিক, প্রয়োজনের তুলনায় ভারত যেটা দিয়েছিলো সেটা খুব বেশি ছিলো না। ইসলামপুরের যে এ.ডি.সি. রিলিফের চার্জে ছিলেন তাকে আমি একদিন বললাম, আপনারা যে সব কম্বল বরাদ্দ করেছেন তা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত। আমি এই কথা বলাতে এডিসি-র সাঙ্গপাঙ্গ যারা ছিলো তারা আমার উপর খুবই অসন্তুষ্ট হলো। আমরা তো শরণার্থী। আমাদের মান অপমান বলে তখন কিছু নেই। ওরা আমার ওপর একটু উম্মা প্রকাশ করলেন এই কারণে যে, এতো দেয়া হচ্ছে তারপরও আমরা সমালোচনা করছি। কিন্তুযতোই দেয়া হোক, লোক তো আমাদের অনেক। যেখানে লক্ষ লক্ষ লোক সেখানে এক হাজার বা দুই হাজার কম্বলে কি হয় ? খুব কষ্ট করেই আমরা ছিলাম।

প্র: স্বাস্থ্য সেবা সেখানে কেমন ছিলো ?
উ: স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থানে আমাদের এলাকার ক্যাম্প গুলোতে খুব একটা খারাপ ছিলো না। খারাপ থাকলে তো মহামারী জাতীয় কিছু হতে পারতো। কিন্তু এ সব ক্যাম্প গুলোতে তেমন কিছু হয়নি। ছোট-খাটো অসুখ বিসুখ ছাড়া তেমন কিছু হয়নি। ডাক্তার, ওষুধ তারা রেখেছিলেন। প্রতিটি ক্যাম্পের সাথে একটা অস্থায়ী হস্‌পিটাল ছিলো। তারা পর্যাপ্ত ওষুধ-পত্র দিয়েছিলো। প্রয়োজনের তুলনায় কম হলেও একেবারে কম নয়।

প্র: বিভিন্ন সময় ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ করতে হয়েছে, কাজও করতে হয়েছে। এ সব ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক কেমন ছিলো ?
উ: প্রথম দিকে আমাদের সঙ্গে ভারতের স্থানীয় জনগণ ও নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সম্পর্ক এতই মধুর ছিলো যে, আমরা বাংলাদেশ থেকে যে সমস্যা লোক সেখানে গিয়েছিলাম- তাদেরকে ট্রেনে, বাসে কোনো টিকিট কাটতে হতো না। ‘জয় বাংলা’ থেকে এসেছি বললেই ছেড়ে দিতো। যেখানেই আমরা গেছি,বিশেষ করে ব্যক্তিগতভাবে আমি, ফজলুল করিম সাহেব এবং আমাদের সাথে অন্য যারা ছিলেন তারা ভারতীয়দের কাছ থেকে যে আতিথেয়তা, ভালোবাসা, সম্মান পেয়েছেন তা তুলনাহীন। কিন্তু শেষের দিকে লক্ষ্য করলাম এই সম্পর্কটা যেন কমে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের মনের মধ্যে হয়তো একটা ধারণা সৃষ্টি হতে লাগলো যে, আমরা এতোগুলো লোক হয়তো আর দেশে ফিরে যেতে পারবো না। আমরা তাদের উপর বোঝা হয়ে থাকবো। এ রকম একটা ভাব পরবর্তীকালে আমি তাদের অনেকের কাছে থেকেই শুনেছি। কিন্তু ইতোমধ্যেই তো দেশ স্বাধীন হয়ে গেলো। যুদ্ধটা ঠিক সময় মতো শেষ হওয়ায় আমাদের খুব একটা অসুবিধা হয়নি।

