বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০০৮

মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও ১.৪ ( একটি কথ্য ইতিহাস-বলরাম গুহঠাকুরতা)

প্র: মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আপনার এলাকার সীমান্ত বরাবর অনেক শরণার্থী ক্যাম্প গড়ে উঠেছিলো। এ সব ক্যাম্প কোথায় কোথায় গড়ে উঠলো, ক্যাম্পের অবস্থানে কেমন ছিলো। এ ব্যাপারে আপনি কিছু বলবেন কি ?
উ: কালিয়াগঞ্জের তরঙ্গপুর থেকে শুরু করে বিহারের কিষণগঞ্জ এবং সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গের ইসলামপুর এবং সেখান থেকে জলপাইগুড়ি পর্যন্ত অনেকগুলি ক্যাম্প ছিলো। তার মধ্যে দাড়িভিট বলে একটা ক্যাম্প ছিলো অনেক বড়। তরঙ্গপুরের ক্যাম্প ও অনেক বড় ছিলো। কিষণগঞ্জের ক্যাম্প ও বেশ বড় ছিলো এবং ইসলামপুরের মরাগতির ক্যাম্প ও অনেক বড় ছিলো। ক্যাম্প গুলোতে বাংলাদেশ থেকে আসা লোকজন আশ্রয় নিয়েছিলো। ভারত সরকার চাল, ডাল, তেল, নুন সব দিতো। আশ্রয় নেয়া মানুষ কেবল রান্না করে খেতো। খড়ের একেকটা ঘরে ৪/৫ জন করে শরণার্থী থাকতো। প্রতিটি ক্যাম্পে আমি, এম. পি. এ. ফজলুল করিম সাহেব, নূরুল হক সাহেব, কামরুল হোসেন সাহেব, রশীদ করিম সাহেব সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন সময় গেছি। রশীদ করিম সাহেব প্রথমে তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলেন। পরে কিষণগঞ্জের একটা ক্যাম্পে ছিলেন বলে আমি জানি।

প্র: ক্যাম্প গুলোর অবস্থানে কেমন ছিলো ?
উ: ক্যাম্প গুলো ভারত সরকার চালাতো। ইসলামপুরের তখনকার যে এ.ডি.সি. ছিলেন, তার নামটা এখন ভুলে গেছি। এরা ক্যাম্পের জন্য প্রচুর কাজ করেছেন। তবে এটা ঠিক, প্রয়োজনের তুলনায় ভারত যেটা দিয়েছিলো সেটা খুব বেশি ছিলো না। ইসলামপুরের যে এ.ডি.সি. রিলিফের চার্জে ছিলেন তাকে আমি একদিন বললাম, আপনারা যে সব কম্বল বরাদ্দ করেছেন তা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত। আমি এই কথা বলাতে এডিসি-র সাঙ্গপাঙ্গ যারা ছিলো তারা আমার উপর খুবই অসন্তুষ্ট হলো। আমরা তো শরণার্থী। আমাদের মান অপমান বলে তখন কিছু নেই। ওরা আমার ওপর একটু উম্মা প্রকাশ করলেন এই কারণে যে, এতো দেয়া হচ্ছে তারপরও আমরা সমালোচনা করছি। কিন্তুযতোই দেয়া হোক, লোক তো আমাদের অনেক। যেখানে লক্ষ লক্ষ লোক সেখানে এক হাজার বা দুই হাজার কম্বলে কি হয় ? খুব কষ্ট করেই আমরা ছিলাম।

প্র: স্বাস্থ্য সেবা সেখানে কেমন ছিলো ?
উ: স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থানে আমাদের এলাকার ক্যাম্প গুলোতে খুব একটা খারাপ ছিলো না। খারাপ থাকলে তো মহামারী জাতীয় কিছু হতে পারতো। কিন্তু এ সব ক্যাম্প গুলোতে তেমন কিছু হয়নি। ছোট-খাটো অসুখ বিসুখ ছাড়া তেমন কিছু হয়নি। ডাক্তার, ওষুধ তারা রেখেছিলেন। প্রতিটি ক্যাম্পের সাথে একটা অস্থায়ী হস্‌পিটাল ছিলো। তারা পর্যাপ্ত ওষুধ-পত্র দিয়েছিলো। প্রয়োজনের তুলনায় কম হলেও একেবারে কম নয়।

প্র: বিভিন্ন সময় ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ করতে হয়েছে, কাজও করতে হয়েছে। এ সব ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক কেমন ছিলো ?
উ: প্রথম দিকে আমাদের সঙ্গে ভারতের স্থানীয় জনগণ ও নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সম্পর্ক এতই মধুর ছিলো যে, আমরা বাংলাদেশ থেকে যে সমস্যা লোক সেখানে গিয়েছিলাম- তাদেরকে ট্রেনে, বাসে কোনো টিকিট কাটতে হতো না। ‘জয় বাংলা’ থেকে এসেছি বললেই ছেড়ে দিতো। যেখানেই আমরা গেছি,বিশেষ করে ব্যক্তিগতভাবে আমি, ফজলুল করিম সাহেব এবং আমাদের সাথে অন্য যারা ছিলেন তারা ভারতীয়দের কাছ থেকে যে আতিথেয়তা, ভালোবাসা, সম্মান পেয়েছেন তা তুলনাহীন। কিন্তু শেষের দিকে লক্ষ্য করলাম এই সম্পর্কটা যেন কমে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের মনের মধ্যে হয়তো একটা ধারণা সৃষ্টি হতে লাগলো যে, আমরা এতোগুলো লোক হয়তো আর দেশে ফিরে যেতে পারবো না। আমরা তাদের উপর বোঝা হয়ে থাকবো। এ রকম একটা ভাব পরবর্তীকালে আমি তাদের অনেকের কাছে থেকেই শুনেছি। কিন্তু ইতোমধ্যেই তো দেশ স্বাধীন হয়ে গেলো। যুদ্ধটা ঠিক সময় মতো শেষ হওয়ায় আমাদের খুব একটা অসুবিধা হয়নি।

