রবিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০০৭

গল্পঃ যন্ত্রমানব

কোন মন্তব্য নেই :
সদ্য ইস্ত্রি করা সাদা সার্টের সাথে হালকা ছাই রঙের স্যুট পরা মাহমুদের অবাক হবার পালা। এত্ত সুন্দর টয়লেট ! ঢুকেই মনেই হয় না যে সে টয়লেটে এসেছে। এখানে আবার টয়লেটকে বলে ওয়াশরুম।

ঝকঝকে আয়নায় আলতো হাতে চুল ঠিক করেছে আর ভাবছে এখানে চাকুরিটা হলে কতো কিছুই না সে করবে। প্রথমেই বাবার ঘরের খাটটা বদলাতে হবে। একটা নতুন ফ্যানও কিনতে হবে।

"হ্যালো, আমি মাহমুদ, আপনি ?"বলেই হাত বাড়িয়ে দেয় সে একটু আগেই ওয়াশরুমে ঢোকা ছেলেটার দিকে। ছেলেটা তার সাথেই ইন্টারিভিউয়ে এসেছে। আজ ইন্টারভিউয়ের লাস্ট ফেইজ।

"আমি জিসান", নিরাসক্ত ভংগিতে হাত বাড়িয়ে দেয় সে মাহমুদের দিকে।আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং এ এম.বি.এ , দু বছর কাজ করেছি স্কয়ারে, বি.আই.এম থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা , ইন্টারভিউয়ে স্কোর করেছি ৯৯.৫ /১০০ । হড়বড়িয়ে বলেই মাহমুদ তাকালো জিসানের দিকে।

"ইউটি-অস্টিন '০৫ এলামনি, দু বছর কাজ করেছি স্টেটসে। ৯৭/১০০ "
একমাত্র প্রতিদ্বন্ধির এমনতরো কাঠকোঠ্ঠা উত্তর শুনে মাহমুদ তো অবাক।
জিসান বার বার ঘড়ি দেখছে। একটু পরেই জানা যাবে কে পাচ্ছে চাকরিটা।

"আচ্ছা , কিছু শুনতে পারছেন ??" বলেই মাহমুদ ছুঁটে গেলো পাশের টয়লেটের দিকে। বুঝতে পারছে কিছু একটা হচ্ছে সেখানে । দরজা ভেঙে ঢুকতেই দেখে হালকা পাতলা গরনের একলোক গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
"ওহ মাই গড" বলে চিৎকার করে উঠলো মাহমুদ।
"ধরুন, ধরুন , আমি উঁচিয়ে ধরছি আপনি ফাঁসা খুলে ফেলুন " এক নিশ্বাসে এ কথা বলেই মাহমুদ জড়িয়ে উঁচু করে তুল্লো লোকটিকে। জিসান একরাশ অনিচ্ছা নিয়ে লোকটির ফাঁসা খুলতে লাগলো।

লোকটিকে নামিয়ে মাহমুদ লোকটিকে জড়িরে ধরে মেঝেতে নামিয়ে ধরে বলে উঠলো জিসান আপনি কি এখনি বাহিরে গিয়ে কাউকে বলবেন হাসপাতালে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে। জিসান হাত ঘড়ি দেখে বল্লো "আর ১ মিনিট পরই ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে যেতে হবে। এরা নিঃশ্চই লেট কামার দের চাকরি দেবে না।"

মাহমুদ কিছু না বলেই লোকটির পাশে বসে পড়লো, জড়িয়ে ধরে নিজের মায়ের কথা ভাবছে। মাও এভাবে একদিন গলায় ফাঁস দিয়েছিলো। আজ আর এ লোকটিকে মরতে হোলো না। তাকিয়ে দেখে জিসান নেই।
*******
মাহমুদ তাকিয়ে দেখছে ওয়াশরুমের দরজা খুলে সিইও ঢুকলেন। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে যে লোকটি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলো সেও দাঁড়িয়ে গলায় হাত বুলোচ্ছে, মুখে বিব্রত হাসি।
সিইও কাছে এগিয়ে এসে কাঁধে হাত দিয়ে বল্লেন " থ্যাংক ইউ মাই সান, ইউ আর রিয়েলি এ রিয়েল ম্যান"।
মাহমুদ কিছুই বুঝতে পারছে না। কি হচ্ছে এসব ?
দরজা খুলে জিসান ঢুকতেই সিইও বল্লেন " সব কিছুই সাজানো , ইন্টারভিউয়ের অংশ হিসেবেই এটি একটি নাটক "।
মাহমুদ হাসি মুখে সিইওর দিকে তাকালো। ভাবছে বাবার নতুন খাটের সাথে সাথে একটা নতুন ফ্রিজ কিনলে কি রকম হয় !

