রবিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০০৮

মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও, পর্ব ১.৫ ( একটি কথ্য ইতিহাস-বলরাম গুহঠাকুরতা)

প্র: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তো আপনি অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। এ সময়ের এমন কিছু স্মরণীয় ঘটনার কথা কি বলবেন যা এখনও আপনার মনে স্মৃতি হয়ে আছে ?
উ: সেই স্মৃতি কিছুটা বেদনাদায়ক। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন আমাদের এলাকায় বেশ কিছু অবাঙালি বাঙালিদের হাতে নিহত হয়েছিলো, যেটা আমার কাছে অমানবিক বলে মনে হয়েছে। ছোট ছোট বাচ্চাদের পর্যন্ত যেভাবে মারা হয়েছিলো তা ছিলো বেদনাদায়ক। এমন ঘটনাও দেখা গেছে যে, অবাঙালি ইপিআর অফিসারের বউকে গোল পোস্টের বারে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে সাধারণ মানুষকে দেখাবার জন্যে। এই সমস ঘটনা আমার কাছে পৈশাচিক বলে মনে হয়েছিলো। আমাদের ইপিআর-এর সাথে আনসার ও মুজাহিদরা মিলে এই খুন-খারাবিগুলো করেছিলো বলে জানি। আমি তাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে বাধা দিতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তুতারা বলেছিলো উকিল সাহেব আমাদের রাইফেলটা কিন্তুউল্টো দিকে ঘুরে যেতে পারে। কথা বলবেন না। তখন আমি তাদেরকে আর কিছু বলিনি। কিন্তু মর্মাহত হয়েছিলাম।

প্র: কোন্‌ সময়টাতে এ সব ঘটনা ঘটেছিলো ?
উ: মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের ১২ তারিখের মধ্যে।

প্র: কোন্‌ কোন্‌ এলাকায় এ সব ঘটনা ঘটেছে ?
উ: দিনাজপুর জেলার গোটাটাতেই ঘটেছে। কিন্তু সব ঘটনা আমি নিজের চোখে দেখিনি। ঠাকুরগাঁওয়ের ঘটনা আমি নিজের চোখে দেখেছি।

প্র: ঠাকুরগাঁওয়ের কোন্‌ কোন্‌ এলাকায় দেখেছেন, নির্দিষ্ট করে নামগুলো বলবেন ?
উ: ঠাকুরগাঁও শহরের উত্তর পাশে গার্লস স্কুলের পাশে নদী ছিলো। সেই নদীর পারে নিয়ে গিয়ে তাদের গুলি করে মারা হতো।

প্র: কাদের কাদের মারা হয়েছে ? কোনো নাম কি আপনার মনে পড়ে ?
উ: অনেকের নাম আমার মনে পড়ে। হায়াত আশরাফ ও তার ছেলে। আমাদের বন্ধু আনোয়ার, কমর সেলিম, ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার, সাইফুল্লাহ, কুদ্দুস। এদের কেউ কেউ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলো। বখতিয়ার খাঁ ও তার ছেলে-পেলেরা। তার এক ছেলে অবশ্য বেঁচে আছে।
অবাঙালিদের হত্যার ব্যাপারে ন্যাপ, আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি বা আর যারা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন- তাদের কোনো হাত ছিলো না। প্রকৃতপক্ষে সেই সময় ইপিআর ক্যাম্প থেকে যারা অস্ত্র সহ বেরিয়ে আসলো এবং আনসার ও মুজাহিদ- যাদের কাছে রাইফেল ছিলো, গুলি ছিলো- তারাই এ সব কাজ করেছে। তাদের সঙ্গে অবশ্য কিছু দুষ্কৃতিকারীও ছিলো। তাদের উপর প্রকৃতপক্ষে কারোরই কোনো নিয়ন্ত্রন ছিলো না। কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রনই ছিলো না। যারা অবাঙালি নিধন করেছিলো- তাদের কয়েকজনের সঙ্গে আমি তখন বা পরে কথা বলেছি। তাদের ভীতিটা ছিলো এই রকম--পরবর্তীকালে দেশে যদি শান্তি ফিরে আসে এবং সরকার কাজ করে তখন এই অবাঙালিরাই সরকারের কাছে তাদের চিনিয়ে দেবে। এই ভয়টা সাংঘাতিকভাবে ওদের ওপর ভর করেছিলো। দেশটা যে এ ভাবে স্বাধীন হবে তারা সেটা ভাবতেই পারেনি। আমি যখন ব্যক্তিগতভাবে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম, মানুষকে যে এ ভাবে তোমরা হত্যা করলে সেটা কি ভালো ? তখন ওরা বললো, উকিল সাহেব আপনি জানেন না, পরবর্তীকালে আমাদেরকে কে চেনাবে ? বাঙালিরা আমাদের চেনাবে না। এই অবাঙালিরাই আমাদের চিনিয়ে দেবে যে এরা ইপিআর ছিলো। এরা এই কাজ করেছে। তখন আমাদের কোর্ট মার্শাল হবে। আমরা মারা যাবো।