প্র: ভারত সরকার বিশেষত: ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে আপনাদের সম্পর্ক কেমন ছিলো ?
উ: সত্যি কথা বলতে কি আমরা কিছু আর্মি অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলাম কিংবা তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলো মূলত: আমাদের দেশের রাস্তাঘাট সম্পর্কে জানার জন্যে। আমাকে এবং ফজলুল করিম সাহেবকে অনেক আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো বাংলাদেশের রাস্তাঘাট সম্বন্ধে জানার জন্য। তারা আমাদের পরামর্শ নিয়েছেন বা রাস্তা ঘাটের, এলাকার ম্যাপ করিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া এ.ডি.সি. একজন চার্জে ছিলেন। তাঁর সাথে জিনিসপত্র লেন-দেন ছাড়া প্রশাসনিক অন্য কোনো কর্মকর্তা বা লোকজনের সাথে আমাদের তেমন যোগাযোগ ছিলো না। এ সময় আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক খুবই ভালো ছিলো। আমাদের ২/১ জন ভুল করে গ্রেফতার হয়েছিলো। আমরা তাদের জামিনের জন্য যখন কোর্ট কাচারিতে দৌঁড় ঝাপ করেছি। তখনও সবার কাছ থেকেই সহযোগিতা পেয়েছি।

প্র: তারা গ্রেফতার হয়েছিলো কেন ?
উ: আমাদের এলাকার ভাসানী ন্যাপের জিয়াউল হক নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। তিনি অনেকদিন ভারতের জেলখানায় ছিলেন। তাঁকে আমরা অনেক কষ্টে পরবর্তীকালে রিলিজ করেছিলাম। এই রিলিজের ব্যাপারে আমি, ফজলুল করিম সাহেবসহ আরো অনেকেই মুজিব নগরে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তাকে রিলিজ করা হয় শেষপর্যন্ত সবার সহযোগিতায়। সিরাজুল ইসলাম নামে আর একজন সাউথ ইন্ডিয়াতে ধরা পড়লো। তাকে সেখান থেকে রিলিজ করা হলো। এ সব ব্যাপারে একটু যোগাযোগ হয়েছিলো সরকারি লোকজনের সঙ্গে। তাদের কেন গ্রেফতার হয়েছিলো-তা বলা মুস্কিল।

প্র: ভারতে যাওয়ার পর আপনার মূল কাজটা কি ছিলো ?
উ: আমার মূল কাজটা ছিলো সমন্বয় সাধন করা, মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করা, রিলিফ ক্যাম্প গুলোতে নিয়মিত যাওয়া এবং সেখানে কার কি অসুবিধা হচ্ছে, কার কি নেই- এ সব খোঁজ খবর নেয়া। কালিয়াগঞ্জের কাছে তরঙ্গপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক ট্রেনিং দেয়া হতো। সেখানে আমাকে ফজলুল করিম সাহেব মাঝে মধ্যেই পাঠাতেন খবর নেয়ার জন্যে। মনে হয় আমি তখন ইয়াং ছিলাম বলে সমন্বয় সাধনের কাজটি আমাকে দেয়া হয়। নয় মাস আমি আমার পরিবারের সঙ্গে কোনো দিনই থাকতে পারিনি। স্বত:স্ফূর্তভাবে সার্বক্ষণিক কাজই করেছি। আমি এই নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের কাজের সঙ্গে বিশেষত: মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহের কাজে, রিলিফ ক্যাম্পে জনগণের দুঃখ দুর্দশা লাঘবে সার্বক্ষণিক কাজ করেছি। ভারত- বাংলাদেশ সরকারের কোনো কোনো কাজের ক্ষেত্রেও সমন্বয় সাধন করেছি। আর আমি থাকতাম ইসলামপুর বেইস করে, এদিকে জলপাইগুড়ি আর ওদিকে তরঙ্গপুর।
চলবে...

মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর, ২০০৮

রঙিলা দুনিয়ার ঢঙিলা মানুষরে তুই

1 টি মন্তব্য :
১.
ঘটকালীর সুযোগ না পেলেও মাঝে সাজে গোয়েন্দাগীরি করতে হয়। তেমন বিশাল কিছু না; অমুক ছেলের খোজ, তমুক মেয়ে কি রকম এই সব আর কি। জিনিসটা ভালো না লাগলেও অনেক সময় এক রকম বাধ্য হয়েই করতে হয়। ঘটনা বেশ কবছর আগের। পাশের এক বড় শহর থেকে লতায় পাতায় এক বড় ভাই উনার বোনের জন্য হবু জামাই খুঁজতে খুঁজতে কিভাবে জানি বের করলেন হবু জামাই আর আমি একই শহরের বাসিন্দা। তো যাই হোক, উনি ছেলের পাত্তা লাগাতে বল্লেন, আমিও লাগালাম।
উনি ফোন করে বলেন " ছেলে কি রকম ? "
আমি বলি " ছেলে ভালোই তবে হালকা পাতলা পানাভ্যাস আছে।"
"চলবো না"
"ক্যানে বাহে ?"
"মদ খাওয়া ছেলে চলবো না, এইটাই ফাইনাল"
আমি বলি " হ "
" হ মানে ?"
"হ, মাইনে হইলো আপনে খাইলে সমস্যা নাই, আর ওই পোলায় খাইলে সমস্যা ? "
" কি বলো ? "
" ছেলে এক অজি মাইয়ার লগে লিভ টুগেদারও করে, যেমনটা আপনে করতেন শম্পা ভাবীরে বিয়া করার আগে ! "
২.
পানাভ্যাসের কথা যখন আসলই তখন আরেকটা গল্প বলি। বৈদেশে আসার পর টের পাইলাম অনেকের কাছেই ড্রিংক করা স্মার্টনেসের লক্ষন। আমার অভ্যাস নাই বল্লে অনেকেই এমন ভাবে তাকায় যেনো আমি এই মাত্র বড়িশালের লন্চে সদরঘাটে নেমে ডাক পারছি " ও মনু "।

একবার এক আড্ডায় ' টাকিলার' কথা শুনে আমিতো ভেবেছিলাম যাদের টাক আছে তারাই টাকিলা খেতে পারে। পরে অবশ্য বারে কিছুদিন কাজ করায় এসব ধন্ধ কেটে গিয়েছিলো। সব ককটেল পার্টিতেই শক্ত পানীয়ের সাথে নরম পানীয়ও থাকে। কেউ কাউরে যাইত্তা ধরে না যে খাইতেই হইবো, তোমার ইচ্ছা হলে খাইবা - নাইলে নাই, নো চাপাচাপী ( এই জিনিসটা অনেক দেশী ভাই করে, চাপাচাপী, না খাইলে বলে ' হালায় ক্ষ্যাত' )।

৩.
এবারেরটা অজএইড স্কলারশীপে আসা এক ভদ্রলোককে নিয়ে। ভদ্রলোক দেশের কোনো এক সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নামটা না হয় নাই বল্লাম। ভদ্রলোক আর আমি একই কলেজ থেকে পাশ করা বলে পরিচয় আগে থেকেই ছিলো। দু বছরের শিক্ষা ছুটি শেষ করে উনি এখানে এসেছিলেন। তো পড়া শেষ করে যথাসময়ে উনি দেশে ফেরতও গিয়েছিলেন। শুনেছি দেশে গিয়ে নাকি উনি বড় গলায় বলতেন " দেশের ছেলে দেশে ফেরত এসেছি। ওখানে বড় চাকুরির অফার পেলেও সেটা গ্রহন না করে অল্প টাকার মাস্টারীতে ফেরত এসেছি" । অবশ্য সেটা গোপন করতেন যে অজএইড স্কলারশীপে এখানে আসলে কেউ পিআর এর এপ্লাই করতে পারেন না, দেশে ফেরত যেতে বাধ্য। ১ বছর হলো উনি আবারো এসেছেন, এবার পিএইচডি করতে। মাঝে সাজে কথা হয়। কথার মাঝে টের পাই, উনি এবার থেকে যাবেন।
"দেশের অবস্থা খারাপ, ছেলে- মেয়ের স্কুলের ঠিক নাই, চাকুরীতে বেতন কম " ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি উনাকে বল্লাম " বস, এইবার কি সব পাক্কা ! ফেরত তাইলে যাইবেন না ? "

