বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০০৮

মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও, পর্ব ১.৬ ( একটি কথ্য ইতিহাস-বলরাম গুহঠাকুরতা)

প্র: আজকাল অনেকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতীয়দের ষড়যন্ত্র বলে মত প্রকাশ করছেন। এ বিষয়টাকে আপনি কিভাবে দেখেন ?
উ: ভারত তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য আমাদের দেশ স্বাধীন করার ষড়যন্ত্র করেছে- এটা যারা প্রচার করছেন তারা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থেই সেটা প্রচার করছেন। এ প্রশ্নে আমার যে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কেবল সেই অভিজ্ঞতারই পুনরুল্লেখ করবো। আমি বলেছি, এপ্রিল মাসের গোড়াতেই ভারতে গিয়েছিলাম এবং সে সময় বেশকিছু নেতৃস্থানেনীয় ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছিলাম। আমি কথা বলার আগ পর্যন্ত তারা আমাদের সম্পর্কে কিছুই জানতো না। আমি কথা বলেছিলাম ডি. এন. ঘোষ, শেরিফ অফ কলকাতার সঙ্গে। তিনি আমাদের প্রথমেই বললেন, আপনারা যে আমাদের কাছে আসলেন, Have you heard of any revolution that without making cell in the neighbouring country? Any revolution could be possible ? অর্থাৎ তিনি বলতে চাইলেন, আপনারা তো এই ঘটনার আগে আমাদের সাথে কোনো রকম যোগাযোগ করেননি। যেহেতু আপনারা যোগাযোগ করেননি সেহেতু প্রথমেই কিভাবে আপনারা আশা করেন যে, আমরা আপনাদের অস্ত্র দেবো ? তিনি শুধু কলকাতার শেরিফই নন, তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো ভারতের তখনকার রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরি এবং পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় রাজনীতিক প্রফুল্ল সেনের মতো লোকের সঙ্গে। কাজেই ভারতের সাথে কোনো রকম যোগাযোগ আমাদের ছিলো- এমন কথা বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিলো। যদি মূল্যায়ন করতে বলেন যে, দেশটা কিভাবে স্বাধীন হলো, তাহলে আমাকে একটা ছোট্ট গল্প বলতে হবে। গল্পটা হচ্ছে এ রকম :

লন্ডন থেকে একটা জাহাজ অনেক যাত্রী নিয়ে আমেরিকা যাচ্ছিলো। সেই জাহাজের তিন তলার এক মহিলা ডেকের রেলিং ঘেষে তার ছোট্ট এক শিশুকে বলছিলো, এই যে তুমি বিশাল জলরাশি দেখছো, এই জলরাশিই পৃথিবীর তিন চতুর্থাংশ জুড়ে রয়েছে। এই কথা বলার সময়ই শিশুটি হঠাৎ করে সমুদ্রে পড়ে যায়। শিশুটি সমুদ্রে পড়ে যাবার পর সবাই চারদিক থেকে চিৎকার করছে,help, help বলে। কিন্তু কেউই সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করবার চেষ্টা করছে না। তখন এক সরদারজী সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে বাচ্চাটাকে উদ্ধার করে আনলো। আমেরিকায় যখন জাহাজটা পৌঁছুলো তখন বহু সাংবাদিক, ফটো সাংবাদিক সরদারজীকে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি নিজের জীবন বিপন্ন করে যে পরের উপকার করলেন- কেন করলেন ? সরদারজী এ সব কথার উত্তর না দিয়ে বলেছিলো, বন্ধ করো সব বাজে কথা। আগে দেখ কে সে, যে আমাকে ধাক্কা দিয়েছিলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামটাও ছিলো কিছুটা সে রকম। আমার দৃষ্টিতে পাকিস্তানসরকার আমাদের ধাক্কা দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে ঠেলে দিয়েছিলো। আওয়ামী লীগ বা কোনো রাজনৈতিক দলের পৃথক কোনো দেশ গঠনের মনোভাব বা চিন্তাধারা ছিলো বলে জানি না। যদিও ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মাঠ পর্যায়ের কিছু নেতা সেটাকে স্বাধিকারের সংগ্রাম বলে চালিয়েছেন। কিন্তুতিনি প্রকৃত স্বাধীনতার সংগ্রাম বলেননি। আমি মনে করি, ২৫ মার্চ পাকিস্তানি আর্মি যদি জনগণের উপর এভাবে ঝাঁপিয়ে না পড়তো এবং নির্বাচনে জয়ী দলকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতো- তাহলে দেশটা স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে এগিয়ে যেতো না। আমি দৃঢ়তার সাথেই বলছি, কোনো রাজনৈতিক দলেরই ভারত সরকারের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ ছিলো না কিংবা ভারত সরকারও এদের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করেনি। এটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটেছে। সাধারণ মানুষ নিজেদের জীবন বাঁচাবার জন্যে, পাকিস্তানি আর্মিদের অত্যাচার, শোষণ, অবিচার থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য তখন স্বাধীনতা সংগ্রামে যেতে বাধ্য হয়েছে। এ যুদ্ধ কোনো বহির্শত্রু বা বাইরের কোনো সরকারের ইঙ্গিতে হয় নাই, দেশের জনগণই এটা করেছে। তবে ক্ষেত্রটা আওয়ামী লীগ দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তৈরি করেছিলো, মানুষকে তারা ঐ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলো- এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। সঙ্গে অন্য দলের ভূমিকাকেও খাটো করে দেখা ঠিক হবে না।