প্র: ভারত সরকার বিশেষত: ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে আপনাদের সম্পর্ক কেমন ছিলো ?
উ: সত্যি কথা বলতে কি আমরা কিছু আর্মি অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলাম কিংবা তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলো মূলত: আমাদের দেশের রাস্তাঘাট সম্পর্কে জানার জন্যে। আমাকে এবং ফজলুল করিম সাহেবকে অনেক আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো বাংলাদেশের রাস্তাঘাট সম্বন্ধে জানার জন্য। তারা আমাদের পরামর্শ নিয়েছেন বা রাস্তা ঘাটের, এলাকার ম্যাপ করিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া এ.ডি.সি. একজন চার্জে ছিলেন। তাঁর সাথে জিনিসপত্র লেন-দেন ছাড়া প্রশাসনিক অন্য কোনো কর্মকর্তা বা লোকজনের সাথে আমাদের তেমন যোগাযোগ ছিলো না। এ সময় আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক খুবই ভালো ছিলো। আমাদের ২/১ জন ভুল করে গ্রেফতার হয়েছিলো। আমরা তাদের জামিনের জন্য যখন কোর্ট কাচারিতে দৌঁড় ঝাপ করেছি। তখনও সবার কাছ থেকেই সহযোগিতা পেয়েছি।

প্র: তারা গ্রেফতার হয়েছিলো কেন ?
উ: আমাদের এলাকার ভাসানী ন্যাপের জিয়াউল হক নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। তিনি অনেকদিন ভারতের জেলখানায় ছিলেন। তাঁকে আমরা অনেক কষ্টে পরবর্তীকালে রিলিজ করেছিলাম। এই রিলিজের ব্যাপারে আমি, ফজলুল করিম সাহেবসহ আরো অনেকেই মুজিব নগরে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তাকে রিলিজ করা হয় শেষপর্যন্ত সবার সহযোগিতায়। সিরাজুল ইসলাম নামে আর একজন সাউথ ইন্ডিয়াতে ধরা পড়লো। তাকে সেখান থেকে রিলিজ করা হলো। এ সব ব্যাপারে একটু যোগাযোগ হয়েছিলো সরকারি লোকজনের সঙ্গে। তাদের কেন গ্রেফতার হয়েছিলো-তা বলা মুস্কিল।

প্র: ভারতে যাওয়ার পর আপনার মূল কাজটা কি ছিলো ?
উ: আমার মূল কাজটা ছিলো সমন্বয় সাধন করা, মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করা, রিলিফ ক্যাম্প গুলোতে নিয়মিত যাওয়া এবং সেখানে কার কি অসুবিধা হচ্ছে, কার কি নেই- এ সব খোঁজ খবর নেয়া। কালিয়াগঞ্জের কাছে তরঙ্গপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক ট্রেনিং দেয়া হতো। সেখানে আমাকে ফজলুল করিম সাহেব মাঝে মধ্যেই পাঠাতেন খবর নেয়ার জন্যে। মনে হয় আমি তখন ইয়াং ছিলাম বলে সমন্বয় সাধনের কাজটি আমাকে দেয়া হয়। নয় মাস আমি আমার পরিবারের সঙ্গে কোনো দিনই থাকতে পারিনি। স্বত:স্ফূর্তভাবে সার্বক্ষণিক কাজই করেছি। আমি এই নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের কাজের সঙ্গে বিশেষত: মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহের কাজে, রিলিফ ক্যাম্পে জনগণের দুঃখ দুর্দশা লাঘবে সার্বক্ষণিক কাজ করেছি। ভারত- বাংলাদেশ সরকারের কোনো কোনো কাজের ক্ষেত্রেও সমন্বয় সাধন করেছি। আর আমি থাকতাম ইসলামপুর বেইস করে, এদিকে জলপাইগুড়ি আর ওদিকে তরঙ্গপুর।
চলবে...

কোন মন্তব্য নেই :

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মন্তব্য পেলে খুশি হবো, সে যত তিক্তই হোক না কেনো।
পোস্টে মন্তব্যের দায়-দায়িত্ব একান্তই মন্তব্যকারীর। মন্তব্য মডারেশন আমি করি না, তবে অগ্রহনযোগ্য ( আমার বিবেচনায় ) কোনো মন্তব্য আসলে তা মুছে দেয়া হবে সহাস্য চিত্তে।