৪.
পার্থের এক সুশীলের সাথে হালকা পাতলা বাতচিত হয়। সুশীল সাহেব আবার নাস্তিক, যদিও নিজেকে মুক্তমনা হিসেবে পরিচয় দেন। তবে উনার একটা ভালো দিক হলো, উনি উনার নাস্তিকতা আমার উপর চাপায় দেন না। আমিও তেমন গা করি না, উনি নাস্তিক - কি আস্তিক। যার যার বিশ্বাষ তার তার কাছে। সেই দিন ফেসবুকে উনার বিয়ের ছবি দেখে আমি পুরা টাস্কি খেয়ে গেলাম।
ফোন দিয়া বল্লাম " বড় ভাই, টুপি মাথায় মোনাজাত ধরা আবুলটা কি আপনে ? "
" হ, বিয়ার দিনে সবার চাপাচাপিতে পড়তে হইছিলো "
আমি কই " মোনাজাতও দেখি করছিলেন ?"
" হ"
" তাইলে আপনের নাস্তিকতা সেই দিন কই আছিলো বস ? "

৫.
বেশ কমাস আগে সিডনীর এক বাঙালী বাসায় গিয়েছিলাম। সাথে বউ ছিলো। জাতি সত্বায় বাঙালী হলেও উনারা অবশ্য নিজেদের বাঙালী বলেন কি না সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে আমার। উনাদের কাছে বাঙালী পরিচয়ের চাইতে নাকি মুসলমান পরিচয়টাই বড় !! আজিব চিন্তা-চেতনা। যাই হোক গল্পে ফেরত আসি। আরো কিছু অতিথী অবশ্য সেখানে ছিলো। আংকেল আমাকে আর আমার বউকে ডাইনিং এ নিয়ে গেলেন তখন ভেবেছিলাম উনার বাসার অন্যদের সাথে অন্তত পরিচিত হওয়া যাবে। খাওয়া হলো- দাওয়া হলো; তবে বাসার অন্য কারো সাথে দেখা হলো না। আমার সামনে আসলে নাকি পর্দা রাখা যাবে না। অথচ আংকেল ঠিকই আমার বউয়ের সামনে এসেছেন, যেখানে আমার বউয়ের পর্দার কথা উনার চিন্তায়ও আসেনি। কি অদ্ভুত বৈপিরত্য। পর্দা শুধু নিজের পরিবারের জন্য ?

পাত্র-পাত্রির নাম গোপন করা হলো আমার পিঠ রক্ষার জন্য। তবে ঘটনটাগুলো সত্য- লেখার স্বার্থে কিছুটা পরিবর্তিত।

সোমবার, ১ ডিসেম্বর, ২০০৮

মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও ১.৩ ( একটি কথ্য ইতিহাস- বলরাম গুহঠাকুরতা)

