শনিবার, ৭ মে, ২০১১

ব্লাডি ফেয়ার ডিংকুম ১২

চারমার্সে কাজ শুরু করবার দিনটার কথা এখনো মনে আছে। প্রবাস জীবনের প্রথম চাকুরি। অনেকে হয়তো অডজব / প্রপার জব বলে চিন্তিত হতে পারেন তবে আমার কাছে সবগুলোই চাকুরি। দূপুরে ইন্টারভিউ দেবার পর থেকেই মনে হচ্ছিলো কখন সন্ধ্যে আসবে আর কখন কাজ শুরু করবো। পকেট ছিলো গড়ের মাঠ। "ক্যাশ ইন হ্যান্ডে" এ কাজটা ছিলো আমার কাছে চৈত্রের প্রচন্ড দাবদাহে এক পশলা বৃস্টির মতোই আশির্বাদ।
সন্ধ্যা ৫ টার আগেই হাজির হলাম কিচেনে। ছোট্ট এক কিচেনের এক কোনায় আমার আপিস, থুক্কু ডিশ ওয়াশিং মেশিন। "ক্লোভার" নামের এক মেয়ে আমাকে দেখিয়ে দিলো কি করতে হবে। কাজ বলতে কাস্টমারের রেখে যাওয়া প্লেট-গ্লাস ডিশ ওয়াশারে দিয়ে পরিস্কার করা, ধোয়া শেষ হলে পরিস্কার তোয়ালে দ্বারা মোছা, শেফের হাড়ি পাতিল ধোয়া এবং পেছনের শেলফ ও ফ্রিজারে স্টক সাজিয়ে রাখা আর সব কিছু শেষ হলে কিচেন পরিস্কার তকতকে করে রাখা। ডিশ ওয়াশারটা ছিলো আদিম কালের। রেস্টুরেন্ট মালিক পোলিশ মাইগ্রেন্ট এন্ড্রু যে বছর অস্ট্রেলিয়া এসেছিলো সেই ষাটের দশকে কেনা বলে সবাই হাসাহাসি করতো। কিছু ক্ষন কর পরই তাতে গরম পানি দিতে হতো, নাহলে সেটা পুড়ে যাবে !

কাজের শুরুতেই স্যুট থুক্কু এপ্রোন পড়িয়ে দিলো ক্লোভার। লান্চ শিফটের কিচেন হ্যান্ড এক গাদা ডিশ রেখে গিয়েছিলো আমার জন্য। সেগুলো ধুয়ে শেষ করতে না করতেই ডিনারে আসা কাস্টমারদের ডিশ আসা শুরু করলো, সাথে শেফের দেয়া ফ্রায়িং প্যান ও সস প্যানতো আছেই। সব কিছু শেষ করে যখন ঘড়ির দিকে তাকালাম তখন দশটা বাজতে ৫ মিনিট বাকি। ক্লোভার ক্যাশ থেকে ৫০ ডলার বের করে হাতে দিতেই অন্যরকম এক অনুভূতি ছিলো। অনেক দিন টাকার অভাবে সিগারেট খাওয়া হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার জীবনের প্রথম উপার্জনে এক প্যাকেট ডানহিল ব্লু কিনলাম। কি যে অপার্থবি শান্তি লেগেছিলো তা বলে বোঝানো যাবে না।

পরের দিন মালিক এন্ড্রুর সাথে দেখা হলো। সে বল্লো পেছনের কড়িডোর ভালো ভাবে ঝাড়ু দিয়ে ও পানি ঢেলে ভালো ভাবে পরিস্কার করতে। সে বল্লো এটা নাকি আমাকে প্রতিদিনই করতে হবে। করলাম পরিস্কার ভালো ভাবে। সে এতেও সন্তুস্ট হতে পারে না। দিনের পর দিন পরিস্কার না করা করিডোর পরিস্কার করা যে ঝামেলার সেটা তাকে বোঝানোর সাহস হয়নি। কিছু দিন পর সে বল্লো গেস্ট টয়লেটের দিকে লক্ষ্য রাখতে। মাঝে মাঝে সময়করে সেটাও নাকি আমাকে পরিস্কার করতে হবে !

