শনিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০০৮

সিডনী-চাংগি-জিয়া (একটি গল্প লেখার অপচেস্টা)

গল্পের একমাত্র নায়ক নাফিজ।
৩ ঘন্টার একঘেয়ে বাস জার্নি শেষে সিডনী এয়ারপোর্টে আসতেই মনটা কেমন যেনো করে উঠলো, "আহ হা !! অবশেষে দেশে যাচ্ছি ! " নিজের মনেই বলে উঠে।

ম্যাক থেকে এক কফি নিয়ে টেবিলে বসতেই পাশে বাংলা কথা শুনে কান পাতলো নাফিজ।"দোস্ত, দ্যাখ দ্যাখ মাইয়াটা জোস, সেরম ! " নাফিজ তাকিয়ে দেখে তিনটা বাংলাদেশী ছেলে। একজন সম্ভবত দেশে যাচ্ছে, বাকীরা তাকে বিদায় দিতে এয়ারপোর্টে এসেছে। বাংলাদেশীদের দেখলেই চেনা যায়, কেমন যেনো ভাত ভাত চেহারা। পাকিদের দেখলে যেমন মনে হয় রুটি-ডাল খাওয়া চোঁয়াড়ে।

নাফিজ ভাবছে, শালার রাতুলটা কখন যে আসবে।
গল্পের পার্শ চরিত্র রাতুল সিডনী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলটাইম পোস্ট গ্রাড, পার্ট টাইম কামলা।
"দোস্ত, কখন আসছস ? রাস্তায় কুনু সমস্যা হয় নাই তো? পাশে কি কুনু মাইয়া বসছিলো ? চান্সে কিছু করস নাইতো রাইতের অন্ধকারে?, তোর তো আবার মাইয়া দেখলে মাথা ঠিক থাকে না! " এক নিশ্বাঃষে সব কিছু বলেই রাতুল নাফিজের দিকে দাঁত কেলিয়ে হাসলো। দেশে বিশাল আমলার ছেলে মফিজ এখানে কামলা খাটে এটা মফিজ অস্বীকার করে না অবশ্য। গল্পের পার্শ চরিত্র রাতুল নাম অবশ্য অন্য। গল্পের খাতিরে তার নাম রাতুলই রাখা হয়েছে। নামে কি এসে যায়। রাতুল দেশে পাঠাবার জন্য একগাদা জিনিস নিয়ে এসেছে। নাফিজের অবশ্য সমস্যা নাই এসব নিতে। সে কিছুই নিচ্ছে না, তার সুটকেস খালি।

"কোনো বোতল দ্যাশ নাইতো? "
"কি কস হালায়, আমার বাপের জন্য বোতল পাঠামু !! বোতল অবশ্য কিছু আছে, তয় সেই গুলান ওষুধ।" নাফিজের ভালো লাগে রাতুলের কথাগুলো শুনে। কথাগুলো অন্যরকম ভালোবাসা নিয়ে বলা, চোখে আনন্দ।
"তোর চেক ইন কয়টায়?" রাতুলের কথায় নাফিজের ভাবনায় ছেদ পরে। বলে " ১১ টায় "
"চল যাই, তরে আগায় দিয়া আসি "। এটা বলেই রাতুলে নাফিজের সুটকেস টানা শুরু করে। রাতুল কি জানে নাফিজ তাকে এতো পছন্দ করে। দেশে যাবার সময় নাফিজের টাকার সমস্যা কথা শুনে আচমকা তার একাউন্টে ৬০০০ ডলার দিয়ে ট্রান্সফার করার সাহস এই রাতুলেরই আছে।

চেক ইন করার সময় সমস্যা হয়নাই অবশ্য কোনো।প্লেনে বসতেই পেটে কেমন জানি গুর গুর করে উঠছে। প্রত্যেক বার প্লেনে ‌উঠার সময় এরকটি হয় নাফিজের। শালার পেট আবার খারাপ হলো নাতো ! নাফিজ ভাবার চেষ্টা করছে গত রাতে সে কি এমন কিছু খেয়েছে যা পেটের সমস্যা করতে পারে।

