বুধবার, ১১ জুলাই, ২০০৭

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা: পক্ষ-বিপক্ষ

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা আজকাল রাজনৈতিক অর্থেই বেশী ব্যবহৃত হতে দেখা যাচ্ছে।

১.
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতে গিয়ে আজকাল এক ধরনের রাজনৈতিক মেরুকরন দেখা যায়। আওয়ামী লীগ ঘরানার মানুষ মনে করেন যেহেতু তারা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন সেহেতু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লাইসেন্সিং তাদের একান্তই নিজস্ব। তাদের মতের সাথে না মিল্লেই আরেকজনকে চেতনার বিরোধী বলে দেয়া হয়।
যে "জয়বাংলা " শ্লোগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে যেতেন সেই জয়বাংলা শ্লোগান যেনো আওয়ামী লীগের নিজস্ব সম্পততি। আবার জয়বাংলা শ্লোগান দিলেই কিছু মানুষ আওয়ামী লীগার বানিয়ে দেয়। আজব সব ব্যপার। আবার জয়বংগবন্ধু শ্লোগান না দিলেও সেই ব্যাক্তিকে অনেকসময়ই চেতনার বিরোধী বলা হয়।ধরা যাক, একজন মুক্তিযোদ্ধা। উনি বামপন্থায় বিশ্বাষ করেন বা কোনো দলই করেন না। উনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে জয়বাংলা বলেন কিন্তু জয়বংগবন্ধু বলেন না। এই জয়বংগবন্ধু না বলার কারনে কি তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী বা রাজাকার মনোভাবসম্পন্ন বলা যাবে ?

২.
৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের কথা একটি চিরন্তন সত্য। ছোট কিছু বামপন্থি দলের ক্ষুদ্র অংশ ( উদাঃ আবদুল হকের পূর্ব বাংলার কম্যুনিস্ট পার্টি ) ছাড়া সব দলের সম্পৃক্তাতেই মুক্তিযুদ্ধ সফল হয়েছিলো। তবে সেই সময় বামপন্থিদের যুদ্ধে অংশগ্রহন করাটা অনেকক্ষেত্রেই দূসাধ্য ছিলো। প্রতিটি ইয়থ ক্যাম্পের দ্বায়িত্বে থাকতেন একজন এম.এন.এ বা এম.এল.এ, যারা মূলত আওয়ামী ঘরানার ব্যক্তি। যারা মুক্তিযোদ্ধা রিক্রটের প্রাথমিক দ্বায়িত্ব পালন করতেন। এসময় অনেকসময়ই দেখা হোতো মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনুচ্ছ ব্যক্তি আওয়ামী লীগ করেন কি না বা পাকবাহিনীর চর কি না। একজন ব্যক্তি আওয়ামী পরিচয় দিতে পারলে যতোটুকু সহজ হতো যুদ্ধে অংশগ্রহন করে ততোটুকুই কষ্টসাধ্য ছিলো বামপন্থায় বিশ্বাষ করলে। সেক্টর ২ তে যতোসংখক বামপন্থায় বিশ্বাষী মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া যায় অন্য সেক্টর গুলোতে সেই সংখ্যায় বামপন্থি মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া যায় না।
এটা বলা হচ্ছে এই ভেবে যে, একজন বামপন্থি আওয়ামী চিন্তা চেতনায় বিশ্বাষী না হলেই বলা যাবে না যে উনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সৈনিক নন।

৩.
অনেকই আছেন যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেন ও অন্তরে ধারন করেন কিন্তু রাজনৈতিক বা সামাজিক মূলধারার সাথে সম্পৃক্ত নন কোনো ভাবেই। এ সম্পৃক্তহীন কারনে তাদের প্রকাশ করার সুযোগ থাকে না বা সম্ভব হয় না। এখন তাদেরকে কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী বলা যাবে ?
এটা বলা হচ্ছে সেই সব মানুষদের কথা ভেবে যারা দেশপ্রেমিক, নিরব যোদ্ধা, সাধারন মানুষ যারা চেতনা ধারন করেন কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে মিশে ঝাঁকের কৈ হতে চান না বা হোন না।

৪.
বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মান্ধ না।৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ যে কোনোক্রমেই ইসলামের বিরুদ্ধে ছিলো না সেটা স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি (জামাত ও অন্যান্য ইসলামজীবি দল) ছাড়া অন্য সবাই স্বীকার করবেন।
জামাত যেমন ইসলাম কে ব্যবহার করে তাদের হীন, নোংরা স্বার্থ চরিতার্থ করতে চায় এবং পাপ ঢাকতে চায় তেমনি কিছু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষ ইসলামের সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে গুলিয়ে ফেলেন। তাদের অনেকের কাছেই কাছে মনে হয় ইসলামের বিরোধীতা করা মানেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শক্তিশালী করা।
ধরা যাক, একজন ষাটোর্ধ মুক্তিযোদ্ধা, ধর্মভীরু, ইসলামে বিশ্বাস করেন ও তা পালন করেন বা চেষ্টা করেন। এই ধর্মে বিশ্বাস করা বা পালন করার কারনে কি তাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষ বলা যাবে?

