শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০০৮

মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও - ১.৭ শেষ ( একটি কথ্য ইতিহাস)

প্র: আপনি ১৫ এপ্রিল ঠাকুরগাঁওয়ের পতন হয় বলেছেন। পুনরায় রি-অরগানাইজ হয়ে কবে থেকে আপনারা যুদ্ধ শুরু করলেন ?
উ: এরপর তো ভারতে গিয়ে আমরা পুনরায় সংগঠিত হতে লাগলাম। ভারতে এসে যোগাযোগ করতে করতেই তো এক মাস সময় লেগে গেলো। মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর আমরা দ্রুত সংগঠিত হতে শুরু করলাম। আমার মনে আছে, আমরা ছোট্ট একটা ঘরে ১৬ জন ঘুমিয়ে ছিলাম। চিৎ হয়ে শুলে চার আনা আর কাত হয়ে শুলে দুই আনা-এ রকম একটা অবস্থানে ছিলো সে সময়। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়ে আমরা পুনরায় অপারেশন শুরু করতে পেরেছিলাম সম্ভবত: জুন মাস থেকে।

প্র: মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের মানুষের ধারণা কেমন ছিলো ?
উ: মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে জনগণের ধারণা ভালো ছিলো বলেই তো দেশটা স্বাধীন হতে পেরেছে। মুক্তিযোদ্ধারা যখনই যে জায়গায় বা এলাকায় ঢুকেছে, তখনই সেই এলাকায় তারা আশ্রয় পেয়েছে। স্থানেনীয় জনগণ যদি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় না দিতো, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ কখনই এই পর্যায়ে শেষ হতে পারতো না। মুক্তিযোদ্ধারা যে সমস্ত জায়গায় পাক আর্মিদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিলো বা ব্রিজ-কালভার্ট ধ্বংস করেছিলো তার প্রত্যেকটাই স্থানেনীয় জনগণের সাহায্য সহযোগিতায় তারা করেছিলো। মুক্তিযোদ্ধারা সাধারণভাবে রাতে ঘুরে বেড়াতো। কারণ পাকিস্তানআর্মি গ্রামগঞ্জের কোথাও রাতের বেলা বেরুতো না। স্থানেনীয় জনগণের কারণেই আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা, খাওয়া বা ঘুরে বেড়ানোর কোনো অসুবিধা হয়নি।

প্র: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কি আপনি peoples war বলে মনে করেন ?
উ: অবশ্যই।

প্র: কিভাবে ?
উ: পূর্ব পাকিস্তানের আম-জনতা অনেকদিন যাবতই পাকিস্তান সরকারের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলো। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ থেকে তারা যে অর্থ শোষণ করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাচ্ছিলো সেই সম্পর্কে ক্ষোভ অনেকদিন থেকেই মানুষের মনে দানা বাঁধছিলো। এই ক্ষোভটা রাতারাতি সৃষ্টি হয়নি। এর পিছনে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের যথেষ্ট অবদান ছিলো। আওয়ামী লীগের ৬ দফা, ১১ দফা এগুলো বাংলাদেশের জনগণের প্রাণের দাবি ছিলো এবং শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী যখন হামলা চালালো তখন অন্য কোনো রাস্তা না দেখে তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। কেউ অস্ত্র হাতে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ করেছে আবার কেউ পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছে, সহযোগিতা করেছে, আশ্রয় দিয়েছে। যারা ভারতে গিয়েছিলো তারাও যুদ্ধের অংশীদার। কারণ তারা নিজেদের বাড়িঘর সহায় সম্পদ সব কিছু ছেড়ে বিদেশে রিলিফ ক্যাম্পে ছিলো। এটাও যুদ্ধের একটা অংশ। যারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছিলো, পাকিস্তানি আর্মির অত্যাচার সহ্য করেছিলো এবং তারপরও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলো- এটাও যুদ্ধের একটা অংশ। সর্বোপরি ১৯৭০ সালে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত মুজিবনগর সরকারই এ যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। সুতরাং এই যুদ্ধকে আমি peoples war বলেই মনে করি।