প্লেনে উঠে নাফিজ একটা প্রথম যে জিনিসটা করে তা হলো চারপাশে একপলক চোখ বোলানো। কৈশরের অভ্যাস। আশে পাশে সুন্দর কোনো মেয়ে আছে কি না সেটা পরখ করে নেয়া। কিছু করা যাক আর যাক ' চোখের সুখ'।
প্লেনে আইল সিট সবমসময় চেয়ে নেয় নাফিজ। ইকোনমি ক্লাসের ভেতরকার দিকে বসে চিপা চিপা সিটে মাঝ খান দিয়ে বের হওয়া কি রকম বিব্রতকর সেটা যে করেছে সেই জানে। "আমারে একটা উইনডো সিট দেন ভাই"। এ ধরনের অনেক কথাই অনেককে বলতে দেখেছে সে। অবশ্য আকাশে ‌‌উঠে মেঘ দেখে বিরক্ত হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না, রাতে সেটা আঁধারে সাঁতার কাটার মতোই।

পাশের সিটে যথারীতি দুজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। নাফিজ যতোবারই এরকম দীর্ঘ বিমান যাত্রায় উঠেছে ঠিক ততবারই তার পাশের সিটে কোনো না কোনো বুড়ো লোককে পেয়েছে। মনে হয় এটাকেই বলে নসিব !

ওপাশের সারিতে এক বাংগালি পরিবার। স্বামী-স্ত্রী ,সাথে দুটো বাচ্চা। অশোভনীয় হলেও কান পেতে তাদের কথা শোনার চেষ্টা করে নাফিজ। বুঝতে পারছে উনারা দীর্ঘ ৪ বছর পর দেশে যাচ্ছেন। দেশে অনেক গরম, বাচ্চাদের শরীর ইত্যাদি ইত্যাদি সাংসারিক আলাপ।

গল্পের এ সময়টুকুতে নাফিজ জানতো না যে ঠিক ৫ বছর পর সেও তার পরিবার নিয়ে ঠিক এভাবে দেশে যাচ্ছে আর পাশের সিট থেকে নাফিজের মতোই আরেক নাফিজ কান পেতে কথা শোনার চেষ্টায়।

কিছুক্ষণ পর খাবার আসলে তৃপ্তির সাথে খেয়ে নেয় নাফিজ। তার কেনো জানি প্লেনের খাবার ভালো লাগে। অনেককেই দেখলো ওয়াইন বা স্পিরিট নিতে। নাফিজের অবশ্য অভ্যাস নেই এসবে। ড্রিংক না করায় অনেকেই তাকে ক্ষ্যাত বলে। এক বাংগালীকে দেখা গেলো কিছুক্ষণ পর পর বিয়ার নিতে। ফ্রি পেলে বাংগালী আলকাতরাও খায় , আর এ এটো শরাবে তাহুরা, বেহেশতী জিনিস।

চোখ বন্ধ করে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করছে নাফিজ। প্লেনের ভেতরকার গুর গুর শব্দে ঘুম আসতে চায় না। চোখ বন্ধ করে নাফিজ ভাবার চেষ্টা করছে তার হবু বধুর কথা। চোখ আস্তে আস্তে বুজে আসতে থাকে তার। দীর্ঘ ৮ ঘণ্টা পর ঘুম যখন ভাঙবে তখন সে দক্ষিণ থেকে উত্তর গোলার্ধের ছোট্ট এক দ্বীপ দেশে।

----

সিংগাপুরের চাংগিকে সবসময়ই ভালো লাগে নাফিজের কাছে। সব কিছু সাজানো, কি দারুন পরিস্কার, মানুষগুলো যেনো সব রোবট।

দীর্ঘক্ষণ সিগারেটের নেশাকে চেপে রাখা অবদমিত কামের মতোই চেপে রাখা। চাংগিতে আগেও বেশ কবার আসাতে স্মোকিং রুম নাফিজের কাছে বেশ পরিচিত। একটা সিগারেট ধরাতে গিয়েই আবিস্কার করে সাথে লাইটার নেই। সিডনীতে চেক করার সময় জিপ্পুটা ওরা রেখে দিয়েছে।

