রবিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

"বাবা", যে মানুষটিকে নিয়ে আমার কখনোই লেখা হয়নি

জ্যাতিষ শাস্ত্রে বিশ্বাষ না করলেও 'বৃষ-বৃষ' সংঘাত কথাটি আমি সব সময়ই বলে থাকি। বাবার রাশি ও আমার রাশিতে মিল থাকাতেই নাকি সব সময় দুজনের মাঝে খিটমিট লেগে থাকে, মা মজা করে বলেন শিং-শিং এ যুদ্ধ। রাজনীতি নিয়ে তর্কতো খুবই স্বাভাবিক ব্যপার। আওয়ামী বিরোধী বাবার সাথে কত যে তর্ক হয়েছে সেটা মনে পড়লে মাঝে মাঝে হাসিই পায়। ঘটনা যাই হোক, বাবার সাথে আমার মত ও অন্যান্য অনেক অমিল না থাকলেও আজকাল আবিস্কার করতে পারছি দুজনের মাঝে অনেক অনেক মিল, মা তো বলেন বাপের ফটোকপি।

বাবার জীবনের অনেক কিছুই আমাদের অজানা। হয়তো নিজের কস্ট-সংগ্রামের কথা বলে সন্তানদের কস্ট দিতে চান না বলেই সবকিছু নিজের মাঝে চেপে রাখেন। বাবা-মা হতে শত মাইল দূরে জায়গীর থেকে এসএসসি পাশ করেন। গ্রামের জায়গীর থাকার কস্ট যে থেকেছে সেই শুধু জানে। খুব সকালে উঠে গরু ছাগলকে খাবার দিয়ে- বাজার সদাই করে তবেই নিজের পড়াশোনা, খাবারের বেলায় হয়তো সবার খাবারের পর যা বেঁচে থাকে সেটাই জুটে।

২৩ বছর বয়সেই জীবন সংগ্রাম শুরু। এর মাঝেই মুক্তিযুদ্ধের শুরু। যুদ্ধ শেষে পুলিশে যোগদান। তখনো আমার জন্ম হয়নি। বাবার কাছে সে সময়কার ঘটনা জানতে চাইলে অনেক কিছুই বলতে চান না। সারদার ক্যাডেট জীবন, সর্বহারা পার্টির হামলা থেকে বাঁচার জন্য স্টেনগান নিয়ে ঘুমানো, রক্ষিবাহিনীর অনেক কিছু দেখেও না দেখার অভিনয়, আওয়ামী লিগের চরম অরাজক শাষন, ৭৪' দূর্ভীক্ষ্, ৭৫' বংগবন্ধু হত্যা পরবর্তী অবস্থা , সামরিক শাষনের সময়কার আর্মিদের ধমকা-ধমকি, ৮১' জিয়া হত্যা, ৯ বছরে এরশাদীয় সামরিক- একনায়ক শাষন শেষে ৯০ এর গনঅভ্যুত্থান, ৯১' খালেদার বিএনপির ক্ষমতা, ৯৬' হাসিনার আওয়ামী লীগের ক্ষমতা শেষ করে ০১' খালেদায় দ্বিতীয়বারের সরকার গঠন- দেশের রাজনীতির এই দীর্ঘ পরিক্রমার নিরব সাক্ষি বলা যেতে পারে বাবাকে। বাবার কাছে জানতে চাই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা, দীর্ঘ চাকুরী জীবনের কথা, উনি হাসেন; বলতে চান না অনেক কিছুই। বাবার মতো আজকাল অনেকেই মনে হয় মুচকি হেসে কিছুই বলতে চান না। ইতিহাস লেখা হয় তাদের হাত দিয়ে ইতিহাসে যাদের কোনো অবদানই নেই।