প্র: আমরা লক্ষ্য করেছি যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিবাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক হারেই অত্যাচার করেছে। আপনার এলাকায়ও কি এ রকম ঘটনা ঘটেছে ?
উ: আমার এলাকায় এ রকম তেমন ঘটনা ঘটেনি। এ কথা আমি বলতে পারি এই কারণে যে, আমার এলাকার তিন দিকেই ভারতীয় বর্ডার খুব কাছাকাছি ছিলো। প্রথম অবস্থানেতে যারা ভারতে চলে গিয়েছিলো তাদের বেশির ভাগই ছিলো হিন্দু। ফলে, হিন্দুদেরকে তারা খুব একটা পায়নি। প্রত্যেকটা এলাকা থেকে হিন্দুরা সব চলে গিয়েছিলো। ফলে, পাকিস্তানিরা আলাদা করে হিন্দুদের উপর অত্যাচার করার সুযোগ পায়নি। তবে কোনো কোনো এলাকায় সীমিতসংখ্যক মাইনোরিটি থাকলেও থাকতে পারে। তবে উল্লেখযোগ্য নয়। জাতিভাঙ্গাতে যে হিন্দুদের হত্যা করা হয়েছিলো সেটা পাক আর্মি করেনি। রাজাকার, বিহারী আর আল-বদর-রা এ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলো। ওখানে পাক আর্মির কোনো অংশ গ্রহণ ছিলো না।

প্র: স্বাধীনতার ৩২ বছর পর একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ণ করবেন ?
উ: আমার মনে হয়, পাকিস্তান আমলের মাঝামাঝি সময় থেকে শেষ দিন পর্যন্ত এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের পরেও নেতৃবর্গ এবং আমরা যারা বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলাম, আমরা যে মন-মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ ছিলাম, সেই মন মানসিকতা, চিন্তাধারা এখন এতোটাই নিচে নেমে গেছে যে, আজকে আমার সামনে হতাশা ছাড়া আর কিছু নেই। এমন বাংলাদেশ আমরা চাইনি। হিন্দু সমঙ্রদায়ের একজন সদস্য হিসাবে আমি বিশেষভাবে বলতে চাই যে, পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিলো দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। কায়দে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তখন বলেছিলেন যে,Muslims of India should have a separate state for their own cultural tradition. কিন্তু পাকিস্তান অর্জনের পর সেই কায়দে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বুঝতে পারলেন যে, রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে ধর্মকে প্রাধান্য দিলে সেই রাষ্ট্র চলতে পারে না। এই জন্যই পরবর্তীতে এক কনফারেন্সে তিনি বলেছিলেন, ধর্ম হিসাবে কোনো নাগরিককে বিচার করা হবে না, এ দেশের একজন নাগরিক হিসাবেই বিবেচনা করা হবে। এই ঘটনার ঠিক উল্টোটা ঘটে আমাদের দেশে। দেশটা স্বাধীন হওয়ার আগে চারটি স্বীকৃত রাজনৈতিক দাবি আমাদের ছিলো-১. গণতন্ত্র, ২. জাতীয়তাবাদ, ৩. ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ৪. সমাজতন্ত্র। স্বাধীনতার পর আমরা যারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছিলাম, আমাদের কাছে মূল বিষয়টা ছিলো ধর্মনিরপেক্ষতা। কারণ ধর্মের কারণে পাকিস্তান আমলে আমরা নিজেদেরকে প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে দেখতে পেতাম না। আমাদের অনেক আশা ছিলো যে, পাকিস্তানের হাত থেকে যদি দেশটা স্বাধীন হয় তাহলে সেই দেশটা হবে প্রকৃতপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ এবং আমি সংখ্যালঘু বলে আমাকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে ভাবতে হবে না। আর এ কারণেই আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। কিন্তুদেশটা স্বাধীন হওয়ার কিছু দিন পরই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও রাষ্ট্রীয় মূল চার নীতি বিসর্জন দেয়া হলো। পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে আমূল পরিবর্তন আনা হলো, ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দেয়া হলো। আমরা ধীরে ধীরে সেই পাকিস্তানি আমলের যে রাজনীতি, যে রাষ্ট্র ব্যবস্থানে ছিলো, সেই দিকেই ফিরে যাচ্ছি। অর্থাৎ ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসাবে পাকিস্তানি আমলে আমরা যে অবস্থানেয় ছিলাম এখন আবার সেই অবস্থানেয় ফিরে যাচ্ছি। পাকিস্তানি আমলে ফিরে যাচ্ছি বললে সত্যের অপলাপ করা হবে বরং ফিরে গেছি বলাই সঙ্গত।