আশে পাশে তাকিয়ে একজনের কাছে লাইটার চাইতেও সে বলে উঠলো " ভাইজান কি বাংলাদেশী? " নাফিজ ভাবছে তার চেহারাতেও কি ভাত ভাত লেখা রয়েছে ! মনে হয়। সব বাঙালীই একরকম দেখতে।
" আমি রাজিব, কোরিয়া থেইকা আসছি" বলে হাসলো পাশের লোকটি।
"আমি নাফিজ, অস্ট্রেলিয়া থেকে আসছি" বলে নাফিজ হাসলো একটু।
"ভাই, কি ইস্টুডেন্ট? "
"হুঁ" বলে নাফিজ, তার ভাবনায় এখনো তার হবু বধু। তাছাড়া অপরিচিত কারো সাথে এভাবে কথা বলতে সে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ বোধ করে না।
"আমি ৮ বছর পর দেশে যাচ্ছি ভাই, বাপ-মাকে অনেক দিন দেখি নাই, ফোনে কি শখ পূরণ হয় কন ? " এক নিশ্বাঃসে বলে যায় রাজিব। নাফিজ শুনছে।
"দেশে গিয়া একটা ব্যবসা শুরু করুম ভাই, ছোট ভাইরে টাকা পাঠাইছি অনেক, সেই টাকা দিয়ে হাটে একটা তেলের মিল দিমু, আর একটা ট্রলার কিনুম মাছ ধরার। " একজন উদ‌্যোগী লোক মনে হচ্ছে ! হবু শিল্পপতি। নাফিজ ভাবছে।
"চলেন ভাই একটু ঘুইরা দেখি এয়ারপোর্ট ! দ্যাখছেন কি সুন্দর, আমগো ঢাকা এয়ারপোর্টে যদি এরম সুন্দর হইতো ।" বলেই রাজিব দাঁড়িয়ে নাফিজের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। নাফিজ কি যেনো ভেবে হাঁটা শুরু করলো রাজিবের সাথে।
" বুঝছেন ভাই, আমি ইন্টার পাশ করে দ্যাশ ছাড়ছি, আর পড়াশুনা করবার পারি নাই" নাফিজ শুনছে, ভালোই লাগছে, একজন সংগ্রামী মানুষের জীবন গল্প।
"ভাই, আপনার কত টাকা পান অস্ট্রেলিয়ায় কাম কইরা" রাজিবের প্রশ্নে অবাক হয় না নাফিজ। এরকম প্রশ্ন অস্ট্রেলিয়ায় ও অনেকেই বলে। এরা বুঝতেই চায় না কারো বেতনের কথা জানতে চাওয়াটা অভব্যতা।
" এই পাই আর কি " বলে উঠে নাফিজ।
" আপনারা অনেক টাকা বেতন পান জানি , খরচা পাতি বাদ দিয়া আমি মাসে ২০ হাজার টাকা পাঠাই দেশে, একটাকাও রাখি না সাথে" রাজিব বলে উঠে।
"হুঁ" বলে নাফিজ। কথায় কথায় হুঁ বলা একটা বজে অভ্যাস গড়ে উঠেছে নাফিজের। কাটাতে হবে এটা।
"গ্রামের বাড়ীটা পাকা করতে হবে, বুড়া বাপ মা কস্ট করে" রাজিবের এ কথায় নাফিজ ভাবছে তার কথা। বাড়ীর মর্টগেজের টাকার ইন্টারেস্ট বেড়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, কিভাবে যে সব কিছু সামলাবে সে। দেশে বাবা-মা ভাড়া বাসায় থাকে, ভাড়ার টাকা অবশ্য নাফিজই দেয়। নাফিজ কতবার বলেছে বাবা মাকে ঢাকায় কস্ট না করে গ্রামের বাড়ীতে চলে যেতে। গ্রামের বাড়ীটা অনেক পুরোনো হলেও খালি পরে আছে। একটু সারাই করলেই হবে। মাসে মাসে গাদা খানেক টাকা আর পাঠাতে হবে না নাফিজকে।

"ভাই কি বিয়া করছেন ? " একটু চমকে যায় নাফিজ। "নাহ, এখনো করি নাই। বিয়ে করার জন্যই দেশে যাচ্ছি" বলে অনেকক্ষন পর একটু হাসলো নাফিজ। বাবা-মার পছন্দ করা মেয়ে। বিক্রমপুরের বিশাল বড়লোকের ছোট মেয়ে। মা অবশ্য রাজি ছিলেন না। বাবা পছন্দের উপরে মা কিছু বলতে পারেন না। মেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে সবে। অল্প বয়সী মেয়েই ভালো। গরে-পিঠে নেয়া যায়। বউকে সাথে নিয়ে আসার ইচ্ছে নাফিজের। ইচ্ছে হলে বউ অস্ট্রেলিয়ায় পড়বে, সাথে সাথে কাজও করবে, নাফিজের অনেক সাহায্য হবে অবশ্য এতে। আচ্ছা , নাফিজ কি পরিবর্ততিত হয়েছে? সেতো এরকমটি ছিলো না আগে ! আজকাল কি বৈষয়ীক সে।