কমর সেলিমের বাড়িতে বহু অবাঙালি আশ্রয় নিয়েছিলো, সেখানে গিয়ে গুলি করে করে হত্যা করা হয় তাদেরকে। পাশবিক অত্যাচার করে গুলি করা হয়েছে-এমন ঘটনা আমাদের এলাকায় কম। জেলখানায় কিছু লোক রাখা হয়েছিলো। জেলখানা থেকে বের করে তাদের গুলি করে মারা হয়েছিলো। আমি এবং কমিউনিস্ট পার্টির কামরুল হোসেন আমরা দু’জনেই চেষ্টা করেছিলাম খুন খারাবিটা বন্ধ করতে। কিন্তুতারা বন্ধ তো করেইনি, উল্টো আমাদের ভীতি প্রদর্শন করলো যে, তাদের রাইফেলের নল আমাদের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে। বস্তুত: সে সময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব কার্যকর ছিলো না, ছিলো রাইফেলধারীদের নেতৃত্ব। আজ আমার নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয়। এই সমস্ত লোককে আমরা আশ্বাস দিয়েছিলাম যে, চিন্তা করো না, কোনো অসুবিধা হবে না। আসলে আমাদেরও ধারণা ছিলো না যে, তাদেরকে এভাবে গুলি করে মারা হবে। আমরা যদি তাদেরকে বলতাম যে, রাতের অন্ধকারে যে যেদিকে পারো পালিয়ে যাও, তাহলেও হয়তো অনেক জীবন রক্ষা পেতো। কিন্তু আমরা তাদের বলেছি চিন্তা করবেন না, আমরা তো আছি। কিন্তু প্রয়োজনের সময় আমরা তাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি।

প্র: ঠাকুরগাঁওয়ে প্রকৃত অর্থে অস্ত্রের লড়াই যখন শুরু হলো- তখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা নিয়ন্ত্রন কাদের হাতে ছিলো ?
উ: নিয়ন্ত্রন রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে ছিলো না। যার হাতে অস্ত্র তার হাতেই ক্ষমতা। আমি বাধা দিতে গিয়ে বিপদগ্রস্ত হয়েছিলাম। আমরা পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা।

প্র: হত্যার সঙ্গে কি সম্পদ লুণ্ঠনের কোনো ব্যাপার ছিলো ?
উ: হ্যাঁ।

প্র: এর পিছনে কি কোনো বিশেষ কারণ কাজ করেছে ?
উ: লুন্ঠনটা কোনো বিশেষ অর্থে কাজ করেছে বলে মনে হয় না। লুণ্ঠনটা যে কেবল গুটিকয়েক অস্ত্র ধারীরাই করেছে তা নয়, বরং আমার জানা মতে, লুণ্ঠনটা করেছে সাধারণ মানুষ। গ্রাম-গঞ্জ থেকে লুণ্ঠনকারীরা এসে বিভিন্ন জায়গায় তারা লুট করেছে। এ সব আমরা নিজ চোখেই দেখেছি। এরা পলিটিক্যালি মটিভেটেড নয়। তারা কোনো রাজনৈতিক দল বা সেই দলের কোনো অঙ্গ-সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলো না। তাদের মূল কাজটাই ছিলো লুট করা। গ্রাম থেকে লোকজন এসে পাগলের মতো সব লুট করেছে। আর আমরা অসহায়ের মতো তা দেখেছি, কিছুই করতে পারিনি।

প্র: লুট কি কেবল অবাঙালিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘরে হয়েছে ?
উ: অবাঙালিদের তো বটেই। তারপর আমরা যখন চলে গিয়েছি বা যাচ্ছি তখন আমাদেরগুলোও লুট হয়েছে। আমাদের সব জিনিসপত্র নিয়ে গেছে।

