রবিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১২

ঠাকুরগাঁও-এ মুক্তিযুদ্ধ

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। স্বাধীনতার পক্ষে ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে ভাষণ দেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষও ঢাকার সংবাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলো। তখন ঢাকা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র এখানে পৌঁছতো পরের দিন। প্রাপ্ত তথ্য ও সংবাদের ভিত্তিতে ঠাকুরগাঁও শহরের জনসমাবেশ, মিছিল-মিটিং তথা সার্বিক আন্দোলন আস্তে আস্তে দানা বেঁধে উঠছিলো। আওয়ামীলীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি এবং তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোর ডাকে আহুত কর্মসূচীতেসাড়া দিয়ে পথে নেমেছিলো ছাত্র-জনতা-কৃষক-শ্রমিক। কাড়িবাড়ি হাটের দক্ষিনে ওয়াপদা আবাসিক এলাকা থেকে উত্তরে টাঙ্গনের পাড়ের রিভারভিউ হাইস্কুল, পশ্চিমে ঠাকুরগাঁও কলেজ থেকে পূর্বে বাসষ্ট্যান্ড পর্যন্ত প্রায় ৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট সাজানো গোছানো শহরটা টগবগিয়ে ফুটছিলো জনতার উত্তাল শ্লোগান আর মিছিলে। সকালের নাস্তা খেয়েই মানুষ এসে জড়ো হতো চৌরাস্তায়। নেতৃস্থানীয়রা বসতেন পেল্টু বাবুর চায়ের দোকানে।
৩ মার্চ বিকেলে স্থানীয় ফুটবল মাঠে তৎকালীন মহকুমা আওয়ামীলীগের সভাপতি আব্দুল লতিফ মোক্তারের সভাপতিত্বে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে মহকুমার তৎকালীন ১০ টি থানার বিভিন্ন পেশা ও রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দসহ শহরের বেশিরভাগ মানুষ উপস্থিত ছিলেন। রাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ফজলুল করিম এমপিএ সাহেবের বাসায় মিলিত হন। এখানে ৭১ সদস্য বিশিষ্ট একটি ‘‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’’ গঠন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের কার্যাবলী সমন্বয় ও গণজাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্যে ৩টি উপ কমিটি গঠন করা হয় যার একটি ছিল প্রতিবেশী দেশ ভারতের নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে যেন সহায়তা পাওয়া যায়। এই উপ কমিটির দায়িত্বে ছিলেন এ্যাডভোকেট বলরামগুহ ঠাকুরতা এবং আব্দুর রশীদ মোক্তার।
৪ মার্চ তারিখের মিছিলে স্থানীয় মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল বেশ স্বত:স্ফুর্ত যা পরবর্তী সময়ের আন্দোলনকে তরান্বিত করেছিলো। এদিন ফুটবল মাঠে সভা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে প্রতি থানা থেকে ৩০০ জন নেতাকর্মীকে ৭ মার্চের রেসকোর্সের জনসভায় যোগদানের জন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৫ মার্চ চৌরাস্তা ও পাবলিক লাইব্রেরী মাঠে গণমজায়েতের পর রেলপথে বিভিন্ন সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের প্রায় ৫০০ নেতাকর্মী ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
৭ মার্চ তারিখের বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণের পরিপূর্ণ  বিবরণ সেদিন শহরবাসী না জানলেও ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ কথাটি শুনে উজ্জীবিত হয়েছিলো। ৮ মার্চ রেডিওতে প্রচারিত ভাষণ শোনার পর শহর উত্তাল বিক্ষোভে গর্জে উঠেছিলো। যারা ৭ মার্চ তারিখের জনসভায় যোগ দিতে ঢাকা গিয়েছিলেন তারা ফিরে আসেন
৯ মার্চ। যে কোন একজন নিয়ে এসেছিলেন ঐতিহাসিক ভাষণের ক্যাসেট। এমপিএ ফজলুল করিম সাহেবের বৈঠকখানা থেকে মাইকে শুরু হয় ক্যাসেট বাজানো। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে এ ছিল যেন এক যাদুর বাঁশী। মানুষ ছুটে আসছিলো আর শুনছিলো সেই ভাষণ। অবিরাম এই গতিধারা চলছিলো তারপর থেকে।
ঐ দিনই ঠাকুরগাঁও কলেজের তৎকালীন ভিপি মোহাম্মদ আলীকে আহবায়ক করে একটি ‘‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’’ গঠন করা হয়। এছাড়া কেবল ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে গঠন করা হয় ‘জয়বাংলা’ বাহিনী যার নেতৃত্বে ছিলেন আনসারুল হক জিন্নাহ। একই দিন এস,এম আজিজুল হকের নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী।
১০ মার্চ তারিখে শহরের সর্বত্র কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের আহবানে হাইস্কুলের শিক্ষক এম, ইউসুফ এগিয়ে আসেন ছাত্র যুবকদের রাইফেল ট্রেনিং দিতে। তিনি ছিলেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। রোভার স্কাউট এবং ইউ.ও.টি.সি ক্যাডেটদের জন্য নির্ধারিত ৫০ টি ডামী রাইফেল দিয়ে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। সকালে হাইস্কুল মাঠে এবং বিকেলে পাবলিক লাইব্রেরীর মাঠে প্রশিক্ষণ চলে প্রায় ২০০ ছাত্র-যুবকের।
১১ মার্চ বৃহস্পতিবার, তৎকালীন এমপিএ এ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম ঢাকা থেকে ফিরে জনতার মিছিলে যোগ দেন এবং তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তসলিম উদ্দিন আহমেদকে ছাত্র-জনতার সাথে একাত্ম হয়ে আন্দোলনকে গতিশীল ও সার্বিক সহযোগিতা করতে আহবান জানান। ৭ মার্চের ভাষণের পর দেশের প্রায় জেলখানাই খুলে দেয়া হয়েছিলো কয়েদীদের বের হয়ে আন্দোলনে শরীক হতে। তারই ধারাবাহিকতায় ঐদিন ঠাকুরগাঁওয়ের জেলখানা খুলে দেয়া হয় এবং কয়েদীরা অনেকে আন্দোলনে শরীক হয়।
১২ মার্চ তারিখে মহিলা আওয়ামীলীগের উদ্যোগে মহিলাদের একক মিছিল বের হয়। মিছিলে মুর্শেদা করিম, সৈয়দা জাহানারা, শক্তি বর্ধন, দীপ্তিবর্ধন, শান্তি রাণী ঘোষ, লায়লা শামীম রোজী, কামরুন্নাহার জলি, মিসেস ফরিদা লতিফ, রুবি, মঞ্জু ইসলাম, ছবি সেন গুপ্তা, ভারতীয় গুহ ঠাকুরতা, উষাদি, শরীফা সাত্তার, কালী বাবুর স্ত্রী ও গোসাইবাবুর স্ত্রী অক্লান্ত পরিশ্রম করে মহিলাদের সংগঠিত করেছিলেন। মহিলাদের হাতে ছিল দা, বটি ও ঝাড়ু। ভাবতে অবাক লাগে মহিলাদের এই মিছিলে স্থানীয় উপজাতি মহিলারাও তীর ধনুক হাতে অংশ নিয়েছিলো।
১৫ মার্চ তারিখে প্রকাশিত ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকায় প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর একটি বিবৃতি ও দেশের প্রশাসন ব্যবস্থা চালু রাখার জন্য জারীকৃত ৩৫টি বিধির আলোকে ঠাকুরগাঁওয়ের সব সরকারী-আধা সরকারী অফিস আদালত এবং ব্যাংক-বীমা তাদের কাজ চালাতে শুরু করে।
১৬ মার্চ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন রাইফেল ট্রেনিং, গণজমায়েত, মিছিল এবং বিকেলে পাবলিক লাইব্রেরী মাঠে জনসভা ও সন্ধ্যায় দেশাত্ববোধক গান, গণসংগীত ও বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্থানীয় বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-ছাত্রী ও সংগীত শিল্পীগণ এতে অংশ নিয়েছেন।
এদিকে ২৩ মার্চকে সামনে রেখে ব্যাপক তোড়জোড় শুরু হয় বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত নতুন পতাকা তৈরী করে উড়ানোর। ফালু খলিফার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ৬/৭ দিনেই তৈরী হয়ে যায় প্রায় ১০০০ পতাকা। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এসব পতাকার কাপড় সরবরাহ করেছিলেন। একই সাথে মহকুমার অন্য ৯টি থানাতেও আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারণ করেছিলো। স্থানীয় প্রগতিশীল ও স্বাধীনতার স্বপক্ষের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নিজেদের এলাকায় জনমত গঠন, মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করেছেন। ঠাকুরগাঁও শহর থেকে সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এসব সমাবেশে গিয়ে ভাষণ দিয়েছেন।
২২ মার্চ তারিখে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ গণমিছিল বের হয়। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, কৃষক সমিতির সব অঙ্গসংগঠন, ঠাকুরগাঁও সুগার মিল, ওয়াপদার শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ এতে অংশ নেন। সন্ধ্যায় বের হয় মশাল মিছিল। রাতেই বিতরণ করা হয় নতুন পতাকা।