" আমি অবশ্য বিয়া করি নাই , দ্যাশেই যাই নাই বিয়া করুম ক্যামনে। তবে কোরিয়ায় এক ভিয়েতনামী মেয়ের লগে লিভ টুগেদার করছি ।" রাজিবের এ কথায় একটু অবাক হয় নাফিজ। আশ্চর্য সরলতো ও সৎ এই ছেলেটি।

নাফিজ ভাবছে কি কেনা যায়। শেষ মেষ এক প্যাকেট মার্লবোরো লাইট কিনলো ছোট মামার জন্য। রাজিব কিছুই কিনছে না। " ভাই, কিছুই কিনুম না। সব টাকা দেশে নিয়া যামু। দ্যাশের কাজে লাগবো এই সব টাকা"।
"চলেন, এক কাপ কফি খাই , প্লেন ছাড়ার বেশী বাকি নেই"
"নাহ ভাই, এই খানে অনেক টাকা লাগে কফি খাইতে" রাজিবের কথায় অবাক হয় একটু নাফিজ।
"আরে চলেন। আর কয়টাই বা টাকা" বলে নাফিজ রাজিবকে নিয়ে এক ছোট্র কফি শপের নিরিনিলি কোণে বসে।
কিভাবে যে আড়াই ঘন্টা কেটে গেলো নাফিজ বুজতেই পারছে না। সংগী থাকলে মনে হয় সময় দৌড়ুয়।
"চলেন, সামনে আগাই" বলে রাজিবকে তাড়া দেয়। বুঝতে পারছে লোকটি একটু হতভম্ব হয়ে গিয়েছে চাংগির ঝকঝকে অবস্থায়। ডিস্প্লেতে গেট নাম্বার দেখে নিয়ে তারা দুজন এগুতে থাকে সামনে। ৫২ নাম্বার গেট। প্রায় ১ কিলোমিটারতো হবেই।

অনলাইনে চেক ইন করায় তেমন সমস্য হলো না। রাজিবকে অবশ্য লাইনে দাড়িয়ে অনেক সময় নিয়ে বোর্ডিং পাস নিতে হলো। দুজনের দু জায়গায় সিট পড়েছে। সিকিউরিটি চেকে সমস্যা হলো না তেমন। এটা কি নাফিজের নীল পাসপোর্টের জন্য? হায়রে পারপোর্ট। সবুজ পাসপোর্ট হলে কতই না ভ্রু-কুচি সহ্য করতে হয়।
একটু পর এনাউন্স, বোর্ডিং।

সামনে এগুতেই রাজিব একটু থেমে বলে উঠে " ভাইজান ভালো থাকবেন" "আর,আর আরেকটি কথা ", " আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছি"চোখের কোণে অশ্ররু আভাস। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে রাজিব বলে উঠেছে। নাফিজ অপেক্ষায় আছে রাজিবের কথা শেষ হবার অপেক্ষায়।

---

হাফিজ সাহেব, অবসরপ্রাপ্ত সহকারী ব্যবস্থাপক (তিতাস গ্যাস), প্রাক্তন সহকারী শিক্ষক (খাসকাউলিয়া হাইস্কুল, চৌহালি, সিরাজগন্জ ), গল্পের নায়ক নাফিজের পিতা এবং একজন অপদার্থ মানুষ।
এয়ারপোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে পান কিনছেন।‌

"স্যার, পানে কি জর্দা দিমু?"
"দাও, হাকিমপুরী আছে ? সেইটা থাকলে দাও। সাবধান খয়ের দিবা না" পান নিয়ে হাফিজ সাহেব সামনে হাঁটা শুরু করলেন।