প্র: যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলো- রাজাকার, আল-বদর যারা ছিলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এদের কি গ্রেফতার করা হয়েছিলো ? এ সম্পর্কে আপনি কি জানেন ?
উ: ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে ১৪৩ জনের একটা লিস্ট তৈরি করা হয়েছিলো। যাদেরকে আমরা বাংলাদেশ বিরোধী কার্যকলাপের সাথে জড়িত থাকার সন্দেহ করতাম- তাদের নাম এই তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরা হয়। তালিকায় শান্তি কমিটির লোকজনেরও নাম ছিলো। এদের মধ্যে অল্প কিছুসংখ্যক লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। পরবর্তীকালে এম. পি. এ. ফজলুল করিম সাহেবের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, এই লোকগুলোকে গ্রেফতার করা ঠিক হবে না। গ্রেফতার করা হলে দেশে স্বাভাবিক অবস্থানে বা শান্তি ফিরে আসবে না। সে জন্য খুব অল্পসংখ্যক লোককেই সে সময় ধরা হয়েছিলো। পরবর্তীকালে তো বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমাতে তারাও ছাড়া পেয়েছে। কয়েকজনকে মাত্র ধরা হয়েছিলো। যেমন- ওমর আলী, নূরুল হক চৌধুরী-এ রকম ১০/১২ জনকে বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরা হয়েছিলো। পরবর্তীকালে এদেরকেও ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো কোনো মামলা মোকর্দ্দমা ছাড়াই।

আসলে সে সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা ছিলেন তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে খুব একটা তৎপরতা আমি লক্ষ্য করিনি। ’৭১-এ যে হত্যাযজ্ঞ চলেছিলো, যে অত্যাচার চলেছিলো, সে ব্যাপারে মোর্কদ্দমা হয়েছিলো বটে, কিন্তু সাক্ষি পাওয়া যায়নি। ধীরে ধীরে লোকজনও কেমন যেন নির্লিপ্ত হয়ে পড়লো এবং আমরাও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লাম। অপরাধীরা এমনিভাবেই ছাড়া পেয়েছে। কারোরই জেল হয়নি। কিছুদিন আটক ছিলো মাত্র। কিন্তুবিচার করে শাস্তি দেয়া এ রকম কারো ক্ষেত্রেই ঘটেনি । আমি তো একজন আইনজীবী আমি জানি।

প্র: আপনি কি আমাদের আর কিছু বলবেন ?
উ: বাংলাদেশের মধ্যে আমার ধারণায় সবচেয়ে গরীব এলাকা হচ্ছে পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও। গ্রামে গেলে আপনি এমন একটা এলাকা পাবেন না যারা দু’বেলা পেট ভরে ভাত খায়। এক বেলা ভাত খায় আর আরেক বেলা অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে থাকে। এদের চাইতেও যারা নিচু বা গরীব যাদের সংখ্যা সবচাইতে বেশি তারা একবেলাও ভাত পায় না অনেক দিন। তারা কচু ঘেচু সেদ্ধ করে খায়। আমি প্রতি শুক্রবার গ্রামে যাই তাদের অবস্থানে দেখতে। চোখে না দেখলে আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না তাদের অবস্থানে। আবার যখন ঢাকায় আসি তখন আমার মনে হয় না এটা বাংলাদেশ। মনে হয়, আমেরিকার কোনো অঙ্গরাজ্য বুঝি ! যে দেশের লোক একবেলা পেট ভরে ভাত খেতে পায় না, সে দেশের এতো প্রাচুর্য ! গুটিকয়েক লোকের কাছে এতো অর্থ যে, তারা নিজেরাও জানে না তাদের টাকার পরিমাণ কত। আমাদের এলাকায় এখনো বহু লোক ৫০০ বা ১০০০ টাকা এক সাথে কোনোদিন দেখেনি। পাকিস্তান আমলে গুটিকয়েক কোটিপতি ছিলো। আর এখন বাংলাদেশে কয়েক’শ কোটিপতি। এটাই কি স্বাধীনতার মূল্যবোধ ? এর জন্যই কি দেশ স্বাধীন হয়েছিলো ? এটাই কি আমরা চেয়েছিলাম ?

শেষ

কোন মন্তব্য নেই :

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মন্তব্য পেলে খুশি হবো, সে যত তিক্তই হোক না কেনো।
পোস্টে মন্তব্যের দায়-দায়িত্ব একান্তই মন্তব্যকারীর। মন্তব্য মডারেশন আমি করি না, তবে অগ্রহনযোগ্য ( আমার বিবেচনায় ) কোনো মন্তব্য আসলে তা মুছে দেয়া হবে সহাস্য চিত্তে।