২৩ মার্চকে আগেই ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালনের। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। এস, এম আসগর আলী এবং জর্জিসুর রহমান খোকাসহ বিপুল সংখ্যক ছাত্রজনতা ২৩ মার্চের সূর্যোদয়ের সাথে সাথে মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে পতাকা উড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে রাত কাটান ফজলুল করিম সাহেবের কাচারিতে। প্রত্যুষে দলবল নিয়ে মিছিল সহকারে রেজাউল হক বাবুলসহ তিনজনে মিলে মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ের উপর পতাকা উত্তোলন করেন। নিচে অগনিত মানুষ। এরপর থানা ভবনে গিয়ে পতাকা উত্তোলনে অবাঙালী প্রহরী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হলেও তৎকালীন ওসি আবদুল গফুর নিজেই পতাকা উত্তোলনের ব্যবস্থা নেন।
২৪ মার্চের গণ মিছিল ও গনজমায়েতসহ সর্বত্র শোভা পাচ্ছিলো নতুন পতাকা।
২৫ তারিখে মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে কে যেন পাকিস্তানী পতাকা উড়িয়েছিলো এবং পরে তা নামিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলো উত্তেজিত জনতা। সেখানে আবারো টানিয়েছিলো বাংলাদেশের পতাকা।
২৬ মার্চ সকাল থেকেই ঢাকার সাথে টেলিযোগাযোগ সম্ভব হচ্ছিলো না। মিছিল মিটিং আগের মতোই চলছিলো। আকাশবাণী, বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা থেকে যাবতীয় খবর অবগত হয়েছিলো সবাই। ২৫ মার্চের অপরাশেন সার্চলাইট শুরু হবার পর থেকে বাঙালী নিধন ও আন্দোলন নস্যাত করতে পাকিস্তানী শাসকদের কার্যক্রম প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশ পায়। শাসকগোষ্ঠীর অধীনে সেনাবাহিনী, তৎকালীন ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত বাঙালী ও অবাঙালীদের পৃথকীকরণের কার্যক্রম চলে। এরই ঢেউ এসে লাগে ইপিআর এর দিনাজপুর সেক্টরের অধীনে ঠাকুরগাঁয়ের ৯ম উইং-য়ে। ঠাকুরগাঁওস্থ ৯ম উইং-এর কমান্ডার ছিলেন পাঞ্জাবী অফিসার মেজর মোহাম্মদ হোসেন এবং সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন অবাঙ্গালী ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম। দিনাজপুর সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন পাঞ্জাবী অফিসার লে: কর্ণেল তারেক রসূল কোরাইশী। ৯ম উইং-এর বাঙালীদের মধ্যে সবেচেয়ে বড় অফিসার ছিলেন সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন এবং সাধারণ সিপাহীদের সিংহভাগই ছিলেন বাঙালী। সত্তরের নির্বাচনের সময় থেকে প্রচুর সামরিক সম্ভার নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৬ তম এফ,এফ এর একটি কোম্পানী দিনাজপুর সার্কিট হাউজে অবস্থান করছিলো। তারা সারাদেশে যোগাযোগের জন্য কুঠিবাড়ি ইপিআর ক্যাম্পে একটি শক্তিশালী ওয়্যারলেস সেট স্থাপন করেছিলো। ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে অবাঙালী এসব অফিসার ও জোয়ানদের গোপন তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছিলো। ২৫ মার্চ তারিখে মেজর মোহাম্মদ হোসেন ছিলেন পঞ্চগড় এলাকার সীমান্ত চৌকি পরিদর্শনে। দিনাজপুর সেক্টরের জরুরী বৈঠকে যোগ দেন ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম। বৈঠকটি হয় অত্যন্ত গোপনীয় এবং সেখানে বাঙ্গালী অফিসার ও জোয়ানদের ভৎর্সনা করা হয়। ২৬ মার্চ সকালে মেজর মোহাম্মদ হোসেন ও ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম একত্রিত হয়ে উইং-এর সব জেসিওদের মিটিং ডাকের। মেজর সাহেব সমবেত সবাইকে পাকিস্তান সরকারের জারীকৃত ফরমান পাঠ করে শোনান ও বাঙালীদের আন্দোলনের প্রতি কটাক্ষ করে বক্তব্য রাখেন। মনে মনে প্রতিশোধ গ্রহণের প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোন বাঙ্গালী জেসিও কোন কথা বলতে পারেননি। তাদের কাছে বাইরের পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ অজানা।