"মামা, প্লেনতো ল্যান্ড করছে, চলেন আমি আনসারকে ৮০ টাকা দিয়ে ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা করেছি, চাচী সামনেই আছেন, ট্যাক্সিও ভাড়া করেছি, ৪০০ টাকা।"
গল্পের পার্শ চরিত্র রকিব, মোহাম্মদ রকিব ইসলাম। হাফিজ সাহেবের একমাত্র ভাগ্নে, তিতাসের কন্ট্রাকটর।

"দেশে না এখন দূর্নীতি দমন অভিযান চলছে! কিভাবে এভাবে প্রকাশ্যে ঘুষ চলে ?" হাফিজ সাহেবের প্রশ্নে রকিব হাসে আর ভাবে মামা মানুষটা এখনো বোকাই রয়ে গেলো।
"মামা, ঘুষ বন্ধ হয় নাই, আগে সামনে নিতো এখন পেছন দিয়ে নেয়"।

৬ বছর পর নাফিজের সাথে দেখা হচ্ছে হাফিজ সাহেবের। একমাত্র সন্তান। অভাবের সংসারে ছেলেটা কি কস্ট করেই না পড়াশোনা করেছে। বুয়েট থেকে ক্যামিকেল ইন্জিনিয়ারিং এ পাশ করে অল্প কিছুদিনের জন্য বি।সি আই সিতে কাজ করলো, তারপর কি এক স্কলারশীপ যোগার করে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যায়। পড়াশোনা শেষ করে ওখানেই একটা কোম্পানীতে কাজ যোগার করে। হাফিজ সাহেবের স্বপ্ন ছিলো ছেলেটা পি.এইচ. ডি. করবে, সেটা আর করলো না নাফিজ।

"ও বাবা, রকিব। প্লেনতো ল্যান্ড করেছে। নাফিজ কই ? সবাইতো আসছে কিন্তু আমার নাফিজ কই? " শাহানা বেগম, নাফিজের মার এ কথা শুনে রাকিব সামান্য হেসে বলে " মামিমা, এইতো আইসা পরবো"।

রকিব, ডিগ্রী পাশ করে বেকার বসে ছিলো। হাফিজ মামা তাকে ঢাকায় নিয়ে আসলেন। সে অনেক চেষ্টা করেছে চাকরির জন্য, হয়নি। শেষ মেশ তিতাসে কন্ট্রাকটরের কাজ যোগার করে নেয়। চালু ছেলে। অল্প কয়দিনের মাঝেই সব ফাঁক ফোঁকর বের করে ফেলে। আজ কাল ভালোই কামায় সে। সেই নাফিজের বিয়ের ঘটক। রশিদ ভুইয়ার কারখানায় গ্যাসের পাইপ বসাতে গিয়ে যে পরিচয় হয়। কথায় কথায় বের করে ফেলে যে রশিদ ভুইয়ার একটা মেয়ে আছে যার জন্য রশিদ ভুইয়া বিদেশে থাকা ছেলে খুঁজছেন। রশিদ ভুইয়া বিশাল বড়লোক। জামাইকে পুরান ঢাকার আলুপট্টির বাড়ী, গুলশানের ফ্লাট দেবেন। একটাই শর্ত ছেলে শিক্ষিত ও বিদেশে থাকতে হবে। রকিব মামা-মামির সাথে কথা না বলে নাফিজের সাথে প্রথম কথা বলে, তারপর মামার সাথে কথা বলে। মামাকে রাজি না করাতে পারলেও মামিকে সহজেই রাজি করাতে পারবে। মামি কেনো রাজি হলেন সেটা সে অবশ্য বুঝতে পেরেছে। এত বছরের কস্টের পর মামি একটু স্বচ্ছলতার আশা করছেন। সেটা বড়লোক বিয়াইয়ের দ্বারাই হোক আর যে ভাবেই হোক সেটা ব্যাপার না।

শাহানা বেগম, নাফিজের মা। আটপৌড়ে, আর দশটা মায়ের মতোই। ছেলেকে দেখার জন্য অধীর হয়ে আছেন। কতদিন দেখেন না ছেলেটাকে। যে ছেলে মায়ের সাথে এক দিন না দেখে থাকতে পারতো না সেই ছেলে কিভাবে ছয়টা বছর একলা কাটিয়ে দিলো বিদেশে সেটা বুঝতে পারেন না শাহানা বেগম। ছেলের বিয়ে দেবেন। কত্ত কাজ। 'আচ্ছা, ছেলে বউ নিয়ে বিদেশে চলে গেলে আবার আসবেতো !' শাহানা বেগম ভাবছেন। এই নাফিজ ছাড়াতো আর কেউ নাই তার।