সিইও জিসানের দিকে হাত বারিয়ে বল্লেন " ওয়েলকাম মি.জিসান ইউ আর আওয়ার নিউ ব্রান্ড ম্যানেজার , ওয়েলকাম টু ব্যাট বাংলাদেশ ", উই নিড রোবট নট হিউম্যান বিইং"।
---------------
কিছুদিন আগে নরওয়ের একটা শর্ট ফিল্ম দেখেছিলাম, গল্পের আইডিয়াটা সেখান থেকেই পাওয়া।

শুক্রবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৭

এলিজি টু রুবি আক্তার

কোন মন্তব্য নেই :
সমকালের শেষের পাতায় ছোট্ট ১ কলামের একটি নিউজ। বড্ড অবহেলায় ছাপা একটি নিউজ। রুবি আক্তার রাতের সিফট শেষে বাড়ী ফেরার পথে ধর্ষিত হোন। একদল সন্ত্রাসী রুবিকে পথিমধ্যে থেকে অপহরণ করে জামগড়া গফুর মন্ডল স্কুল এন্ড কলেজের মাঠে নিয়ে গিয়ে পালাত্রক্রমে ধর্ষণ করে। ধর্ষণ শেষ ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যার পর সন্ত্রাসীরা লাশ সেখানে ফেলে রেখে যায়।

১৬৫০ টাকার বেতনের এক শ্রমিক ধর্ষিত হয়ে মারা যাবার খবর বিশাল করে ছাপার কি আছে !! আরে বাবা এতে অবাকের কি আছে ? গার্মেন্টসের এক শ্রমিক ধর্ষিত হয়ে মারা গিয়েছেন , এতো নিত্যদিনের ঘটনা।

শেরাটনে বিজিএমইএ এর ১৬৫০ টাকা প্রতি প্লেটের বার্ষিক ডিনার পার্টিও এর চাইতে বড় কভারেজ পায়। আর পাবেই না কেনো !! বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ফরেন কারেন্সি আনছেন উনারা। পত্র-পত্রিকায় লাখ টাকার বিগ্যাপন দেন উনারা। এরাই দেশের শাষক, এরাই জাতির বিবেক , এরাই সুশিল সমাজ।
আর এই শ্রমিকরা কি করে ? দুই দিন পর পর বকেয়া বেতন বোনাসের জন্য আন্দোলন করে। বড্ড অবুঝ এরা। বড্ড বিশৃংখল এরা।
রুবি আক্তাররা রাত দিন কাজ করেন। নিয়মিতই ওভার টাইম। শিপমেন্ট ধরতে হবে না !! তবে বেতনটাই শুধু নিয়মিত হয় না, এই যা। প্রতিবাদ করলেই ছাঁটাই।

বেতন পান ১৬৫০ (মালিক পক্ষের আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা সর্বনিম্ন বেতন ১৬৫০ টাকা )। তাও যদি নিয়মিত পান !!

ছোট্ট এক রুমে ৪/৫ জনে গাদাগাদি করে থাকা। ভাগা-ভাগী করে আলু-চাল-ডালের খিচুড়ী যাদের নিয়মিত মেনু ( বিশ্বাষ হয় না, টংগি-সাভার-মিরপুর-আশুলিয়া বা অন্যান্য যে সব জায়গায় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বেশী সে সব এলাকার মুদির দোকানীদের জিগ্যাসা করতে পারে, তারা কি বেশী বিক্রি করেন গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাছে)।

মাইল-মাইল হেঁটে কাজে যাওয়া ( কয়টা গার্মেন্টসের নিজস্ব ট্রান্সপোর্ট আছে?) বৃষ্টি নেই, বাদলা নেই , কাজে যেতেই হবে। নইলে ছাঁটাই। এপয়েন্টমেন্ট লেটার আবার কি জিনিস এরা জানলেও জানে না।

কারখানায় প্রোডাকশন ম্যানেজার-লাইন সুপারভাইজারদের খবরদারী , সেক্সুয়াল এবিউজ (বিতর্ক আসতে পারে, তবে এটাই নোংরা সত্য)।

রাস্তায় পাড়ার ছেলেদের নোংরা ইভ টিজিং। মাঝে সাজে পাড়ার ছেলেদের লাগানো (এর চাইতে ভালো শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না বলে দূঃখিত)। না লাগাতে দিলে রুবি আক্তারের মতো গণধর্ষন ! পূরুষের নোংরা চোখ এড়ানোর জন্য বোরখা পরেও রক্ষ্যা নেই। পুরুষ যদি চোখে পর্দা না পরে নারী হাজার পর্দা পরুক না কেনো রক্ষা তাদের নেই।

এতো কিছুর পরোও রুবি আক্তাররা টাকা জমান। ছোট্ট বোনের জন্য লাল টুকটুকে শাড়ি বা বাবার জন্য সাদা সস্তা জামা কেনেন বা মায়ের জন্য মিলের ছাপা শাড়ি। টুকটুক করে টাকা জমান ভবিষ্যতের জন্য।

রক্ত পানি করে যে শার্টের জন্য এরা যে ১ সেন্ট (অনেকে বলেন ১৭ সেন্ট) পান, সেই শার্ট বিক্রি করে মালিকরা লাভ করেন ১ ডলার।