উইং কমান্ডারের নির্দেশে ইপিআর-এর টহল শুরু হয়। জনতা রাস্তায় রাস্তায় বেরিকেড দেয়া শুরু করে। ইপিআরদের টহল গাড়ীতে এদিন বাঙালি ও অবাঙালি উভয়ই ছিলো। বেরিকেড সরিয়ে তাদের টহল চলছিলো। ২৬ তারিখ সন্ধ্যায় মাইকিং করে সারা শহরে সান্ধ্য আইন বা কার্ফূ জারি করা হয়। কিন্তু কে শোনে কার নির্দেশ। উত্তাল জনতা কার্ফূ ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। সবারই লক্ষ্য কন্ট্রোল রুম থেকে কি নির্দেশ আসে। কিন্তু ঢাকার সাথে কোন যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছিলো না নেতৃবৃন্দের। অনেকের মুখে শোনা যাচ্ছিলো সংগ্রাম পরিষদের অব্যবস্থার কথা। এ সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ২৬ মার্চ সবার রাত কাটে ভীতিকর অবস্থায়। তবুও রফিউল এহসানের বাসায় নেতৃবৃন্দ গোপনে বৈঠকে বসেন রাতে।

পরদিন ২৭ মার্চ। কার্ফূ ভঙ্গ করে যথারীতি জনতার ভিড় হয় ফজলুল করিম সাহেবের কাচারির বা কন্ট্রোল রুমের সামনে। সেখান থেকে বের হয় মিছিল। সাউথ সার্কুলার রোড (চৌরাস্তা থেকে কালী বাড়ী মোড় পর্যন্ত) ধরে মিছিল এগিয়ে চলে কালী বাড়ির দিকে। ওদিকে ইপিআর ক্যাম্প থেকে একটা জীপে করে শহরের পরিস্থিতি দেখতে বের হয় মেজর মোহাম্মদ হোসেন, সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন এবং ক্যাপ্টন নাবিদ আলম। তাদের পেছনের পিকআপ গাড়িতে ছিল ৮/১০ জন ইপিআর।
একদিকে মাইকে ৭ মার্চের ভাষণ অন্যদিকে মিছিলের নানা শ্লোগানের এক পর্যায়ে কেরামত আলী মোক্তার সাহেবের বাসার সামনে আসে মিছিল। এখানে মুখোমুখি হয় মেজরের জীপ, টহলদার পিকআপের এবং জনতার। ঠাকুরগাঁয়ের তৎকালীন সিও ডেভ (যিনি ১৯৭০ থেকে ঠাকুরগাঁয়ে কর্মরত ছিলেন) আবদুল ওহাব আন্ধার মানিক ১৯৭২ সালে তার ‘অমর কাহিনীকার’ নামক গ্রন্থে ‘শহীদ মোহাম্মদ আলী সড়ক’ নামক সংবেদনশীল নিবন্ধে লিখেছেন-‘‘বেলা ১২ টা বেজে ১০ মিনিট। কেরামত আলী মোক্তার সাহেবের বাসার সামনে মিছিলটি এসে থেমে গেল। দক্ষিণ দিক থেকে দ্রুতবেগে ধেয়ে আসছিল একটি জীপ ও এক লরী সৈন্য। মেজরের জীপটা এসেও সামনে থামলো। উইং কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ হোসেন ও ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম জীপ থেকে নামলেন। তাদের দেখে মিছিলে অংশগ্রহণকারী জনতা যেন বারুদের মত জ্বলে উঠলো। মিছিল থেকে অসীম সাহসী, বলিষ্ঠ দেহী, মুখে চাপদাড়ি মধ্য বয়সের মোহাম্মদ আলী নামের এক রিকসাচালক সবার সামনে চলে আসে। মেজর মোহাম্মদ হোসেনের সামনে গিয়ে দৃপ্ত ও অকুতোভয়-স্পষ্ট আওয়াজে চিৎকার দিয়ে ওঠে-জয়বাংলা। সাথে সাথেই পরপর তিনটা গুলির শব্দ হলো। একটা বিকট চিৎকার দিয়ে লুটিয়ে পড়লো একটি দেহ। ‘‘ঠাকুরগাঁয়ের প্রথম শহীদ মোহাম্মদ আলী।’’ গাড়ীতে উঠে মেজর তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে ইপিআর ক্যাম্পে ফিরে গেল।