" মামি, ও মামা, ওই তো দেখা যায় নাফিজ ভাইকে , দেখতে পারছেন " রকিবের চিৎকারে আশে পাশের দুএকজন পাশ ফিরে তাকায়।
"নাফিজ ভাই দেখই অনেক ফর্সা হয়ে গেছে, একটু মোটাও" হাফিজ সাহেব পাগলের মতো খুঁজতে থাকেন নাফিজকে। শাহানা বেগমও অস্থীর ভাবে খুঁজতে থাকেন।
"ঐতো নাফিজ, আমার বাপজান" চিৎকার করে শাহানা বেগম ছুটে যান নাফিজের দিকে। হাফিজ সাহেব স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, বুঝতে পারছেন না কি করবেন।
রকিব এগিয়ে যায় সামনে।

----

এবার প্লেনে উঠেই মনে হচ্ছে এবার আসলেই সে বাংলাদেশে যাচ্ছে। চারপাশে অনেক ভাত ভাতে চেহারা, বাংলায় কথা বার্তা। ওয়ার্ক অর্ডার-শিপমেন্ট-বায়ার-এলসি শুনেই কিছু লোককে গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মনে হচ্ছে। চেহারায় সুখি সুখি ভাব কিন্তুকেমন যেনো ধুর্ততার আভাস। যাত্রিদের বেশিরভাগই গতর খাটা সাধারন মানুষ , সেই চিরচেনা সংগ্রামী যোদ্ধা। হয়তো অনেকের জন্যই এটা তাদের জীবনের দ্বিতীয় কিন্তু শেষ বিমানভ্রমন। আচরনে অনভ্যস্ততা ছাপ, চোখে দেশে ফেরত যাবার আনন্দ। কিছু তার মতো, প্রবাসী।

ছোটবেলায় শ্রতিলেখন বলে একটা খেলা হতো । একজন জোরে জোরে পড়তো আর বাকি সবাই শুনে শুনে তা লিখতো। যে সবচাইতে শুদ্ধ ভাবে এবং বেশী লিখতে পারবে সেই বিজয়ী। নাফিজ সবসময়ই প্রথম হতো। এ অভ্যাসটি আজো রয়ে গিয়েছে। আশে পাশে কেউ কথা বল্লে সে শুনতে পছন্দ করে। আচ্ছা এই শ্রুতিলেখন খেলাটাকি আজো খেলা হয় ! নাফিজ ভাবছে।

মনটা একটি বিষন্ন নাফিজের। সে ভাবছে রাজিবের কথা। কতো বিচিত্র মানুষ! কতো বিরিত্র জীবন মানুষের ! কতো বিচিত্র মানুষের কস্ট।

এবার পাশের সিটে এক হংকং চায়নিজ মহিলা, সাজে তরুনী আদতে পেত্নি, ইংলিশে উচ্চারনে বিচিত্র। অবশ্য আলাপ জমানোর ইচ্ছে নেই নাফিজের একদমই। সে ভাবছে আগত দিনগুলোর কথা। বিয়ে-সংসার-বাবা-মা-ভবিষ্যত জীবন।

টেলিফোনে হবু বউয়ের সাথে তিন চারবার কথা হয়েছে তার। শুধু ছবি দেখে আজকাল কি কেউ বিয়ে করে !! একজন আরেকজনকে দেখেনি কিন্তু বিয়ের পিঁড়িতে বসতে যাচ্ছে, এও কি ঘটে। আরে এটাতো তার জীবনেই ঘটছে!

