মঙ্গলবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

যুদ্ধে যারা গর্তের অধিবাসী, যুদ্ধের শেষে তাহারাই সোচ্চার


জীবনের একটা সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অন্যরকম এক ধারনা কাজ করতো। হয়তো ছবিতে রাইফেল হাতে দীপ্ত যোদ্ধাদের দেখেই এমনটি হয়েছিলো। প্রথম যখন সামনা সামনি একজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেছিলাম তখন প্রচন্ড অবাক হয়েছিলাম। জীর্ন শীর্ন এক লোক, নোংরা মলিন লুঙি পড়া এক মধ্যবয়সী এক মানুষ। সামনে বসে যখন খাচ্ছিলেন তখন মনে হচ্ছিলো কত দিন যেনো না খেয়ে আছেন। সহায় সম্বলহীন সেই মানুষটি ছিলেন একজন বীর প্রতিক। শেষ সম্বল ভিটা মাটি বাঁচাতে বাবার কাছে এসেছিলেন। পুলিশ দিয়ে তাঁর ভিটে ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হলেও পরে কি হয়েছিলো সেটা জানা হয়নি আর। তবে তার চেহারা এখনো চোখে ভাসে ' চোখগুলো যেনো জ্বল জ্বল করছে'।

এটিও অনেক বছর আগের কথা। ১৬ই ডিসেম্বরে ১৯৯*। ঢাকার আশে পাশে কোনো এক থানায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দেয়া হবে। অনুস্ঠানটি দেখার দূর্ভাগ্য হয়েছিলো। সাজানো মন্চের মাঝ খানে বিশাল চেয়ারে প্রধান অতিথি হিসেবে ডি.সি, তার আশে পাশে মেঝো-সেজো আমলা। সবার বামে থানা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের কমান্ডার। সামনের সাড়িতে নরম সোফায় স্বস্ত্রীক আমলারা। আর যাদের জন্য অনুস্ঠান তাঁরা বসেছে পেছনের সারিতে, গাদা গাদি করে, কাঠের ফোল্ডিং চেয়ারে। বেশীর ভাগের পড়নেই লুঙি, হয়তো সবচাইতে ভালো লুঙি-জামা পড়েই তাঁরা এসেছিলেন। অনুস্ঠান শেষে অনেককেই ভ্যানে করে গাদাগাদি করে চলে যেতে দেখা যায়, পাশেই ধুলো উড়িয়ে ডিসির পাজেরো।

উপরের দুটো ঘটনা বলার মাজেজা হলো মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান অবস্থা বোঝানো। যাদের সামনে থাকার কথা ছিলো তারা আজ পেছনে, যাদের সব কিছু পাবার কথা ছিলো তারাই আজ অবহেলিত। আজকের দিনে অনেককেই মুক্তিযু্দ্ধের স্মৃতিচারন করতে দেখি, যাদের বেশির ভাগকেই ৭১ এ অস্ত্রহাতে দেখা যায় নি। যুদ্ধের অভিগ্যতা বন্চিত এই মানুষগুলো বড় গলায় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন, মুক্তিযোদ্ধা ক্যটাগরিতে প্লট নেবার জন্য তোষামুদিও করেন। ৭১ এ মুক্তিযোদ্ধাদের বদনা এগিয়ে দেয়া লোকও আজ মুক্তিযোদ্ধা। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের যখন খবর নেবার সময়ও পাওয়া যায় না।


পত্রিকার পাতায় মাঝে মাঝেই গরীব মুক্তিযোদ্ধাদের খবর পড়ার দূর্ভাগ্য হয়, যথারীতি সে সব খবরের স্থান হয় মাঝের পাতায় কোনো এক কোনে। মফস্বল সংবাদদাতার পাঠানো সংবাদগুলো যে আজো পত্রিকার নিউজ এডিটরের নেক নজর পায় সেটাই অবাক করার মতো ঘটনা। অবশ্য এসব খবরের আনাগোনা চোখে পড়ে ডিসেম্বর বা মার্চ মাসেই। বছরের অন্যান্য সময়ে ব্যস্ত থাকা হয় অন্য সব কিছু নিয়ে।

আমরা এমনই এক অকৃতগ্য জাতি যারা তাদের বীর সন্তানদের প্রকৃত সম্মানটুকুই দিতে পারিনি, দেইনি। চেতনার কথা বলি কিন্তু চেতনার সৈনিকদের সযতনে পাশে সরিয়ে যুদ্ধের ইতিহাস লিখি। মাসে ৫০০ টাকা ভাতা দিয়ে বাহাব নেই, মারা যাবার পর রাস্ট্রীয় সম্মান দেই কিন্তু জীবদ্দশায় খবর নেই না।

জীবনের একটা সময় বোকার মতো আগ্রহ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পরে থাকা হতো। এখন অবশ্য সে সময় নেই। আর দশটা স্বার্থপর মানুষের মতই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। মাজে সাজে মুক্তিযুদ্ধ- মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ঊঁ-আহ্‌ করে আত্নতুস্টিতে ভুগি আর কি। এটাও আজকালকার এক ধরনের ফ্যাশন। ফাক দিজ ফ্যাশন।

১৯৭১ - ২০০৯; ৩৮ টি বছর। ৭১ এর সদ্য গোঁফ ওঠা কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আজ পক্ক কেশের এক মধ্যবয়সী পৌড়। হয়তো পরপারেও অনেকে। সম্মান দেয়া হলো না, তাদের প্রাপ্যটাও দেয়া হলো না। শালার বাঙালী জাতি।

"যুদ্ধে যারা গর্তের অধিবাসী, যুদ্ধের শেষে তাহারাই সোচ্চার" - আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর লেখা কোনো এক কবিতার দুটো লাইন অনেক কিছুই বলে দেয়। আর কিছু কি বলার আছে ?

কোন মন্তব্য নেই :

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মন্তব্য পেলে খুশি হবো, সে যত তিক্তই হোক না কেনো।
পোস্টে মন্তব্যের দায়-দায়িত্ব একান্তই মন্তব্যকারীর। মন্তব্য মডারেশন আমি করি না, তবে অগ্রহনযোগ্য ( আমার বিবেচনায় ) কোনো মন্তব্য আসলে তা মুছে দেয়া হবে সহাস্য চিত্তে।