পাঞ্জাবী মেজরের এহেন বর্বরোচিত কর্মকান্ডে তাৎক্ষণিকভাবে মিছিল ও জনগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও কয়েক মিনিটের মধ্যে আবার জড়ো হলো। খবর ছড়িয়ে পড়লো গোটা শহরে। জনতা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো রাস্তায়। এবার সিদ্ধান্ত হলো ইপিআর ক্যাম্প আক্রমনের। শহীদ মোহাম্মদ আলীকে রাস্তার পূর্বপাশেই দাফন করা হলো। মেজর মোহাম্মদ হোসেন ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে পরিস্থতি সামাল দেবার জন্য সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে তিন লরী ইপিআর প্রেরণ করে। ওদিকে শোকে বিহবল জনতার মিছিল ধেয়ে চলছিলো ইপিআর ক্যাম্পের দিকে। অবস্থার ভয়াবহতা চিন্তা করে কাজিমউদ্দিন নিচে নেমে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় সামনের সারির কয়েকজন নেতার সাথে কথা বলেন এবং তাদের পরিকল্পনা ও পরিস্থিতির বর্ণনা দেন। জনতা শান্ত হয়। মিছিল আবারো ফিরে আসে। রাস্তায় রাস্তায় বড় বড় গাছ কেটে বেরিকেড তৈরী হয়। সন্ধ্যায় আবারো কার্ফূ্য জারী করা হয় মাইকে। ক্যাম্পের মধ্যে সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন গোপন আলোচনায় বসেন সুবেদার হাফিজ, সুবেদার আতাউল, নায়েব সুবেদার মতিউর রহমান, হাবিলদার আবু তালেব ও নায়েক আব্দুল হাকিমকে নিয়ে।

২৮ মার্চ রোববার। প্রচন্ড রোদের মধ্যেও আবারো মিছিল-বিক্ষোভ। মিছিল গিয়ে জনসভায় রূপ নেয় ঠাকুরগাঁও হাইস্কুল মাঠের অশ্বত্থ তলায়। এফ,এ মোহাম্মদ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ভাষণ দেন আসগর আলী, আনোয়ার হোসেন, জর্জিসুর রহমান, রেজাউল হক, বজলার রহমান, আবদুল লতিফ মোক্তার, আবদুর রশীদ মোক্তার এবং সিরাজুল ইসলাম এমপিএ।
জনসভায় ঘোষণা করা হয় আজ থেকে কন্ট্রোলরুম করা হলো- এসডিও অফিসের সামনের বটতলায় দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট একটি টালীর ঘরকে। মিটিং শেষে মিছিল করে জনতা সেখানে যায়। তখন বেলা ৩টা। ইপিআরের একটি টহল গাড়ি গোয়াল পাড়ার কাছ দিয়ে যাচ্ছিলো। গাড়ি দেখে পশ্চিম পাশে একটি কুঁড়ে ঘর থেকে একটি ৭/৮ বছরের শিশু চিৎকার দিয়ে উঠেছিল ‘জয়বাংলা’। চিৎকারের শব্দ লক্ষ্য করে টহল গাড়ি থেকে রাইফেলের গুলি ছোড়া হলে ঘটনাস্থলে নিহত হন হলপাড়ার সন্তুকী চৌহানের শিশু পুত্র নরেশ চৌহান-পাঁচ মিনিট আগেই যে আরেকটি শিশুর সাথে রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করছিলো। নরেশ চৌহানকে ধর্মীয় মতে সৎকার করারও সাহস হয়নি তাদের। ভয়ে কেউ এগিয়েও আসেনি। দ্রুত বাড়ির সামনে রাস্তার পূর্বপাশে তাকে সমাহিত করা হয়
এ ঘটনায় শহরবাসী আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ অনেকখানি মুষড়ে পড়েছিলেন। তবুও তারা যোগাযোগ করেন সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিনের সাথে। ওদিকে মেজর মোহাম্মদ হোসেন ও ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম, অবাঙালী ইপিআরদের নিয়ে গোপনে বৈঠক করে রাত পৌনে এগারোটায় সমস্ত বাঙালী সৈন্যদের হত্যা করার পরিকল্পনা করে। এ খবর টের পেয়ে যান সুবেদার হাফিজ। ফলে তাঁরাও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পাঞ্জাবীদের আক্রমণের আগেই আক্রমন চালিয়ে সমস্ত অবাঙালী ইপিআরদের হত্যা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং সেভাবেই কাজ হতে থাকে। 

