বৃহস্পতিবার, ১৮ জুন, ২০০৯

একদা ক্ষমতাশালী একজন ক্ষমতাহীন মানুষের পদাবলী

১৫ নাম্বার মিন্টু রোডের লাল দালানে যদি কখনো দেখা যায় পুলিশের টিকটিকি অফিসাররা হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে কাজ করছেন তখন বোঝা যাবে উনারা ফায়ারিং করে এসেছেন। বছরের কোনো এক সময় বোটানিক্যাল গার্ডেনের এক কোনে ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রান্চের অফিসারদের বার্ষিক ফারারিং প্রাকটিস হয়ে থাকে। প্রাকটিসে কতগুলো গুলি ফোটানো হয় বা কি অস্ত্র ব্যবহার করা হয় সেটা লেখায় অবশ্য আসছে না।

আজকের গল্পের একটি চরিত্র আমারই বাবা। কোনো এক সময় পুলিশে ছোটখাটো একজন অফিসার ছিলেন। এখন অফুরন্ত অবসরে রাজা উজির মারেন, বিশাল বিশাল ফাইল তৈড়ি করে সারা জীবনের সন্চয়ের হিসেব নিকেশ করেন। অবশ্য ফাইল তৈড়ি করা ছাড়া কাজের কাজ তেমন কিছুই হয় না।

বেশ ক বছর আগের কথা । যথারীতি ব্যান্ডেজ বেঁধে উনি অফিস করছেন, দূপুরে ফায়ারিং প্রাকটিসও করছেন। গুলি টার্গেটে পৌঁছুচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে অবশ্য তেমন মাথা ব্যাথা দেখা যায়নি উনার মাঝে। গুলি ছোঁড়া হচ্ছে এটাইতো অনেক কিছু ! প্রাকটিস শেষে গতদিনের দেয়া ফখরুদ্দিনের কাচ্চি না আজকের হাজির বিরিয়ানী খেতে ভালো সেটা নিয়েই মনে হয় বেশী মাথা ব্যাথা ছিলো উনার। এটা নিয়েও গল্প বলছি না আজ।

যাই হোক; আবেগীয় মানুষদের মাঝে যেটা হয় । বাসায় এসে বোটানিক্যাল গার্ডেনের পরিবেশ কত সুন্দর, কত নিরাপদ সেটা নিয়ে মোটামুটি একটা বড় বক্তমা ঝেড়ে ফেল্লেন। ঢাকার মানুষ কেনো বোটানিক্যাল গার্ডেনে সকাল বিকাল বেড়াতে যায় না সেটা নিয়ে কস্ট প্রকাশ করার সাথে সাথে সাংবাদিকরা সেখানকার ছিনতাই নিয়ে গল্প ফাঁদে , কেনোই বা হকারদের হয়রানী নিয়ে নিউজ করে মানুষের মাঝে আতংক স্মৃস্টি করে সেটা নিয়ে সাংবাদিকদের একরকম ঝেড়েই ফেলেছিলেন। পুলিশদের সাংবাদিক বিদ্বেষ অবশ্য সেটায় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিলো। বোটানিক্যাল গার্ডেনের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে ধারনা না থাকাতেই উনি এসব বলেছিলেন। একগাদা ডি.বি. অফিসার গাড়ি হাঁকিয়ে সকাল বিকেল সেখানে যাচ্ছেন , গুলি ফোটাচ্ছেন ! আর কোন ছিনতাইকারীর বাপের সাধ্য আছে সেখানে যাবার ? আর সেটা দেখেই উনার ধারনা হয়েছিলো ওখানকার পরিবেশ কতো সুন্দর !!

এত সব কিছুর বলার উদ্দেশ্য, পুলিশের অফিসাররা নিরাপদ পরিবেশ বসে ও ক্ষমতার বলয়ে বাস করে আশে পাশের কতকিছুই যে দেখতে পান না-- কতকিছুই যে বোঝার ক্ষমতা হারান সেটাই বোঝানো। এটা যে শুধু আমার বাবার ক্ষেত্রেই হয়েছে সেটা নয়, এটা আমি অনেক পুলিশ অফিসারদের মাঝেই দেখেছি। উপরের ছোট্ট একটি উদাহরন দিয়ে জিনিসটা বোঝাতে চেয়েছি। চাইলে আরো অনেক উদাহরন দেয়া যাবে। অবশ্য এ বোঝার ক্ষমতাহীনতা বা বোধহীনতা অনেক অনেক সময়ই ইচ্ছাকৃত হয়ে থাকে সেটাও অস্বীকার করছি না।

এসব পুলিশ অফিসার বা ক্ষমতায় থাকা মানুষগুলোর সমস্যা শুরু হয় যখন তারা ক্ষমতা হাড়িয়ে সাধারন মানুষের কাতারে এসে দাঁড়ান। সেসময় পরনে তারকা লাগানো ইউনিফর্ম থাকে না, নীল রঙের পুলিশের গাড়ি থাকে না, বডি গার্ড থাকে না, স্যালুট করবার কেউ থাকে না। সম্মান করে স্যার বল্লেও যখন আদেশ শোনবার কেউ থাকে না তখন জীবনটাকে খুব কাছ থেকে দেখে উনাদের অনেকেই অসহায় হয়ে পড়েন। অবশ্য যে সমস্ত পুলিশ অফিসার অজস্র টাকার মালিক ও রাজনীতির ছায়ার নৃত্যরত তাদের ক্ষমতার হেরফের হয় না, নাটক তখন টিলিফিল্মে রূপ নেয়।