কোন মন্তব্য নেই :
প্র: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানিরা গোটা দেশেই নির্যাতন ক্যাম্প করেছিলো। আপনাদের ঠাকুরগাঁওয়ের কোথায় কোথায় এ জাতীয় নির্যাতন ক্যাম্প ছিলো ?
উ: তাদের মূল নির্যাতন ক্যাম্প ছিলো ঠাকুরগাঁও ওয়াপদা রেস্ট হাউসে। সেখানে তারা বাঘের খাঁচা করেছিলো। সেই বাঘের খাঁচায় জীবিত মানুষকে ঢুকিয়ে দেয়া হতো। এই বাঘের খাঁচা সম্পর্কে একটা ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে। পাক বাহিনী সালাহউদ্দীন নামে এক মুক্তিযোদ্ধাকে সেই বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলো। এই ঘটনাটা আমি লোকমুখে শুনেছি। সালাহউদ্দীন ১৯৭১ সালে দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর ছাত্র ছিলো। পাক সেনারা ১৩ এপ্রিল দিনাজপুর এবং ১৪/১৫ এপ্রিল ঠাকুরগাঁও দখল করে ১৮ এপ্রিল বীরগঞ্জে মর্মান্তিক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এই ঘটনা সালাহউদ্দীনের জীবন বদলে দেয়। এই ঘটনার পর এক রাতে সে ভারত চলে যায় এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে হয়ে ওঠে লড়াকু মুক্তিসেনা।
ঠোকরাবাড়ি, বালিয়াডাঙ্গা, ঠগবস্তি, বীরগঞ্জ, মেহেরপুর রণাঙ্গনে সে ছিলো অকুতোভয় এক যোদ্ধা। নভেম্বর মাসে সালাহউদ্দীন অবস্থান করছিলো জাবরহাট ক্যাম্পে। এখানে থাকার সময় সে সংবাদ পেলো যে, পাক সেনারা তার বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে। এই খবর জেনে সহযোদ্ধারা তাকে সমবেদনা জানায়। কিন্তু বাবার সংবাদ জেনে সে একটু বিচলিত হয়ে পড়ে। সালাহউদ্দীন ঐ দিনই গভীর রাতে একজন সহযোদ্ধাকে জানিয়ে রওনা দেয় বাড়ির উদ্দেশে। কথা ছিলো পরদিনই সে আবার ফিরে আসবে। পায়ে হেঁটে ভোর নাগাদ সে পৌঁছে যায় বাড়িতে। কয়েক ডাকেই দরজা খুলে দিলো তার মা। ঘরে ঢুকে দেখে বাবা দিব্যি রয়েছে। বাড়ি ফিরে জানতে পারে ঐ খবরটা সঠিক ছিলো না। সম্ভবতঃ পাকিস্তানিদের সহযোগী কেউ কারো মাধ্যমে তাকে এই খবর দিয়ে তার জন্য ফাঁদ তৈরি করেছিলো। এদিকে দ্রুত সালাহউদ্দীনের ঘরে ফেরার খবর চলে যায় ঠাকুরগাঁওয়ের পাক সেনাদের দপ্তরে। সম্ভবতঃ ১১ নভেম্বর সকাল ১০টার দিকে পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দীনদের বাড়িটা ঘিরে ফেললো। তারা সালাহউদ্দীনকে বন্দি করে নিয়ে গেলো তাদের ঠাকুরগাঁওয়ের সদর দপ্তরে। সেখানে প্রচন্ড নির্যাতন চলে তার ওপর। মুক্তিবাহিনী এবং তাদের আশ্রয়দাতাদের বিষয়ে সালাহউদ্দীনের কাছে তথ্য চায় পাক সেনারা। বুটের লাথি, চাবুকের চাবকানি, কোনোকিছুতেই নতি স্বীকার করেনি সে। মৃত্যুর ভয় দেখালে সালাহউদ্দীন দৃঢ়ভাবে নাকি জানিয়ে দিয়েছিলো আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। তার হাতের আঙুলগুলো পাক সেনারা জাতি (টিন কাটার বড় লোহার কাঁচি) দিয়ে কেটে ফেলে, হাতেপায়ে গজাল পেরেক ঠুকে দেয়। চোখের মণিতে বড়শি আটকিয়ে সুতো বেঁধে টানাটানি করে নিষ্ঠুরভাবে। তারপরও সালাহউদ্দীন ছিলো