রাত ১০ টা ১৮ মিনিট। পরিকল্পনা মোতাবেক সুবেদার হাফিজের স্টেনগানটা গর্জে ওঠার সাথে সাথেই অন্যান্য সব বাঙালী সেনাদের কাছে রক্ষিত হাতিয়ারগুলো গর্জে ওঠে। ভীত হয়ে পড়ে শহরের সাধারণ মানুষ। কিন্তু যখন শোনা গেল ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান এবং সাধারণ মানুষকে এগিয়ে এসে সহায়তা করার উদাত্ত আহবান তখন মানুষ ছুটে এলো রাতের অন্ধকার সত্ত্বেও। জনগণ তাদের সাধ্যমত খাবার ও পানি নিয়ে এগিয়ে আসেন। সারারাত এভাবে অবাঙালীদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হলো। পরের দিন খোচাবাড়ীতে সস্ত্রীক ক্যাপ্টেন নাবিদ আলমকে এবং ৩০ মার্চ তারিখে সস্ত্রীক মেজর মোহাম্মদ হোসেনকে তার বাংলোতে হত্যা করা হয়।

২৮ মার্চের রাতের ঘটনার পর আন্দোলন ও সশস্ত্র সংগ্রামের কেন্দ্র বিন্দুতে চলে আসেন সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন। তিনি সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে বসেন ২৯ তারিখে। সামনের দিনগুলোর ভয়াবহতা এবং সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে সাজেয়া বাহিনী ও আকাশ পথে বিমান আক্রমনের সম্ভাব্যতা সকলকে ভীতসস্ত্রস্ত করে তুলে।

২৯ মার্চ সব দিকের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় যে সমস্ত সামরিক ও আধাসামরিক সেনাসদস্য ছুটিতে ছিলেন বা যারা পালিয়ে বেঁচেছেন তারা এসে যোগ দিলেন কন্ট্রোলরুমে। একটা নিয়মিত বাহিনীর মত করে অগ্রগামী দল হিসেবে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করা হলো ভাতগাঁও ব্রীজের কাছে। সে পর্যন্ত রাস্তার পাশ ধরে পরিখা খনন ও গাছ কেটে বেরিকেড তৈরীর কাজ চলে পুরোদমে।

আবারো শুরু হলো রাইফেল ট্রেনিং। এবার আর ডামী দিয়ে নয়। এবার মূল রাইফেল দিয়ে। ইপিআরদের অস্ত্রগারের সমস্ত হালকা অস্ত্র একদিনের মধ্যে চলে আসলো সাধারণ মানুষের হাতে। বিওপিতে কর্মরত অবাঙালী ইপিআরদের নিরস্ত্র ও হত্যা করা হয়। প্রতিরক্ষা ব্যুহতে নিয়োজিত মুক্তিযোদ্ধা ও এদিকে যারা সারা দিনব্যাপী ট্রেনিং দিচ্ছিলো, পরিখা খনন করছিলো, বেরিকেড সৃষ্টিসহ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত ছিল তাদের যথাসময়ে খাবার সরবরাহের জন্য ২টি লঙ্গরখানা খোলা হয়। ডিফেন্সের জন্য খাবার তৈরী হয় ঠাকুরগাঁও সরকারি বালিকা বিদ্যালয় মাঠে- যারা দায়িত্বে ছিলেন নূরুল ইসলাম ছুটু ও ফনি পালিত অন্যটি স্থাপিত হয়েছিলো সাধারণের জন্য সিরাজদ্দৌলা সড়কের বেলতলায়। 

অবস্থা আঁচ করতে পেরে ঐদিনই আওয়ামী লীগ নেতা আকবর হোসেন ও জগন্নাথ গুহ ঠাকুরতা মোটর সাইকেলে তেঁতুলিয়া হয়ে চলে যান শিলিগুড়ি। বাংলা বান্ধার ওপর ফুলবাড়িয়ার কংগ্রেস নেতা চন্ডী বাবুকে নিয়ে তারা তৎকালীন মন্ত্রী অরুন কুমার মৈত্রের বাসায় দেখা করে সঠিক অবস্থা বর্ণনা করেন। সেখানে তখন তেঁতুলিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কামরুল হোসেনের সাথে দেখা হয়। তিনজনে মিলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সহায়তার আবেদন জানান। ভারতীয় লোকজন স্থায়ীভাবে ‘মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম সহায়ক কমিটি’ গঠন করে ১ ট্রাক ভর্তি লবন, কয়েক ড্রাম তেল, চিনি, সিগারেট, ব্যাটারী, ডাল ও সাবান সাহায্য হিসেবে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

ওদিকে দিনাজপুরের কুঠিবাড়ির ৮ নম্বর উইংও বাঙালিদের দখলে আসে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে। ফলে ঠাকুরগাঁও দিনাজপুরের বাঙালি সেনা অফিসারের একত্রে সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার উপায় খুঁজতে থাকলেন। 

