রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৭

বিজয় দিবসের ডেবিট ক্রেডিট

বছর ঘুরে আরেকটি বিজয় দিবস।প্রতিটি বিজয় দিবসেই হিসেবের খাতা খুলে বসি; কি পেয়েছি ,আর কি পাইনি। হিসেবে খাতায় না পাওয়ার পরিমাণটাই বেশী। লাল সবুজ পতাকা - স্বাধীন দেশ হয়তো অনেক বড় পাওয়া। তারপরো অনেক হিসেব বাকী রয়ে যায়।ফাইনাল একাউন্ট মেলাতে পারি না। ডেবিট-ক্রেডিটের হিসেব মেলানো আর হয়ে উঠে না।

চোখে রঙিন চশমা পরে দেশকে রঙিন দেখতে চাই, ভুলে যাই দেশের সেই সব সাধারন নাগরিকদের কথা যারা দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে স্বাধীনতার ৩৬ বছর পরও। পোশাকে সুগন্ধি ঢেলে দেশের দূর্গন্ধ ঢাকতে চাই, ভুলে যাই বস্তিবাসী সেই সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের কথা যারা একবেলা খাবারের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে একমুঠো ভাতের জন্য জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত।

ভন্ডামীর লেবাস ধরে নিজেকে সুখী প্রমানিত করতে চাই, বস্তি উচ্ছেদ করে শহরকে সুন্দর দেখাতে চাই।

মুক্তবুদ্ধি-মুক্তমনার কথা বলে কবিতা লিখি, সমাজ পরিবর্তনের কথা বলে গলা ফাটাই কিন্তু ভুলে যাই সেই সব সাহসী সন্তানদের কথা যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছিলেন।

সংবর্ধনার নামক প্রহসনে একটি কাগজের টুকরো বা নীলক্ষেত থেকে বানানো ৫০ টাকা মেডেল গলায় পড়িয়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভুগি, পরমুহুর্তেই ভুলে যাই কি অবস্থায় আছে সেই সব সন্তান হারা - স্বামী হারা মা-বোনেরা।

রাজনীতি জন্য, মুক্ত বুদ্ধির ব্যবসার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করি। ক্ষমতা যাবার অস্ত্র হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা-মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহারকারী। আজকাল মুক্তিযুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে মুক্তবাজার অর্থনীতির হাতিয়ার হিসেবে।

স্বাধীনতার বিনিফেসিয়ারী হিসেবে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবী করি। নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সৈনিক হিসেবে দাবী করি। আবার পত্রিকার পাতায় যখন নিউজ আইটেম হিসেবে ৭১ এর কোনো সাহসী সন্তানের জীবন সংগ্রাম বা অনাহারের খবর ছাপা হয় তখন বিবেক এক ঘন্টার জন্য জাগ্রত হয়। লিখে ফেলি কোন কলাম-ব্লগ বা কবিতা। সময়ে সেটাও ভুলে যাই। উহ্ আহ্ করে কস্ট অনুভব করি। কষ্ট বিলাস!

যুদ্ধাপোরাধীর যখন জাতীয় পতাকা লাগানো গাড়ি হাঁকিয়ে যায় চেয়ে চেয়ে দেখি। বিচার দাবী করি যুদ্ধাপোরাধীদের। আবার সুবিধাবাদীর মতো এদের সাথে বসেই আন্দোলনের রুপরেখা তৈড়ি করি, ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপোরাধীদের বিচারের কথা ভুলে যাই। ক্ষমতা হাড়ালে ক্ষমতার লোভে - রাজনীতির চালে দাবী করি বিচারের। সময়ে সেটা আবারো ভুলে যাই। রাজনীতির ঘেরাটোপ থেকে বিবেককে মুক্ত করতে পারি না। একটুও সাহসী হতে পারি না।

প্রতিটি বছর ঘুরে ২৬ শে মার্চ আসে, ১৬ ডিসেম্বর আসে। আমাদের শীত নিদ্রা ভাঙে। আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি কলম যুদ্ধে। কিন্তু পাশে এসে দাঁড়াই না জীবন সংগ্রামে পরাজিত মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে। একজন সাহসী সন্তানের পরাজয় যে আমাদেরই পরাজয় সে ধ্রুব সত্য ভুলে যাবার ভন্ডামী করি।