রুবি আক্তাররা বৃষ্টির পানিতে ভেজেন,
রুবি আক্তাররা টিয়াস গ্যাসে কাঁদেন,
রুবি আক্তাররা গুলি খান,
রুবি আক্তাররা একাকী কাঁদেন,
রুবি আক্তাররা ধর্ষিত হোন,
রুবি আক্তাররা খুন হোন,
ঠিকানা হয় অজানা।

আজকের খবরটা পড়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে। নিয়মিত এ রকম খবর পড়তে পড়তে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, বিবেক ভোঁতা হয়ে গিয়েছে, তবুও কেমন জানি লাগছে। রুবি আক্তার যদি আনিসুল হকের মেয়ে হতো বা লতিফুর রহমানের মেয়ের মতো ধর্ষিত ও খুন হতো তবে পত্রিকার পাতায় পাতায় কতো বিশাল খবরই না হতো। রুবি আক্তাররা আসলেই অচ্যুত এ দেশে। আজতো রুবি আক্তার যদি আমাদেরই কারো ছোট্ট আদরের বোন বা আমাদেরই কারো প্রেয়সী হতে পারতো।

রুবি আক্তার বয়স ১৮,
হেলপার , এনভয় গার্মেন্টস।
স্থায়ী ঠিকানাঃ ঘিওর, মানিকগঞ্জ ।
অস্থায়ী ঠিকানাঃ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ।
ভবিষ্যত ঠিকানাঃ অজানা।

"রুবি আক্তার" অজানা বোন আমার। ব্লগের পাতায় লেখা ছাড়া আর কিচ্ছুই করতে পারি না আমি। বড়ই অসহায় আমি। গলাবাজী , কলমবাজী করা ভন্ড আমি। তোমার এ চরম অপমান ও হত্যার বিচার তুমি পাবে কি না জানি না, তবে পরজন্মে পাবেই পাবে। এই কামনা করা ছাড়া এই অসহায় মানুষটির আর কিছুই করার নেই।

রুবি আক্তারের প্রতি আমার এই এলিজি।
ভালো থেকো রুবি আক্তার।
ভালো থেকো।

রবিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০০৭

শিকার

কোন মন্তব্য নেই :
ছোট্ট বেলা থেকেই শিকারের প্রতি প্রচন্ড ঝোঁক। এয়ারগান দিয়ে হাতে খড়ি , রাইফেল দিয়ে শেষ।

বয়স কতোই বা হবে তখন , এই ১০ কি ১১ বছর হবে আমার তখন। উত্তর বংগের এক কোনায় ছোট্ট এক অজপাড়া গাঁয় থাকি তখন। একবার রংপুর থেকে কিছু অতিথি আসলেন "আইনত নিষিদ্ধ" পাখি শিকারে। গন্তব্যঃ তিস্তার চর। উনারা ছিলেন সমাজের অতি গন্য-মান্য ব্যক্তি, আইনের উর্ধে।চখা-চখি, রাজহাঁস দিয়ে শিকার শুরু বিশাল সাদা বক দিয়ে যার শেষ ।

ছইয়ে ডাকা ছোট্ট নৌকায় তিস্তার চরে চরে ঘুড়ে বেড়ানোর কথা এখনো মনে আছে। কবিগুরু নৌকায় থাকলে হয়তো ২/১টা কবিতা নামিয়ে ফেলতেন, কিন্তু আমাদের ছিল রক্তের নেশা। বন্দুকের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছিলো।

সারাদিন শিকার শেষে পরিতৃপ্ত মনে স্থানীয় চেয়ারম্যানের বাড়ীতে বিশাল বিশাল রুই মাছ ভাজা, ঝাল খাসীর মাংস , সাথে গরম গরম সরু চালের ভাত খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি আমরা, কিন্তু মনোঃকষ্টে ভুগি রাজহাঁস শিকার না পাবার দূঃখে।

বাসায় এসে গরম গরম ভাতের সাথে চখার মাংসের ভুনা। সাথে এক টুকরো পাতি লেবু। অসাধারন।

অনেক শিকার করেছি জীবনে। হাতের সই অসাধারন ছিলো একসময়। হাতে অস্ত্র উঠলে অন্য রকম কিছু মনে হতো নিজেকে। খুনের নেশা চেপে যেতো। আসলেই অস্ত্র মানুষকে পরিবর্তন করে দেয়।
--------------
বিঃদ্রঃ আমি এখন আর শিকার করি না, প্রচন্ড ঘৃনা করি এ জিনিসটাকে। তবে ঢাকায় থাকলে মাঝে মাঝেই অস্ত্রটাতে মাঝে সাঝে হাত বুলাই পরম মমতায়, নিজের মাঝে পরিবর্তনটা টের পাই ঠিক তখনই। নিজের কাছেই নিজেকেই ভয় লাগে তখন।
আসলেই অস্ত্র মানুষকে পরিবর্তন করে দেয়।