মন প্রাণ দিয়ে কাজ করেছি সেখানে। সব সময়ই ভয় ছিলো এই বুঝি চাকুরি চলে যাবে। চলেও গিয়েছিলো হঠাৎই। সে কথায় পরে আসছি। ইংরেজী মোটামুটি ভালো হলেও ওখানে ওদের কথা বুঝতে অনেক সময়ই খুব সমস্যা হতো। ওরা একটা বলতো আর আমি বুঝতাম আরেকটা। ভাবতাম ওরা বুঝি হাসাহাসি করবে এটা নিয়ে। কিন্তু তা না করে ওরা আমাকে বুঝিয়ে বলতো, অনেক সময়ই ধীরে ধীরে বলতো যাতে আমি বুঝতে পারি। কাজ শুরু হতেই ওয়েট্টেস মেয়েরা এসে জিজ্ঞেস করতো কি খেতে চাই। শুরুতেই কফি বা কোক দিয়ে যেতো, কাজের ফাঁকে এসে বলতো আর কি চাই বা কোনো সাহায্য দরকার কি না। দেশে আমরা ধন্যবাদ জানাতে চাই না, দূঃখিত হতে জানি না ভুল করলে। ওখানেই শিখেছি কিভাবে ধন্যবাদ জানাতে হয়, দূঃখ প্রকাশ করতে হয়, অনুরোধ করবার সময় "প্লিজ: বলতে হয়। ক্লোভার ছাড়া আর কারো নাম মনে নেই। এএনইউ এ পড়া একটা মেয়ের কথা মনে আছে। কি মায়া ভরে জিজ্ঞেস করতো কি কফি খেতে চাই। নাম ভুলে যাওয়া এক ওয়েটারের কাজই ছিলো নিজের জন্য শর্ট ব্লাক বানানো আর আমার জন্য একটু নিয়ে আসা। অজি মানুষদের সাথে কাজ করে কাছ থেকে দেখে এদেশের সংস্কৃতি - মননকে যে চেনায় ছিলাম তার প্রভাব এখনো আছে আমার মাঝে।

স্যু ছাড়াও আরো দুই মহিলা ও আরেক ছেলে শেফ কাজ করতো চারমার্সে। ইজিপশিয়ান মহিলার কথা মনে আছে এখনো। উনি তার প্রথম জীবনের গল্প বলতেন কাজের ফাঁকে ফাঁকে। কিভাবে একজন কোয়ালিফায়েড নার্স হয়ে উনি কিচেন হ্যান্ডের কাজ করতেন, কিভাবে উনার ম্যাকানিক্যাল ইন্জিনিয়ার স্বামী ক্লিনারের কাজ করতেন। বছরের পর বছর সংগ্রামের পর উনি যখন ক্যালভারী হাসপাতালের রিটায়ার্ড নার্সিং ম্যানেজার বা উনার স্বামী স্নোয়ী যখন মাউন্টেইন হাইড্রো ইলেকট্রিক প্লান্টের কনসালট্যান্ট ইন্জিনিয়ার সেই গল্প করে বলতেন আমাকেও কস্ট করতে। সময়ে সবকিছুই উন্নতি হয় , আমারো হবে এটা বলে মনে সাহস দিতেন। চিলিয়ান আরেক মহিলার সাথে দু একবার কাজ করেছিলাম। এন্ডু না থাকলে সে এক গাদা রান্না বান্না করতো নিজের বাসায় নিয়ে যাবার জন্য, আমাকেও ঘুষ সাধতো যাতে আমি কাউকে না বলি। পিটার নামে যে ছেলে শেফ ছিলো সে ছিলো পুরোদস্তর বর্নবাদী। তার সাথে এক রাত কাজ করেই সু'কে বলেছিলা যে আমি পিটার এর সাথে কাজ করতে চাই না।

চারমার্সে কাজ করতে করতে রান্না শিখে গিয়েছিলা, করতে করতে না; দেখতে দেখতে। হড়েক রকম আইটেম যার নাম শোনাতো দূরের কথা চোখেও দেখিনি। আগেই বলেছি অনেক মন প্রান দিয়ে কাজ করতাম। এক সময় দেখা গেলো ৫ ঘন্টার শিফটে যে কাজ করতে হয় সেটা আমি ৪ ঘন্টাতেই শেষ করে ফেলি। এন্ড্রু এসে বল্লো এখন থেকে শিফট ৪ ঘন্টার হবে, টাকাও পাবো ৪ ঘন্টার। ব্যস্ত শিফটে আমি ৪ ঘন্টার টাকা পেতাম, তুলনামুললক ভাবে হালকা শিফটে কাজ করে অন্যরা পেতো ৫ কি সাড়ে ৫ ঘন্টার টাকা।

একবার সিডনী বেড়াতে গেলাম। বেড়িয়ে এসে রোস্টার চেক করতে গিয়ে দেখি আমার নাম নাই। সউ'কে জিজ্ঞেস করাতে সে বল্লো আমার কাজ ভালো না তাই আমি ছাঁটাই। কদিন বাদে বাসে ইজিপশিয়ান শেফের সাথে দেখা হলে উনি বলেছিলেন , সু তার নাতিকে চাকরি দেবার জন্য আমাকে বাদ দিয়েছিলেন।

হঠাৎই বেকার হয়ে গেলাম

(চলবে)

২টি মন্তব্য :

আপনার মন্তব্য পেলে খুশি হবো, সে যত তিক্তই হোক না কেনো।
পোস্টে মন্তব্যের দায়-দায়িত্ব একান্তই মন্তব্যকারীর। মন্তব্য মডারেশন আমি করি না, তবে অগ্রহনযোগ্য ( আমার বিবেচনায় ) কোনো মন্তব্য আসলে তা মুছে দেয়া হবে সহাস্য চিত্তে।