এবারের সিকোয়েন্সে ব্যক্তিগত কিছু ঘটনা। গত দু মাস ধরে আমাদের পরিবার একটি দূঃসময় পার করছে যার আপাত সমাধান গতকাল আমরা করতে পেরেছি । যে সমাধান আমরা করতে চেয়েছি আইনের মাধ্যমে, যে সমাধান আমরা করতে চেয়েছি প্রশাসনের মাধ্যমে, যে সমাধান আমরা করতে চেয়েছি শান্তিপূর্ন ভাবে সেই সমাধান আমাদের করতে হয়েছে আইন না ভেঙে - আইনের ফাঁক গলে শক্তি দিয়ে। আদালত যখন টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যায়, পুলিশ যখন টাকার কাছে বিবেক বিক্রি করে, রাজনীতির নামে তথাকথিত দেশ সেবকরা যখন টাকা ছাড়া কিছুই বোঝেন না, স্বজনও যখন পিঠে দেখায় তখন কিইবা করা থাকে আয়ের একমাত্র সংস্থানকে নিজের দখলে ফীরে পেতে ? হয়তো লিখে লিখে অনেক কিছুই বলা যায় - গলাবাজী করা যায় কিন্তু বাস্তবতা সবসময়ই অন্য কিছু বলে।

এর সব কিছুই হয়েছে আমার বাবার চোখের সামনে। দিন দূপুরে আয়ের একমাত্র সংস্থানের বেআইনী ভাবে দখল হয়ে যাওয়া , সাহায্যের জন্য এক সময়ের সহকর্মী পুলিশদের কাছে ধর্না দেয়া , আদালত ঘুরে ঘুরে টাকার মোচ্ছবে সামিল হওয়া , দেশ সেবকদের দরজায় দরজায় ঘুরে ক্লান্ত হওয়া, অনেক কিছুই হয়েছে- কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

অথচ উনার ধারনা ছিলো এর সবগুলোই অসম্ভব ! সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে যে সম্ভব সেটা উনাকে দেখতে হয়েছে। আমার বলেছি শক্তির বদলা শক্তি দিয়েই দিতে হয়। উনি শুনতে চান নাই। এখনো বিশ্বাস করেন এভাবে কোনো কিছু দখল হতে পারে না , পুলিশে এখনো ভালো মানুষ আছে, পুলিশ পুলিশের মাংস খায় না, আদালতে এখনো সুবিচার পাওয়া যায় , ইত্যাদি ইত্যাদি। হয়তো আজ উনি উনার এতকালের বিশ্বাস- এতকালের ধারনা ভেঙে যাওয়াতে কস্ট পাচ্ছেন, অবাক হচ্ছেন। আমরা উনাকে বলছি ব্যাকডেটেড - ভুল চিন্তার মানুষ - ভুল সময়ের মানুষ - হয়তো অবাকও হচ্ছি কি ভাবে এতটা বছর পুলিশে কাজ করলেন।

হয়তো আজ হতে ৩০ বছর পরে আমার সন্তানও আমার অনেক কিছুতে অবাক হবে, যেমনটি হচ্ছি আমি আমার পিতাতে। হয়তো আমার মতো আমার সন্তানও আমাকে বলবে ভুল চিন্তার মানুষ - ভুল সময়ের ভুল মানুষ, যেমনটি বলছি আমি আমার পিতাকে। হয়তো আমার সন্তানো আমার মতো আমার পিতার কস্টকে যেভাবে বুঝতে পারছি , সেভাবেই বুঝতে পারবে।

দোষ দেবার এ চক্রটা চলতেই থাকবে। মাঝ খান থাকে মানুষ পরিবর্তিত হতে বাধ্য হবে যেভাবে আমার পিতা হচ্ছেন, আমি হচ্ছি। মাঝ খান থেকে হারিয়ে যাবে বিশ্বাস নামের অমুল্য বস্তু।

অনেক কাল আগে থানার সদর দরজার বাহিরে কিছু মানুষকে অসহায়ের মতো বসে থাকতে দেখতাম। সময়ে মানুষের মুখগুলো বদলে গেলেও ঘটনার রকমফের হতো না। বিচারের আশায় - একটু নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় একদল অসহায় মানুষের পুলিশের কাছে ছূটে আসা। নিরাপদ দূরত্বে সেসব মানুষগুলোর আকুতি হয়তো পিতার হৃদয়ে স্পর্শ করতো না কিন্তু সময়ের নিষ্ঠুর পরিহাসে একদা ক্ষমতাশালী সেই মানুষদটিই যখন সেই অসহায় মানুষগুলোর কাতরে নেমে এসেছিলেন তখন কি একবারের জন্যও সেই মানুষগুলোর চেহারে ভেসে উঠেছিলো উনার চোখে মাঝে ? কে জানে ! হয়তো - হয়তোবা না।

কোন মন্তব্য নেই :

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মন্তব্য পেলে খুশি হবো, সে যত তিক্তই হোক না কেনো।
পোস্টে মন্তব্যের দায়-দায়িত্ব একান্তই মন্তব্যকারীর। মন্তব্য মডারেশন আমি করি না, তবে অগ্রহনযোগ্য ( আমার বিবেচনায় ) কোনো মন্তব্য আসলে তা মুছে দেয়া হবে সহাস্য চিত্তে।