প্র: যুদ্ধকালের কোনো ঘটনা কি আপনাকে এখনো পীড়া দেয় ?
উ: আমার যেটা বেশি করে মনে হয় সেটা হলো- অবাঙালিদের কেউ কেউ আমাদের উপর অনেকটাই নির্ভর করেছিলো। তারা ভেবেছিলো, বিপদের সময় আমরা তাদের সাহায্য সহযোগিতা করতে পারবো। কিন্তুআমরা কিছুই করতে পারিনি। এটা আমাকে খুব কষ্ট দেয়। আমরা যখন দেশ ত্যাগ করে আসতে লাগলাম তার আগ পর্যন্ত অবাঙালিদের মারা হয় এবং তাদের সঙ্গে যে গহনা ও টাকা-পয়সা ছিলো সেই সব গহনা ও টাকা পয়সা কন্ট্রোল রুমে জমা হচ্ছিলো এবং সেটার পরিমাণ ছিলো প্রচুর। সোনাদানা, টাকা সব ট্রাঙ্কে রাখা হচ্ছিলো এবং সার্বক্ষণিক সেখানে পাহারাদার ছিলো।

প্র: এটা কিভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছিলো ?
উ: যাদের মারা হচ্ছিলো বিভিন্ন জায়গায় সেখান থেকেই সংগৃহীত অর্থ-সম্পদ কন্ট্রোল রুমে জমা করা হচ্ছিলো। যারা এ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলো তারা কিছু নিয়েছে এ কথা ঠিক। কিন্তু বেশির ভাগই জমা হয়েছিলো কন্ট্রোল রুমে। এক সময় এই জমার পরিমাণটা, সোনা-দানা এবং টাকা পয়সায় বেশ বড় আকার ধারণ করলো। ঠাকুরগাঁওয়ের যখন পতন হতে শুরু করলো তখন কতিপয় নেতা এ সব সমঙদ নিয়ে পালিয়ে গেলো। আমি তাদের নাম বলবো না। আমি নিজ চোখে দেখেছি কারা এ সব নিয়ে গেছে। ঐ সব ব্যক্তিরা কিন্তু ভারতে পালিয়ে গেলেও পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো অবদান রাখেনি। তারা ঐ সব গয়নাগাটি, টাকা পয়সা কিভাবে কোথায় রাখবে- এইসব নিয়েই ব্যস্ত ছিলো।

প্র: এরা কোন্‌ দলের সেটা কি আপনার জানা ?
উ: হ্যাঁ, জানা। কারণ ঠাকুরগাঁও ছোট জায়গা। আমি সবাইকে বিশেষভাবে চিনি। কি ন্তুআমি তাদের নাম বলবো না। কারণ আমার নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে। কোন্‌ ব্যক্তি, কোন্‌ দলের, কারা কারা ব্যাঙ্ক লুট থেকে টাকা নিয়েছে এ সবই আমি জানি। কিন্তু তাদের সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারবো না।

প্র: আপনি বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে অবাঙালিদের উপর অত্যাচার করা হয়েছে। কিন্তুএই অবাঙালিরাই তো পাকিস্তানিদের সঙ্গে থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে এবং বাঙালি নিধন ও নারী ধর্ষণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে- এ সম্পর্কে আপনি কি বলবেন?
উ: আমাদের এলাকার অবাঙালিরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে তখন- যখন পাকিস্তানিরা ঠাকুরগাঁও দখল করলো। তারা এটা করেছে জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য। আমি জানি, ঠাকুরগাঁওয়ে এ সময় রাজনৈতিকভাবে এমন কোনো অবাঙালি নেতৃত্ব ছিলো না যে, তারা রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানের পক্ষে বা আমাদের বিপক্ষে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে পাকিস্তানিআর্মিরা যখন আমাদের এলাকা দখল করে নিলো এবং আমরা আমাদের এলাকা ছেড়ে চলে আসলাম তখন তারা অনেক অন্যায় কাজ করেছে। কেউ অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠনের জন্যে করেছে আবার কেউ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে করেছে এ কথা আমরা বলতে পারি।
চলবে.....

কোন মন্তব্য নেই :

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মন্তব্য পেলে খুশি হবো, সে যত তিক্তই হোক না কেনো।
পোস্টে মন্তব্যের দায়-দায়িত্ব একান্তই মন্তব্যকারীর। মন্তব্য মডারেশন আমি করি না, তবে অগ্রহনযোগ্য ( আমার বিবেচনায় ) কোনো মন্তব্য আসলে তা মুছে দেয়া হবে সহাস্য চিত্তে।