৫.
মুক্তিযুদ্ধে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের কোনোরকম ম্যানিফেস্টো ছিলো না এবং ধর্ম সেখানে মুখ্য কোনো বিষয় ছিলো না। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনে বিশ্বাসী জামাত-এ-ইসলামী ও অন্যান্য ইসলামজীবি দলগুলোর ( নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য কিছু ভুঁইফোর দল) ক্ষুদ্র অংশের বিরোধীতা সত্বেও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দেশ স্বাধীন করার চেতনায় একতাবদ্ধ হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলো।
এই ধর্মান্ধ গোস্ঠী এখনো তত্পর, প্রকারন্তরে আরো শক্তিশালী, আশার বিষয় তা তৃনমূল পর্যায়ে নয়। এই অপশক্তি অতীত ও বর্তমানে ইসলামকে ব্যবহার করে এসেছে। এদের সাথে যোগ হয় কিছু পীর নামক ব্যবসায়ী। শীতকালে ওয়াজ বা ওরশ নামের নোংরা উত্সবে মানুষের ঢল দেখে এদের মনে হয় যে বাংলার মানুষ তাদের পক্ষে। তবে নির্বাচনের সময় এদের গো-হারা প্রমান করে দেয় এদের অজনপ্রিয়য়তা। এর মাধ্যমে এটাই কি প্রমান করে না যে মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসি হতে পারে তবে ধর্মান্ধ নয় !
এটার মধ্য দিয়ে আমি বলতে চাই যে একজন ধর্মভীরু মানুষ ( সে যে ধর্মেই বিশ্বাসী হোক না কেনো) ধর্মান্ধ নাও হতে পারেন । এ কারনে ইসলামকে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষ বলে গুলিয়ে ফেলেন তাদের এ গুলিয়ে ফেলা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ঐক্যকেই দূর্বল করে দেয়।

৬.
একজন মানুষ ধর্মভীরু হতেই পারেন । সেটা তার অধিকার। মুক্তিযুদ্ধের মুল লক্ষে গুলোর একটি ছিলো সব ধর্ম ও মতের সমান অধিকার ও পালন করার স্বাধীনতা অর্জন। একজন মানুষ ইসলামের কথা বল্লেই সোজাসুজি তাকে পাকিস্তান পন্থি বা জামাত পন্থি বলে দেয়া যায় না ঠিক যেমন যায় না একজন মানুষের হিন্দুত্বের সাথে ভারতের দালাল বলে দেয়া।
আজকাল দেখা যায়, একজন মানুষ দাড়ি-টুপি রাখলেই তাকে জামাত পন্থি বলে দেয়া হয়। তার সে লেবাস তার ধর্মীয় ভাবধারা থেকে আসতে পারে , তার মানে এই না যে সে একজন রাজাকার।
এ প্রসংগে গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একটা পোস্টারের কথা বলতে চাই। সে পোস্টারে একটি কুকুরের মাথায় টুপি পড়িয়ে তাকে রাজাকার-জামাতী বলা হয়েছিলো। সেই পোস্টারকে পূঁজি করে জামাতী ও বিএনপি প্রচার করেছিলো আওয়ামী লীগ ইসলাম বিরোধী যা গ্রাম ও শহরের সাধারন মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিলো খুব সহজেই।
এ উদাহরনের মাধ্যমে বলতে চাচ্ছি, এ ধরনের রাজাকার বানানোর ব্রান্ডিং আখেরে ক্ষতিই টেনে আনে।
বেগম সুফিয়া কামাল একজন প্রবল ধার্মিক মানুষ ছিলেন। তবে চেতনায় ছিলেন একজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সৈনিক।তার ধর্মীয় বিশ্বাস ও পালন তার চেতনাকে দূর্বল কি করে দিয়েছিলো ?
ইসলাম পালন ও বিশ্বাস করলেই তাকে ধুম করে রাজাকার বা জামাত বলে দেয়া যায় না, এটা বুঝতে হবে অনেককেই।

