শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০০৮

"বিহারী"একটি অভাগা বীষবৃক্ষের নাম

সেই ১৯৮৫ সাল। বাবার চাকরি সুত্রে সৈয়দপুরে অস্থায়ী নিবাস। যথারীতি সেবারও বছরের মাঝে খানে নতুন স্কুলে ভর্তি ও এক গাদা পিচ্চিপাচ্চার সাথে নতুন করে দোস্তালী পাতানো। তো সেবার ভর্তি হলাম সৈয়দপুর ক্যান্ট পাবলিক স্কুলের ক্লাস ২ ডালিয়া সেকশনে। প্রথম দিন যে ছেলেটির সাথে পরিচয় হলো সেই ছেলেটির নাম মনে নেই। তবে এটা মনে আছে ছেলেটি ছিল বিহারী ও বিহারীদের সেই বিখ্যাত নেতা নাসিম খানের নাতি। পরে শুনেছি ছেলেটি পাকিস্তানে চলে গিয়েছে।

সৈয়দপুর থাকার সময়ই প্রথম বিহারীদের কথা শুনেছিলাম। সেসময় শহরের বেশীর ভাগই ছিলো বিহারী। আসলে অনেক কারনেই সৈয়দপুরের কথা বেশী মনে পরে আমার। সেখানেই সর্বপ্রথম কোরআন পড়া শুরু করেছিলাম, ওস্তাদ ছিলেন একজন বিহারী। উনার কাছে আমি উর্দু পড়তে ও বলতে শেখাও শুরু করেছিলাম। ভাঙা ভাঙা উর্দুও বলতে পারতাম সেসময়।

বাবার পেশার সুবাদে অনেক বিহারীর সাথে পরিচয়ও হয়েছিলো। বেশীর ভাগই অনেক ধনী ছিলো। দেখেছি স্বাধীনতার ১৩ বছর পরও ওই সব বিহারীদের আর্থিক বা সামাজিক অবস্থা ছিলো অটুট। তবে সেটা ছিলো পয়সার অপর পিঠ। শহরের এক কোনায় জেনেভা ক্যাম্পে গেলে প্রকৃত অবস্থা বোঝা যেতো। গাদাগাদি করে হাজার হাজার মানুষ থাকছে। একবারতো আগুনে সারা ক্যাম্প পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। সে সময় শহরের সেই ধনী বিহারীরা এগিয়ে না এলেও বাঙালীরাই এগিয়ে এসেছিলো তাদের পাশে।

শহরের ঠিক মাঝ দিয়েই ডাঃ জিকরুল হক সড়ক। ৭১ এ ডাঃ জিকরুল ছিলেন আওয়ামী লিগ হতে নির্বাচিত এমপি। ২৫শে মার্চের কালো রাতে অনেকে পালিয়ে যেতে পারলেও ডাঃ জিকরুক হক পারেন নি এবং উনি পালিয়েও যানও নি। উনাকে বিহারীরা ৭ টুকরো করে শহরে চার রাস্তার মোড়ে দিনের পর দিন ঝুলিয়ে রেখেছিলো। সৈয়দপুরের রেলওয়ের কারখানার ফার্নেসে শত শত বাঙালী কর্মচারীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো সে সময়, অথচ খুনীরা ছিলো এই বাঙালীদেরই প্রিয় সহকর্মি। সে সময় শহরে অনেক হিন্দিভাষী মারওয়ারী ব্যবসায়ী ছিলো। একবার তাদের ভারতে নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ট্রেনে ভরে শহরের পাশে নিয়ে কচুকাটা করে ট্রেন লাইনের পাশে ফেলে দেয়া হয়, লুট করে নেয়া হয় তাদের সব কিছু। প্রায় ৪০০ মারওয়ারীকে সেবার ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়, খুনিরা ছিলো তাদেরই বিহারী কর্মচারী।

মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় সৈয়দপুর ছিলো একটি মৃত্যুকুপ। শত শত বাঙালীকে হত‌্যা করা হতো স্রেফ জবাই করে। ৮৫ সালে যখন সৈয়দপুরে ছিলাম তখনও মাঝে মাঝেই মাটি খুরে মানুষের হাড় গোড় পাওয়া যেতো।