" স্যার টি অর কফি "কেবিনক্রুর কথায় চিন্তায় ছেদ পরলো নাফিজের। "টি প্লিজ" বলে মুচকি হাসতেই কেবিন ক্রু অভ্যস্ত হাতে চা দিয়ে চলে গেলো। "থাংকস মাইট " বলে একটু হাসলো নাফিজ। এই কেবিন ক্রুর চেহারা কেন জানি সব সময়ই একই রকম লাগে নাফিজের। যতোবারই সিংগাপুর এয়ারে সে ভ্রমন করেছে ততবারই মনে হয়েছে সেই একই কেবিন ক্রু। এতবার অস্ট্রেলিয়ার বাহিরে বের হতে হয়েছে নাফিজকে ততবারই সে ভেবেছে সময়কারে সে একটু দেশে যাবে। হয়নি, কেন হয়নি সেটা অজানা।

৪ ঘন্টা যে কখন শেষ হবে !! অস্থির নাফিজ। ৬ বছর পর দেখা হবে বাবা মার সাথে। পলাশীর মোড়ে চা- মিতালি হোটেলের পরাটা ভাজি কতদিন খায়না সে। আচ্ছা বন্ধুরা কি সবাই আগের মতোই আছে ? মোড়ের মুন্শির দোকানটাকি আছে !?

"ভাই আমার ফরম টা একটু পূরন কইরা দিবেন" চমকে উঠে নাফিজ। তাকিয়ে দেখে একটি ছেলে, কতই বা বয়স হবে ২০ !! ২২ ? "সমস্যা নাই" বলেই নাফিজ পুরণ করতে থাকে ফরমটি। শেষ হতেই যখন সই করতে বল্ল তখন সে আবিস্কার করলো ছেলেটি লেখা পড়া জানে না। কোনক্রমে সই করতেই আরেকজন বল্ল ভাই আমারটাও কইরা দিবেন ! এভাবে বেশ কিছু ফরম পূরন করতেই নাফিজ নিচে তাকিয়ে দেখে। বাংলাদেশ দেখা যাচ্ছে। কক্সবাজার-চিটাগাং - নারায়নগন্জ- এইতো ঢাকা !! সে তাকিয়েই আছে। অন্ধকারে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু সে বোঝার চেস্টা করছে কোথায় কি। অন্ধকারে সবইতো একরকম লাগছে।

এয়ারপোর্টে সে বিদেশী পাসপোর্টধারীদের লাইনে দাড়িয়ে খুব তাড়াতাড়ি সব ফর্মালিটি শেষ করতেই চোখে পড়লো রাজিবকে। বয়স্ক এক লোককে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে সে। পাশে দাড়িয়ে শাড়ি পরা এক কিশোরী মেয়ে। মেয়েটাকি রাজিবের বউ? নাফিজ ভাবছে রাজিবের কাছ হতে বিদায় নিয়ে আসবে, পরমুহুর্তেই ভাবলো 'কি দরকার, থাক'।

ওইতো মা, ওইতো বাবা। পারলে সে উড়ে যায়।
পেছনে সে আবার তাকিয়ে দেখে রাজিব সেই বৃদ্ধ লোকটির হাত ধরে সামনে হেঁটে যাচ্ছে। নাফিজের কান বাজছে রাজিবের কান্না জরানো সেই কথাগুলো। "ভাই, আমি আপনার লগে মিথ্যা কথা কইছিলাম, আমি কোরিয়া গিছিলাম তয় ৮ বছর থাকি নাই। ভিসা শ‌্যাষ হওনে ইল্লিগাল ছিলাম। ২ মাস পরেই পুলিশ কারখানায় রেইড দিয়া ধরছে, তার পর সোজা প্লেনে তুইলা দিছে। ৮ লাখ টাকা খরচ কইরা কোরিয়া গেছিলাম, বাপের ভিটা-ধানের জমি জমা সব বিক্রি কইরা গেছিলাম, একটাকাও ফেরত আনতে পারি নাই, দ্যাশে আমার এখন থাকনের জায়গাটা পর্যন্ত নাই।"

"আমার বাবু সোনা, ও আমার বাবু সোনা" মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে নাফিজ, সেই ছোট্টবেলার মতো। বাবা সেই আগের মতোই নিরুত্তাপ, মুচকি হাসি। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে নাফিজ।
এর পরে কি হলো সেটা অন্য আরেক গল্প।

কোন মন্তব্য নেই :

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মন্তব্য পেলে খুশি হবো, সে যত তিক্তই হোক না কেনো।
পোস্টে মন্তব্যের দায়-দায়িত্ব একান্তই মন্তব্যকারীর। মন্তব্য মডারেশন আমি করি না, তবে অগ্রহনযোগ্য ( আমার বিবেচনায় ) কোনো মন্তব্য আসলে তা মুছে দেয়া হবে সহাস্য চিত্তে।