৭.
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা রাজনীতির খেলার মাঠ ছাড়াও সাহিত্যে বহুল ব্যবহৃত হয়।
দেশের কবি-সাহিত্যিক দের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ ও চেতনা নিয়ে নানা কিছু লিখে থাকেন। আমাদের এ লেখা-লেখি অনেক ক্ষেত্রেই ২৬ শে মার্চ বা ১৬ ডিসেম্বর নির্ভর। তবে এর অনেক ব্যতিক্রমও আছে।
লেখালিখি অনেক সময়ই ব্যক্তিপূজায় চলে যায়। বংগবন্ধু শেখ মুজিব বা মেজর জিয়া কেন্দ্রিক, লেখকদের মাঝে পার্টিজান মনোবৃত্তি বেশ লক্ষনীয়। তবে এটাও লক্ষনীয় যে এ ধরনের লেখা-লেখিতে সাধারন মুক্তিযোদ্ধা বা বীরাংগনা তেমন আসেই না। অনেক সময়ই যুদ্ধের বর্ননা যেভাবে দেয়া হয় সেভাবে দেয়া হয়না ৭১ এ ভারতে আশ্রয় নেয়া প্রায় ১ কোটি শরনার্থির কথা !
আমাদের সাহি্ত্যের জগতে যে সব তথাকথিত বিশাল মানুষরা রয়েছেন তাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ যুদ্ধের অভিগ্যতা নেই। আমার চেনা ও জানা মতে কবি রফিক আজাদ ছাড়া আর কাউকেই দেখিনি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে।
কবি রফিক আজাদ যখন রাইফেল হাতে টাঙাইল ফ্রন্টে ঠিক তখন কবি শামসুর রাহমান দৈনিক পাকিস্তানে কর্মরত বা সৈয়দ হক পায়ের আওয়াজ মার্কা লিখেছেন লন্ডনে বসে। বাস্তব অভিগ্যতা ছাড়া এই সব লেখককে শুধু আবেগ সম্বল করে লিখে যেতে হয়।
শারিরীক স্বামর্থ থাকা ও অনেকের পিছুটান না থাকলেও অজানা কারনে তারা যুদ্ধে যাননি। যুদ্ধের বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে লেখা ও নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে লেখার মাঝে অনেক ফারাক রয়েছে।
তাদের চেতনার ব্যপারে কোনো প্রশ্ন তুলছি না, সেটা তোলাও ঠিক হবে না। তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি শুধু কলমবাজি করলেই চেতনার প্রকাশ হয়ে যায় না। বাস্তব জগতেও সেটা প্রমানও করতে হয়, যার সুযোগ সে সময় কি তাদের অনেকের ছিলো না?

৮.
মধ্যবিত্য সমাজে অনেকের কাছেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা এক ধরনের ফ্যাশনের মতো। আমার কাছে এটাই মনে হয় আজকাল।
পত্রিকার পাতায় ফিচায় বা বড় বড় কলাম লিখতে পারে অনেকেই কিন্তু পত্রিকার পাতায় যখন কোনো হতদরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা কথা বলা হয় তখন জানতে ইচ্ছে হয় ঠিক কয়জন সেই সব কলাম বাজ সেই মুক্তিযোদ্ধার পাশে এসে দাঁড়ান !!
পত্রিকার পাতায় মুক্তিযোদ্ধাদের দারিদ্রের কথা বা মুক্তিযোদ্ধা পিতার সামনে মেয়েকে ধর্ষন করার খবর বেশ ফলাও করে প্রচার করা হয়। " ব্যাড নিউজ ইজ গুড নিউজ " । আর আমরা মধ্যবিত্য কলামপেশী বা ব্লগারুরা সেটা নিয়ে বড় বড় কথা বলি কিন্তু পাশে এসে দাঁড়াতে বল্লে নানা কারনে সেটা এড়িয়ে যাই।
চেতনার কথা শুধু কলমের নিভে না এসে বাস্তব জগতে তার প্রয়োগও করতে হয়। এটাও মনে রাখতে হয়।

৯.
মুক্তিযোদ্ধার চেতনা বড় বড় কথা দ্বারা প্রকাশ করতে হয় কাজ দ্বারা। এটা আমি বেশ কবার বলতে চেয়েছি। তবে এরও অনেক ব্যতিক্রমটা বলছি এখন।
আমাদের এই ছোট্ট সবুজ দেশটিতে অনেক নিরব যোদ্ধা রয়েছেন যারা চেতনা বুকের ভেতর লালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের যাদুঘরে দেখেছি অনেকেই অনেক টাকা দিয়েছেন কিন্তু নাম প্রকাশ করেননি। এই সব নিরব চেতনার সৈনিকদের চেতনার কি মুল্য নেই? অবশ্যই আছে। এই সব নিরব সৈনিকদের সংখ্যাই কিন্তু বেশি।

কোন মন্তব্য নেই :

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মন্তব্য পেলে খুশি হবো, সে যত তিক্তই হোক না কেনো।
পোস্টে মন্তব্যের দায়-দায়িত্ব একান্তই মন্তব্যকারীর। মন্তব্য মডারেশন আমি করি না, তবে অগ্রহনযোগ্য ( আমার বিবেচনায় ) কোনো মন্তব্য আসলে তা মুছে দেয়া হবে সহাস্য চিত্তে।