প্র: ইদানিংকালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কতিপয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার বলার চেষ্টা করছেন যে, তাদের নেতৃত্বেই যুদ্ধটা হয়েছে- এ সম্পর্কে আপনি কি বলেন ?
উ: কোনো সামরিক অফিসার বা ব্যক্তিত্ব কোনোভাবেই স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার দাবি করতে পারেন না। সেটা সঠিকও নয়। আমি মনে করি,তারা যদি তাদের নিজের জীবন বিপন্ন হতে না দেখতো, তাহলে তারা এই সংগ্রামে আসতো কি না বলা মুস্কিল। এখানে কোনো পলিটিক্যাল মোটিভেশন ছিলো না। তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে-এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা। এ প্রসঙ্গে আমি ঠাকুরগাঁওয়ের কথা বলতে পারি। শেষ দিন পর্যন্ত ইপিআর জোয়ানরা বলে গেলো যে তারা আমাদের সাথে যোগ দেবে। কিন্তুতারা আসেনি, যে কথা আমি পূর্বেই বলেছি। ইপিআর উইং কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ হোসেন যখন প্রত্যেককে আর্মস জমা দিতে বললেন, যখন তিনি সাধারণ জওয়ানদের কাছ থেকে আর্মস জমা নেওয়ার নির্দেশ দিলেন, কেবল তখনই তারা আর্মস নিয়ে বেরিয়ে আসলো এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলো। কিন্তুতার আগ পর্যন্ত তারা এই কাজটা করেনি। অর্থাৎ আমি যেটা বলতে চাই, তাহলো তাদের ব্যক্তিগত জীবন যখন বিপন্ন হতে লাগলো তখনই তারা এসেছে। এর সাথে অন্যান্য বিষয় ছিলো যেমন- তাদের উপর অবিচার করা হয়েছে, বৈষম্য করা হয়েছে; বাঙালি সোলজার হিসাবে তাদের ওপর অন্যায় করা হয়েছে- এগুলো সত্যি। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনেই তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে। এটা army revolution নয়, political revolution । পরবর্তীতে মুজিবনগর সরকারই সব কিছু পরিচালনা করেছে। এই সরকারের নেতৃত্ব ও নির্দেশেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। এখন কতিপয় সেনা অফিসার যদি নেতৃত্বের দাবি করেন তাহলে সেটা হবে অন্যায় দাবি এবং এই দাবি কখনই ইতিহাসের অংশ হতে পারে না।

প্র: বর্তমানে অনেকেই বলছেন যে, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই ভাষণ শুনেই নাকি বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো- এ সম্পর্কে আপনি কি জানেন ?
উ: আমাদের এলাকার খুব কম মানুষই কালুরঘাটের এই রেডিও বার্তা শুনেছে। আমরা যেহেতু পলিটিক্যালি খুব সচেতন ছিলাম এবং আমরা লোকমুখে যখন শুনলাম যে, আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোকজনও যুদ্ধে যোগদান করছে তখন অনেক কষ্টে কালুরঘাটের রেডিও বার্তাটা পরে শুনেছিলাম। কিন্তুআম-জনতা, শতকরা ৯০ ভাগ লোকই এ রকম কোনো কথা শোনেইনি। জনগণের বেশিরভাগ হয়তো দেশ ত্যাগ করতো না, যদি না তাদের জীবনের ভয় থাকতো। যখন পাকিস্তানিআর্মি আক্রমণ শুরু করলো, তখন তারা তাদের নিজেদের জীবন ও মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষার্থে দেশ ত্যাগ করলো। তারা কালুরঘাটের বক্তৃতা বা অন্য কোনো সামরিক কমান্ডারের বক্তৃতা শুনে দেশ ত্যাগ করেছে বা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে- এটা আমি মনে করি না।

আগামী পর্বে এই সাক্ষাতকার পর্ব সমাপ্য

কোন মন্তব্য নেই :

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মন্তব্য পেলে খুশি হবো, সে যত তিক্তই হোক না কেনো।
পোস্টে মন্তব্যের দায়-দায়িত্ব একান্তই মন্তব্যকারীর। মন্তব্য মডারেশন আমি করি না, তবে অগ্রহনযোগ্য ( আমার বিবেচনায় ) কোনো মন্তব্য আসলে তা মুছে দেয়া হবে সহাস্য চিত্তে।