বিকেলে আব্দুর রশীদ মোক্তার ও বলরাম গুহ ঠাকুরতা কলকাতা রওয়ানা হয়ে যান সহায়তা প্রাপ্তির আসায় এবং সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন চলে যান ভারতের ৭৫ বিএসএফ কমান্ডের কর্ণেল ব্যানার্জীকে এগিয়ে আসার আমন্ত্রণ জানাতে।

১ এপ্রিল কর্ণেল ব্যানার্জী ঠাকুরগাঁও আসেন। সিরাজুল ইসলাম এমপিএসহ তিনি শিবগঞ্জ বিমান ঘাটি, ইপিআরদের অগ্রবর্তী ঘাঁটি পরিদর্শনসহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দেন। বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকৌশলী মি: রেজা নিজেই ১০ মাইলে স্থাপিত পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন স্টেশনের টাওয়ারে উঠে বিদুৎবাহী তার বিচ্ছিন্ন করে দেন। আবুল হাসনাত ভেলার নেতৃত্বে ঠাকুরগাঁও সুগারমিলের শ্রমিকদের সহায়তায় জনগণ শিবগঞ্জ বিমান বন্দরের রানওয়েতে বিরাট বিরাট গাছ কেটে ফেলে রাখেন।

২ এপ্রিল : শুক্রবার। পাবলিক লাইব্রেরীর মাঠে রাইফেল চালনা প্রশিক্ষণকালে সেখানে এসে সবার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর এম.টি. হোসেন। এদিক থেকে তিনিই যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে যান। কামিজ উদ্দিন তাঁর সহকারী হয়ে থাকলেন। এতে প্রতিরোধ ব্যবস্থায় জীবন ফিরে আসে। সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন আশরাফ ও ক্যাপ্টেন আনোয়ার যোগ দেন দিনাজপুর উইং এর সাথে। ক্যাপ্টেন আশরাফকে ঠাকুরগাঁও উইং এর সাথে যোগ দিতে মির্জা আলমগীর দিনাজপুর যান।

৩ এপ্রিল : শনিবার মেজর এম,টি হোসেন স্থানীয় ডাকবাংলোতে যুদ্ধ পরিচালনা সংক্রামত্ম তাঁর অফিস স্থাপন করেন এবং অধীনস্ত জেসিও এনসিওদের দায়িত্ব বণ্টন করেন। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নতুন মাত্রা যোগ হয়। এলাকার যাবতীয় কার্যক্রম নিয়ে উর্দুতে লিখা একটি চিঠি ধরা পড়ার প্রেক্ষিতে এদিন সবচেয়ে অবাঞ্চিত ঘটনা ঘটে। অবাঙালি জনৈক লোকের হাতে প্রাপ্ত চিঠিতে সব গোপন তথ্য ছিল যা নাকি সৈয়দপুর সেনা নিবাসে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। ফলে অবাঙালি হত্যা শুরু হয়। যা চলে পরবর্তী দুই দিন।

এর পর থেকে ভীতিকর অবস্থা নেমে আসে গোটা শহরে। অবাঙালীদের বাড়িঘরের সব মালামাল এনে জমা করা হয় আদালত প্রাঙ্গণের কন্ট্রোল রুমে। এখানের সঠিক ইনচার্জ কে ছিলেন আর শেষ অবধি কি কি মালামাল পাওয়া গিয়েছিলো তার কোন সঠিক হিসাব বা তথ্য কেউ পরবর্তীতে দিতে পারেননি।

৪ এপ্রিল তারিখ থেকে সাধারণ মানুষ আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। একদিকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার যেমন কোন খবর পাওয়া যাচ্ছিলো না অন্যদিকে অবাঙালি নিধনের জের কিভাবে কার উপর এসে পড়বে তা নিয়ে সবাই আলোচনা করছিলো। আগের দিনের চেয়ে আদালত প্রাঙ্গনে উৎসুক জনতার ভিড় কম মনে হলো। এদিন থেকেই নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তাদের পরিবার পরিজন শহর থেকে গ্রামের দিকে সরিয়ে দিতে শুরু করেন।

৫ এপ্রিল সকাল ১০ টা নাগাদ শহর ছিল প্রায় ফাঁকা। রাতারাতি অধিকাংশ শহরবাসীই তাদের আত্মীয়-স্বজনদের গ্রামীণ এলাকায় সরিয়ে দিয়েছে বলে জানা যায়। ওদিকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বেশকিছু গুজব ছড়িয়ে পড়ে যা ভীতিপ্রদ। ডাকবাংলো থেকে নির্দেশ পেয়ে মাইকে ঘোষণা করা হয় যে, যাদের কাছে রাইফেল আছে তারা যেন তা ডাকবাংলোতে জমা দিয়ে এন্ট্রি করে নেন এবং যুদ্ধে যোগদান করেন।

৬ এপ্রিলের অবস্থা ছিলো আরো নাজুক। কন্ট্রোল রুম খোলার জন্য কোন দায়িত্ববান লোকও পাওয়া যাচ্ছিলো না। শহরের দোকানপাট বাড়িঘর পাহারা দেবার জন্য যারা রাতে ছিলেন তারাও আদালত প্রাঙ্গনে আসতে আসতে দুপুর করে দিয়েছেন। সবার চোখে মুখে ছিল আতংক। ঢাকাসহ অন্য কোন জায়গায়ই কোন সঠিক খবর কেউ দিতে পারতো না। রাতে বিবিসি, বয়েস অব আমেরিকা এবং আকাশবাণীর সংবাদ ছিল মূল আকর্ষণ।