মাঝে মাঝে বাবাকে জিগ্যেস করতে ইচ্ছে হয় পুলিশে চাকুরি করে কি পেলে ! ৯০ দশকের কোনো এক বছরে শিবিরের গুলিতে ঝাঁঝরা-আহত বাবাকে রাজশাহীতে যখন দেখতে গিয়েছিলাম তখনো প্রশ্নটা করতে ইচ্ছে হয়েছিলাম। দীর্ঘ চাকুরী জীবন শেষে অবসর যাবার পর প্রশ্নটা আবার করতে চেয়েছিলাম। করা হয়নি কখনোই। প্রশ্ন করতে পারি না যেখানে উত্তরটা আগে থেকেই জানা; পেনশনের কিছু টাকা-ধাতব কিছু পদক - হাসিনার দেয়া কচুর লতি, খালেদার দেয়া লটকন - বিদায় সংবর্ধনায় পাওয়া একটা ক্রেস্ট - অনেক অপরাধীর ঘৃনা- অনেক অনেক মানুষের ভালোবাসা, আর আমরা -- উনার সন্তানেরা। আমার বাবা-মা অনেক কস্ট করে আমাদের মানুষ করেছেন। পুলিশের লাখো দূর্নীতির মাঝেও আমরা অনেক কস্ট করে মানুষ হয়েছি, সৎ টাকায় সৎ জীবন যাপনের আপ্রান চেস্টা করেছি। আমরা মানুষ হয়েছি এটাই উনার সবচাইতে বড় প্রাপ্তি।

বেশ কদিন আগে বাবার সাথে কথা বলছিলাম। কথার শুরুতেই দুস্টুমি করে ৩ ওয়ে কনফারেন্সিং চালু করে চমকে দিলাম বাবাকে। আমেরিকা-বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া একই সাথে কথা বলছি আমরা ভাই-বোন-বাবা/মা। বাবাকে বল্লাম ভালো করে 'আম্রিকা' দেখতে, এর পর অস্ট্রেলিয়া ঘুড়ে যেতে। বাবাকে শিশুর মতো আনন্দিত হতে দেখে আমার চোখে কি একটু পানি এসেছিলো ?

আমাদের বাবা-মারা আমাদের জন্য তাদের জীবনটাকে শেষ করে ফেলেন, নিজেদের জন্য কিছুই রাখেন না। সন্তানদের মানুষ করবার জন্য নিজেদের অবসর সময়টুকুও ব্যয় করে ফেলেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যখন সন্তানরা বড় হয়ে যায় তখন বড্ড একাকী হয়ে পরেন আমাদের বাবা-মারা। বাবা দিবস- মা দিবস পালন করে হয়তো আমাদের অনেকেই একদিনের জন্য হলেও তাদের শুভকামনা জানাই। ব্যক্তিগতভাবে এ ধরনের দিবস পালন না করলেও আজ বলছি " আব্বু, হ্যাপি ফাদার্স ডে " ।

বাবাকে নিয়ে অনেকে কিছুই লেখার ছিলো, অনেক কিছুই লেখা হলো না।

অস্ট্রেলিয়ায় সেপ্টেম্বরের প্রথম রবিবার " বাবা দিবস " পালন করা হয়। দিবসটির ভুলে থাকতে চাইলেও টিভি এডের কল্যানে ভুলে থাকা সম্ভব হয় না। বাবার জন্য এটা-সেটা কতো কিছু যে কেনার আছে সেটা মনে করিয়ে দেবার জন্য আপ্রান চেস্টা। গাড়ি থেকে শুরু করে স্ক্রু ড্রাইভার - দারুন ব্যবসা।

1 টি মন্তব্য :

আপনার মন্তব্য পেলে খুশি হবো, সে যত তিক্তই হোক না কেনো।
পোস্টে মন্তব্যের দায়-দায়িত্ব একান্তই মন্তব্যকারীর। মন্তব্য মডারেশন আমি করি না, তবে অগ্রহনযোগ্য ( আমার বিবেচনায় ) কোনো মন্তব্য আসলে তা মুছে দেয়া হবে সহাস্য চিত্তে।