অবিচল, পাকিস্তানিদের কাছে কিছুই স্বীকার করেনি সে। পাকিস্তানিমেজর মাহমুদ হাসান বেগ নাকি মুক্তিযোদ্ধা সালাউদ্দীনের দৃঢ়তায় বিস্মিত এবং স্তম্ভিত হয়েছিলো ! সালাহউদ্দীনের মতো এতো দৃঢ়তা, এতো দেশপ্রেম এর আগে আর কারো মধ্যে সে কখনও দেখেনি। কোনো অবস্থানেতেই কোনো তথ্য না দেওয়ায় পরদিন ১২ নভেম্বর সকালে পাকিস্তানি মেজর জামানের নেতৃত্বে কয়েকজন পাক সেনা বের করে নিয়ে আসে ক্ষতবিক্ষত সালাহউদ্দীনকে। তার দুই হাত পিঠমোড়া করে বাঁধা। জিহ্বাতেও চালানো হয়েছে চাকু। ঐ অবস্থানেয় তাকে ঐ বাঘের খাঁচার সামনে আনা হয়। সেখানে তাকে আবার নাকি বলা হলো, হয় তথ্য দাও, নইলে বাঘের খাঁচায় মৃত্যু। তারপরও সে বাঘের খাঁচাকেই কবুল করে নিয়েছে। তার পরের দৃশ্যের কোনো বর্ণনা হয় না।
পিঠমোড়া করে হাত বাঁধা অবস্থানেয় সালাহউদ্দীনকে ফেলে দেয়া হয় বাঘের খাঁচায়। বীর মুক্তিযোদ্ধা তাকিয়ে ছিলো বাঘের দিকে। চারিদিকের রুদ্ধশ্বাস নিস্তব্ধতাকে ভেঙে বাঘ দু’টো ঝাঁপিয়ে পড়ে সালাহউদ্দীনের ওপর। নির্ভিক মুক্তিযোদ্ধার ক্ষীণ চিৎকারে প্রকৃতি কেঁপে উঠলেও পাকিস্তানিসেনা এবং তাদের দোসরা এটা দেখে উল্লসিত হয়েছিলো। এক সময় সব শেষ হয়ে গেলো। পাক বাহিনী যে কতটা নিষ্ঠুর ছিলো তা এই একটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায়।
তারপর ইপিআর ক্যাম্পেও তাদের একটা নির্যাতন সেল ছিলো। এ ছাড়া গ্রামে-গঞ্জে যেখানে যেখানে তারা বাংকার বা ঘাঁটি করতো- সেখানেই মানুষের ওপর বিশেষ করে মেয়েদের ওপর তারা নির্যাতন চালাতো। রাতে তারা কোথাও থাকতো না। সন্ধ্যার মধ্যে সব চলে এসে বাংকারে থাকতো এবং মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করতো। আমরা বহু বাংকার দেখেছি যেখানে মেয়েদের শাড়ি, চুড়ি, ব্লাউজ ছিলো অসংখ্য। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। আটোয়ারিতে এক পাগলীর সাথে আমাদের দেখা হয়েছিলো। পাকিস্তানিদের বার বার নির্যাতনের ফলে এক পর্যায়ে সে পাগল হয়ে যায়। স্বাধীনতার পরও সে বেঁচে ছিলো এবং বলতো, ‘আমাকে তোরা ব্যবহার করবি নি ? খাবার দিবি নি’ ? সে ছিলো অর্ধ উলঙ্গ অবস্থানেয়। মাঝে মাঝেই সে আমাদের কাছে আসতো এবং পাকিস্তানিদের খোঁজ করতো। পাগলী বলতো, আমাকে খাবারও দেবে আবার আমার সঙ্গে খারাপ কাজও করবে।
প্র: মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য ছিলো কি ? এ সম্পর্কে আপনি কি জানেন ?
উ: আমি জানি, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কোনো ছেলেকে ভর্তির ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেছিলো। এ জন্য পাল্টা একটা ইয়ুথ ক্যাম্প গঠিত হয়েছিলো। ক্যাম্পটা পরিচালনা করতেন মোজাফফর আহমদ এবং কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃবৃন্দ। ক্যাম্প টা ছিলো গঙ্গারামপুরে। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যান্য দলের ছেলেদের এখানে রিক্রুট করা হতো। এরপর তাদেরকে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হতো। ভারত সরকারের সাথে বাম নেতারা যোগাযোগ করেই আলাদাভাবে ক্যাম্প তৈরি করেছিলো। এ সব ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে গেছে এবং যুদ্ধ করেছে।