৭ এপ্রিল : বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে দিনটি স্মরণীয়। এদিন ‘দৈনিক বাংলাদেশ’ নামে একটি সংবাদপত্রের প্রকাশ ঘটে। ঠাকুরগাঁও ওয়াপদার কর্মকর্তা কাজী মাজহারুল হুদা-পূর্বের বেশ কয়েকদিনের বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সময়ের তাগিদে জনগণের মনোবল বৃদ্ধি ও ফ্রন্টলাইনের খবরসহ মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বিশ্বজনমত তুলে ধরার ব্যাপারে বেশ কয়েকজনের সাথে আলাপ করেন। ফলশ্রুতিতে স্থানীয় সুলেখা প্রেস থেকে ১/৮ ডিমাই সাইজের ৪ পৃষ্ঠার ৫০০ কপি পত্রিকা ছাপানো হয়। মূল্য ছিল ১০ পয়সা। একটি সংখ্যার ব্যানার হেড ছিল ‘গণচীন একটি কাগুঁজে বাঘ’ যা আকাশবানী থেকে দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায় পাঠ করেছিলেন ও পত্রিকাটির গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন। রাত জেগে গ্রুফ দেখা ও ছাপিয়ে পরের দিন সকালে পাঠকের হাতে তুলে দিতে বেশ বেগ পেতে হতো। এভাবে পর পর ৬টি সংখ্যা বের করা হয়। পত্রিকাটির গ্রহণযোগ্যতা ছিল বর্ণনাতীত। ২য় সংখ্যা থেকে ১০০০ কপি ছাপানো হয়। পরবর্তীতে পত্রিকাটি পশ্চিমবঙ্গের ইসলামপুর শহর থেকে প্রকাশিত হয়। কবি আবুল হোসেন সরকারও কয়েকটি সংখ্যা সম্পাদনা করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের এটিই প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র।

৮ এপ্রিল থেকে ১৪ এপ্রিল : এই সাতদিন ছিল শহরবাসীর সবচেয়ে উৎকণ্ঠার দিন। কয়েকজন ছাত্রনেতা ও কর্মী, কয়েকজন দোকানদার এবং ট্রেজারী ও থানা এলাকায় প্রহরী ছাড়া কেউ রাতে শহরে থাকেননি। সকাল হলে অবস্থা বুঝে সংবাদ নিয়ে তারপর টাঙ্গনের এপাড়ে শহরে ঢুকেছেন সবাই। এসব দিনগুলোতে শহরের ফাঁকা অবস্থা নিরসনে সকলকে নিজ নিজ গৃহে ফিরে আসার আহবান জানিয়ে মাইকে ঘোষণা প্রচার করা হয় ও ফিরে না এলে বাড়িঘর বাজেয়াপ্ত করা হবে বলেও জানানো হয়।

১৪ এপ্রিল রাতে স্থানীয় ‘ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান’ এর ভোল্ট ভেঙ্গে রাতের বেলায় সমস্ত টাকা পয়সা ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। শহরবাসী এ খবর জানতে পারে ১৫ এপ্রিল। পয়সার বাক্সসহ দু’জনকে আটকও করা হয়েছিল। অবশ্য পরে সমস্ত ঘটনা জানা গিয়েছিলো। তথ্যমতে জানা যায় এ টাকা পরবর্তীতে মুজিবনগর সরকারের তহিবলে জমা হয়েছিলো।

১৫ এপ্রিল : বেলা ১১ টা। শহরে রাত যাপনকারী কয়েকজন লোক, কয়েকজন ছাত্র নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন আদালত প্রাঙ্গণে। গ্রাম থেকে লোকজন এখনো পুরোপুরি আসেনি। মাইকে ঘোষনা করা হচ্ছিলো- পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে, আমাদের অগ্রগামী বাহিনী সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টের কাছে পৌছে গেছে ইত্যাদি-ইত্যাদি। হঠাৎ শহরের দক্ষিণ প্রান্তে বিকট শব্দে একটা শেলের বিস্ফোরণ হলো। মানুষ
তখন দিগবিদিক জ্ঞান হারা হয়ে ছুটতে শুরু করলো উত্তর দিকে। সবারই এক উদ্দেশ্য-টাউন ছাড়তে হবে, টাঙ্গন নদীর ওপারে যেতে হবে। গ্রাম থেকে আরো প্রত্যন্ত এলাকা হয়ে সীমান্তে পাড়ি জমানোর উদ্দেশ্যেমূলক নিরুদ্দেশ যাত্রার যাত্রী হয়ে পালাতে লাগলো সবাই। পিছনে তাকিয়ে অনেকেই দেখলো দাউ দাউ করে জ্বলছে এসডিও সাহবের বাংলো। গোটা শহরের আকাশে কেবল আগুনের কুন্ডুলী।


নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে বালিয়াডাঙ্গী, আটোয়ারী, পঞ্চগড় ও হরিপুরের সীমান্ত এলাকা দিয়ে কয়েক হাজার মানুষ আশ্রয় নিলো ভারতীয় শরনার্থী শিবিরে। ২৫ মার্চের ২০ দিন পর ঠাকুরগাঁও শহর শত্রু কবলিত হলো। এদিকে সৈয়দপুর সেনানিবাসের সাজোয়া ইউনিট ও ট্যাংকের সামনে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা একে একে পিছু হটে আসছিলো যা কেউই সাধারণ মানুষকে জানায়নি। সাধারণ মানুষ ছিল বেশ অসহায়। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে হটতে পঞ্চগড়ে গিয়ে ডিফেন্স নেন। ২৯ এপ্রিল পঞ্চগড়ের পতন হয়। শেষ অবধি তেঁতুলিয়া থানার ভোজনপুরে চাওই নদীর ব্রীজ ভেঙ্গে দিয়ে উত্তর পাড়ে মুক্তিবাহিনী ডিফেন্স নিয়েছিলো। ভোজনপুর থেকে বাংলা বান্ধা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ৭৪ বর্গমাইলের তেঁতুলিয়া থানাটি ছিল সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত। চাওই নদীর ব্রীজ ভাঙ্গা থাকার কারণে পাকিস্তানী সেনারা আর অগ্রসর হতে পারেনি। তাছাড়া জগদল, মাগুরমারী, অমর খানা এলাকা নিতান্তই সীমান্তবর্তী বিধায় নিরাপত্তার দিক দিয়েও তারা এগুতে সাহসী হয়নি।