১৬ ডিসেম্বরের প্রায় প্রারম্ভে যখন সৈয়দপুর মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে সে সময় কার চিত্র ছিলো পুরোপুরি উল্টো। আশে পাশের শহর যেমন দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁ থেকে সব বিহারীরা এসে জোরো হয়েছিলো সৈয়দপুরে। পাকিস্তানী সেনারা এক রাতে এই সব বিহারীদের ফেলে রংপুর ক‌্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নেয়। ভারতীয় সেনাদের জন্য বড় কোন ম্যাসাকার হতে পারেনি , সৌভাগ্য সেই সব বিহারীদের। শান্তাহারের বিহারীদের অবশ্য সেই সৌভাগ্য হয়নি। শোনা যায় প্রায় ২০ হাজার বিহারী মারা হয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধের শুরু ও শেষ সময়টুকুতে। আমার নিজের শহড় ঠাকুরগাঁতেই অসংখ্য বিহারীকে মারা হয়েছিলো। আমার চাচার এক বন্ধু, নাম জুয়েল। উনার পরিবারে উনি ছাড়া আর কেউ বাঁচতে পারেনি। এটাই নোংরা সত্য।

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর যেসব বিহারী ধনী ছিলো তারা তাদের সম্পত্তি পুরোপুরি ফেরত না পেলেও অনেকটুকুই পেয়েছিলো এবং সেটা ছিলো সে সময়কার রাজনৈতিক দলগুলোর সাহায্যেই। ডাঃ জিকরুল হককে হত্যা করার জন্য যে বিহারীকে দায়ী করা হয় ১৯৮৫ তে সেও ছিলো শহরের একজন সম্মানিত ব্যাক্তি। ধনী বিহারীদের তেমন সমস্যা না হলেও বড় সমস্যা হয়েছিলো মুলত গরীব বিহারীদের। এরা না পেরেছিলো পাকিস্তানে ফেরত যেতে , না পেরেছিলো ভারতে ফেরত যেতে। সহায় সম্বল হাড়িয়ে এদের জায়গা হয়েছিলো ক্যাম্পে ক্যাম্পে। ম্যাসাকারের সম্মুখিনও হতে হয়েছিলো অনেক সময়। ইতিহাসে অবশ্য এসবের জায়গা হয়নি। সময়টিই ছিলো বদলা নেবার।

স্বাধীনতার ৩৭ বছর পর এই ৩/৪ লাখ বিহারীদের অবস্থা আসলেই করুন। গাদা গাদি করে ক্যাম্পে থাকছে এরা। ইউএনইচসিআর বা রাবিতার টাকায় এদের জীবন চলে। এরা না পায় সরকারী চাকরি না পায় ভোটাধিকার। ছোটো খাটো কাজ করে এদের জীবন চালাতে হয় বেশিভাগকেই। নিজেদের পাকিস্তানী পরিচয় ভুলে বর্তমান প্রজন্ম বাংলাদেশী হতে চায়, সেটাও এরা পায় না। পাকিস্তানি শাসকরা আশার মুলো ঝুলিয়ে রাখছে কিন্তু পাকিস্তানে যাবার স্বপ্ন আর তাদের পূরন হয় না।

বেশ ক বছর আগে সৈয়দপুর গিয়েছিলাম। দেখলাম ২৩ বছর আগের সেই ধনী বিহারীদের অনেকেই পাকিস্তানে চলে গিয়েছে বা তাদের সন্তান সন্ততিদের পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মোড়ের সেই বৃদ্ধ বিহারী মুচি এখনো জুতো সেলাই করে যাচ্ছে ও প্রতিটি রাতে ক্যাম্পের ছোট্ট ঘরে শুয়ে পাকিস্তানে যাবার স্বপ্ন দেখছে।

বিহারী যাদের আরেক নাম "আটকে পড়া পাকিস্তানী" প্রতি আমার অনুভূতি অনেকটুকুই করুনা ও ঘৃনা মেশানো। একজন বাঙালী হিসেবে আমি তাদের পাপ ও অপরাধের জন্য ঘৃনা করলেও একজন মানুষ হিসেবে সেটা করতে পারি না। করুনা করলে হয়তো সেটা হয়তো অন্যরকম একটা ব্যাপার হয়ে যায়। তবে আসলেই কি সেটা করুনা ? নাকি অন‌্য কিছু ?
--------
লেখাটি একজন ব্লগারকে উৎসর্গ করে। তার নাম উল্লেখ করছি না সংগত কারনেই। ভালোলাগা-মন্দলাগা সেই মানুষটির বেদনা বোঝার চেস্টা থেকেই কিছু লেখার চেস্টা করেছি।
লেখাটি পুরোপুরি নিজের অনুভূতিকে কেন্দ্র করে লেখা, ইতিহাসের চুলচেড়া বিচার করতে যাইনি ইচ্ছে করেই।

কোন মন্তব্য নেই :

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মন্তব্য পেলে খুশি হবো, সে যত তিক্তই হোক না কেনো।
পোস্টে মন্তব্যের দায়-দায়িত্ব একান্তই মন্তব্যকারীর। মন্তব্য মডারেশন আমি করি না, তবে অগ্রহনযোগ্য ( আমার বিবেচনায় ) কোনো মন্তব্য আসলে তা মুছে দেয়া হবে সহাস্য চিত্তে।