প্র: ১৯৭১ সালে ঠাকুরগাঁও-য়ে রাজাকার বাহিনীর ভূমিকা কি ছিলো ?
উ: এ সময় পাকিস্তানি আর্মি রাজাকার হিসাবে অনেককে রিক্রুট করেছিলো। আমাদের এলাকাতেও করেছিলো। আমি এই মুহূর্তে তাদের নাম বলতে পারবো না। তবে তাদের অনেকেই জামাতে ইসলাম এবং মুসলিম লীগের সমর্থক বা কর্মী ছিলো। এ ছাড়াও অনেককে তারা রিক্রুট করেছিলো। আমি তাদেরকে চিনি, কিন্তুএই মুহূর্তে তাদেরও নাম বলবো না। তারা মূলত: লুণ্ঠন, মেয়েদের উপর অত্যাচার এবং পাকিস্তানি আর্মিদের সহযোগী হিসাবে তাদের বিভিন্ন ধরনের রসদ যোগান দিতো।
প্র: ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিসেনা কর্তৃপক্ষ শান্তি কমিটি গঠন করেছিলো। ঠাকুরগাঁও এলাকায় এ সব কমিটিতে কারা ছিলো এবং তাদের ভূমিকা কি ছিলো ?
উ: সে সময় ঠাকুরগাঁও পঞ্চগড়সহ পুরো এলাকায় মহকুমা, থানা এবং ইউনিয়নভিত্তিক শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন মূলত: মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলাম দলীয় সদস্যরা। তাদের নাম আমি জানি। তাদের কেউ কেউ মারা গেছেন, কেউ কেউ বেঁচে আছেন। ওনাদের নাম এখন আমি বলতে চাচ্ছি না।
প্র: স্বাধীনতার পর নিজ এলাকায় ফিরে এসে আপনি এলাকার অবস্থানে কেমন দেখলেন ?
উ: ৪ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও মুক্ত হয় এবং তারপরই আমরা চলে আসি। আমরা যা দেখেছি তাকে সম্পর্ন একটা ধ্বংসস্তুপ বলা যেতে পারে। আমাদের এলাকায় পাকা বাড়ি তো খুব বেশি ছিলো না। ঘরের চাল পর্যন্ত তারা খুলে নিয়ে গিয়েছিলো। পাকা বাড়ি থেকে আসবাবপত্র, দরজা-জানালা সবকিছু তারা খুলে নিয়ে গিয়েছিলো। কারো কিছু ছিলো না। গরু, ছাগল, ভেড়া সবই তারা লুট করে নিয়ে গিয়েছিলো। আমাদের বাড়ির আসবাবপত্র বলতে কিছুই ছিলো না। দেশ স্বাধীনের পর লুট করা অনেক মালামাল আমরা পাকিস্তানি সহযোগীদের বাড়ি থেকে বা বিভিন্ন পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করেছিলাম। উদ্ধার করা মালামাল ঠাকুরগাঁও বি. ডি. হলে রাখা হয়েছিলো। যারা তাদের জিনিসপত্র সনাক্ত করতে পেরেছিলো তারা তাদের জিনিষপত্র নিয়ে গিয়েছিলো। বাকিগুলো আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গ কাকে কি দিয়েছেন আমরা তা জানি না। এই ডিস্ট্রিবিউশনের ব্যাপার থেকেই আমাদের ভূমিকা আস্তে আস্তে কমে গেলো। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে, স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত আমরা সবাই প্রতিটি কর্মকান্ডে এক সাথে ছিলাম। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পর রাজনীতি যখন এখানে প্রতিষ্ঠা লাভ করলো, আবার যখন নির্বাচন হলো তখন আমরা আস্তে আস্তে বিভিন্ন কর্মকান্ড থেকে সরে গেলাম বা সরে যেতে বাধ্য হলাম বলা যায়।