৭৪ বর্গমাইলের এই তেঁতুলিয়াকে ঘিরে গড়ে উঠেছিলো মুজিবনগর ভিত্তিক বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা। এখান থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করা হতো। বেশ কিছু দিন তেঁতুলিয়া ডাক বাংলোতে বসত করেছেন এম,কে বাশার। এখান থেকে আমার সম্পাদনায় প্রকাশ করা হয়েছিল ‘সাপ্তাহিক সংগ্রামী বাংলা’ যা স্বাধীনতাত্তোরকালে ঠাকুরগাঁয়ের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো।

এর পরের দিনগুলো প্রতিরোধের এবং সম্মুখ যুদ্ধের। অবরুদ্ধ শহরে খান সেনাদের সহায়তাকারী কিছু অবাঙালি ও মালদাইয়াদের কারণে বেশ কিছু হত্যাকান্ড ঘটেছে। পীরগঞ্জ কলেজের অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা, কোসা রাণীগঞ্জের সালাহ উদ্দিন, ফাড়াবাড়িতে পানির কূপে শহর আলী বহর আলীসহ ১৮ জন, ভাতারমারি ফার্মের পাশে হত্যাকান্ডসহ খুনিয়া দিঘি, জাটিয়া ডাঙ্গা, ওয়াপদা ওয়ার্কশপ, পায়েন্দানা চৌধুরী পাড়া, রুহিয়ার রামনাথ হাটসহ বিভিন্ন স্থানের হত্যা ও গণ কবর এবং বাঘের খাচায় নির্যাতনের ভয়াবহ শিকার হয়েছে ঠাকুরগাঁওবাসী।

ঠাকুরগাঁও এলাকার মানুষ বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী কর্পুরী ঠাকুর ও পশ্চিম বঙ্গ সরকারের মানবিক আচরণের জন্য থুকরাবাড়ি, রাজগঞ্জ কিশোরীগঞ্জ ভৈষপিটা, দাড়িভিট, পাটাগড়া, মাটিকুন্ডা ও ইসলামপুর শরনার্থী শিবিরে ঠাঁই নিয়েছিলেন। অনেকে বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থার মধ্যে দেখতে ও মুক্ত ভূমিতে থাকার মানসিকতায় তেঁতুলিয়া থানা সদরে থেকেছেন।

এপ্রিল মাসের ৩০ তারিখে এমপিও সিরাজুল ইসলাম তাঁর পরিবার নিয়ে তেঁতুলিয়া আসেন এবং এখানেই শেষ অবধি ছিলেন। গোটা একটি থানা শত্রুমুক্ত থাকার সুবাদে বিদেশী গবেষক, সাংবাদিক ও পর্যটক এখানে এসেছেন। মুজিবনগর সরকারের সব পদস্থ কর্মকর্তা ও নেতৃবৃন্দ এখানে এসেছেন। এক বার তো কথাই উঠেছিল-‘স্বদেশের মাটিতেই রাজধানী’ ও প্রশাসন চালু করার।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সার্বিক সহযোগিতায় যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। মহকুমার ১০টি থানার বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে যুদ্ধ করেছেন। ২১ নভেম্বর থেকে সাজোয়া বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হয়েছে মিত্রবাহিনী। ৩০ নভেম্বর পঞ্চগড় মুক্ত হয়। খান সেনারা পিছু হটতে থাকে অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি করতে, ঠাকুরগাঁও শহর মুক্ত হয় ডিসেম্বরের ২ তারিখ রাতে অর্থাৎ ৩ তারিখে।
সম্ভবত : বাংলাদেশের একমাত্র মহকুমা ঠাকুরগাঁও যা খান সেনাদের দ্বারা দখল হয়েছে পরে এবং মুক্ত হয়েছে সবার আগে। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধ বললেও ঠাকুরগাঁও বাসী মাত্র সাড়ে সাত মাস অর্থাৎ ৩২১ দিনের মাথায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেমের প্রথম স্বাধীন মহকুমার ঐতিহাসিক গৌরব নিয়ে মুক্তদেশের পতাকা উড্ডীয়ন করেছে।

সূত্র ও কৃতজ্ঞতা -
সম্পাদনা ও সংগ্রহ " প্রতিদিনের ঠাকুরগাঁও " ফেসবুক গ্রুপ 


কোন মন্তব্য নেই :

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মন্তব্য পেলে খুশি হবো, সে যত তিক্তই হোক না কেনো।
পোস্টে মন্তব্যের দায়-দায়িত্ব একান্তই মন্তব্যকারীর। মন্তব্য মডারেশন আমি করি না, তবে অগ্রহনযোগ্য ( আমার বিবেচনায় ) কোনো মন্তব্য আসলে তা মুছে দেয়া হবে সহাস্য চিত্তে।