আজকাল বিজয় দিবস-স্বাধীনতা দিবস যেনো হয়ে গিয়েছে বানরের রুটি ভাগ করার মতো। আওয়ামী লীগের স্বাধিননতার কাহিনী শুধুই বংগবন্ধু কেন্দ্রিক, বিএনপির মেজর জিয়া কেন্দ্রিক। আমরা নিজেদের মতো ইতিহাস রচনা করি। মাঝ খান থেকে ইচ্ছে করেই চেপে যাই স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিগুলোর কথা। দুধ কলা দিয়ে সাপ পুষি আমরা। জামাতকে আন্দোলনের সংগী বানাই, সরকারের অংশীদার বানাই। দুধ কলা দিয়ে পোশা সাপ যে আজ পূর্নবয়স্ক সাপ, ছোবল মারা জন্য ফোঁস ফোঁস করছে সেটা দেখেও দেখি না।অবাক হতেও হই না । এটাই নিষ্ঠুর পরিনাম।

কালসাপকে আঁতুর ঘরেই মেরে ফেলার চিরন্তন সত্য আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। রাজাকার-আলবদর-আল শামস-শান্তি কমিটির পান্ডাদের হাতের অস্ত্র উদ্ধার না করে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র নিয়ে নিয়েছিলাম। সংক্ষিপ্ত আদালতের মাধ্যমে বিচার না করে আমরা সেই সব স্বাধীনতা বিরোধীদের সুযোগ করে দিয়েছিলাম দালাল আইনের মতো হাজারো ফাঁকওলা আইনের সাহায্য নেবার। শুধু আইন তৈড়ি করলেই হয় না , সে আইনের শক্ত-দৃড় প্রয়োগ থাকতে হয়। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ - ১৫ অগাস্ট এ সময়টুকুতে আমাদেরই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা সত্বেও স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার কতটুকু করতে পেরেছিলো সেটা ভেবে দেখতেও দেখি না। জেনারেল জিয়া এসেতো শুরু করলেন গনতন্ত্র প্রতিস্থার নামে স্বাধীনতাবিরোধীদের পুর্নবাসন। একে এক সরকার পরিবর্তন হয়েছে। পূর্নবাসন চলেছে। সেই পুর্নবাসীত কালসাপ আজ প্রতিস্টিত অপশক্তি, ছোবল দেবার জন্য প্রতিক্ষায়। আমরা চেয়ে চেয়ে দেখি।

স্বাধীনতাবিরোধী-যুদ্ধাপোরাধী যে কালসাপকে আমরা দুধ-কলা দিয়ে পুষেছি সেই কাল সাপ আজ যৌবন জ্বালায় জ্বলছে। তারা মহাসুখেই আছে। তারা আজ প্রতিষ্ঠিত শক্তি।

মুক্তিযুদ্ধের বিনেফিসিয়ারী হিসেবে আমি বা আমরাও মহাসুখেই আছি। আমাদের খড়ের কুঁটির আজ প্রাসাদ হয়েছে, সাইকেল হয়েছে দামী বিএমডব্লিউ, কেরানী থেকে আমরা সেক্রেটারী হয়েছি।

কিন্তু সুখে নেই ৭১ এর সেই সব সাহসী সৈনিকরা যারা জীবন সংগ্রামে পরাজিত সৈনিক।‌ তাদের ভিক্ষার থলের সামনে দিয়েই সদর্পে মিছিল করে যায় ৭১ এর পরাজিত কালসাপরা, পতাকা উড়িয়ে গাড়ি হাঁকায় আল বদর প্রধান, তারা চেয়ে চেয়ে দেখে, অক্ষম ক্রোধে বিক্ষুব্দ হয়, আবারো ভুলে যায় পেটের আগুন নেভানোর সংগ্রামে। তাদের সন্তানদের হতে হয় আমাদের কারখানার শ্রমিক। তাদের মেয়েদের হতে হয় আমাদের শয্যাসংগীনি। আমাদের সুখের বিনিময়ে তারা বেছে নিয়েছে দূঃখ।

যে জাতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মান দিতে জানে না সে জাতি একটি ভন্ডা জাতি। আর আমি সেই ভন্ড জাতির ভন্ড নাগরিক।

বস্তির অন্ধকার ঘরে যেই সাহসী যোদ্ধার আগুন চোখ জ্বল জ্বল করে জ্বলতে থাকে আরেকটি ৭১ এর প্রতিক্ষায়, আর আমরা বাকার্ডি হাতে চিয়ার্স বলে হেঁকে উঠি বিজয় দিবস উদযাপনে।
জয়বাংলা
--------------------------
আমার এ লেখাটি জীবন সংগ্রামে পরাজিত মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য নিবেদিত যাদের কথা পত্রিকা ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না।
ক্ষমা চাই হে সাহসী মানব।

কোন মন্তব্য নেই :

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মন্তব্য পেলে খুশি হবো, সে যত তিক্তই হোক না কেনো।
পোস্টে মন্তব্যের দায়-দায়িত্ব একান্তই মন্তব্যকারীর। মন্তব্য মডারেশন আমি করি না, তবে অগ্রহনযোগ্য ( আমার বিবেচনায় ) কোনো মন্তব্য আসলে তা মুছে দেয়া হবে সহাস্য চিত্তে।