সোমবার, ১ ডিসেম্বর, ২০০৮

মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও ১.৩ ( একটি কথ্য ইতিহাস- বলরাম গুহঠাকুরতা)

প্র: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানিরা গোটা দেশেই নির্যাতন ক্যাম্প করেছিলো। আপনাদের ঠাকুরগাঁওয়ের কোথায় কোথায় এ জাতীয় নির্যাতন ক্যাম্প ছিলো ?
উ: তাদের মূল নির্যাতন ক্যাম্প ছিলো ঠাকুরগাঁও ওয়াপদা রেস্ট হাউসে। সেখানে তারা বাঘের খাঁচা করেছিলো। সেই বাঘের খাঁচায় জীবিত মানুষকে ঢুকিয়ে দেয়া হতো। এই বাঘের খাঁচা সম্পর্কে একটা ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে। পাক বাহিনী সালাহউদ্দীন নামে এক মুক্তিযোদ্ধাকে সেই বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলো। এই ঘটনাটা আমি লোকমুখে শুনেছি। সালাহউদ্দীন ১৯৭১ সালে দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর ছাত্র ছিলো। পাক সেনারা ১৩ এপ্রিল দিনাজপুর এবং ১৪/১৫ এপ্রিল ঠাকুরগাঁও দখল করে ১৮ এপ্রিল বীরগঞ্জে মর্মান্তিক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এই ঘটনা সালাহউদ্দীনের জীবন বদলে দেয়। এই ঘটনার পর এক রাতে সে ভারত চলে যায় এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে হয়ে ওঠে লড়াকু মুক্তিসেনা।
ঠোকরাবাড়ি, বালিয়াডাঙ্গা, ঠগবস্তি, বীরগঞ্জ, মেহেরপুর রণাঙ্গনে সে ছিলো অকুতোভয় এক যোদ্ধা। নভেম্বর মাসে সালাহউদ্দীন অবস্থান করছিলো জাবরহাট ক্যাম্পে। এখানে থাকার সময় সে সংবাদ পেলো যে, পাক সেনারা তার বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে। এই খবর জেনে সহযোদ্ধারা তাকে সমবেদনা জানায়। কিন্তু বাবার সংবাদ জেনে সে একটু বিচলিত হয়ে পড়ে। সালাহউদ্দীন ঐ দিনই গভীর রাতে একজন সহযোদ্ধাকে জানিয়ে রওনা দেয় বাড়ির উদ্দেশে। কথা ছিলো পরদিনই সে আবার ফিরে আসবে। পায়ে হেঁটে ভোর নাগাদ সে পৌঁছে যায় বাড়িতে। কয়েক ডাকেই দরজা খুলে দিলো তার মা। ঘরে ঢুকে দেখে বাবা দিব্যি রয়েছে। বাড়ি ফিরে জানতে পারে ঐ খবরটা সঠিক ছিলো না। সম্ভবতঃ পাকিস্তানিদের সহযোগী কেউ কারো মাধ্যমে তাকে এই খবর দিয়ে তার জন্য ফাঁদ তৈরি করেছিলো। এদিকে দ্রুত সালাহউদ্দীনের ঘরে ফেরার খবর চলে যায় ঠাকুরগাঁওয়ের পাক সেনাদের দপ্তরে। সম্ভবতঃ ১১ নভেম্বর সকাল ১০টার দিকে পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দীনদের বাড়িটা ঘিরে ফেললো। তারা সালাহউদ্দীনকে বন্দি করে নিয়ে গেলো তাদের ঠাকুরগাঁওয়ের সদর দপ্তরে। সেখানে প্রচন্ড নির্যাতন চলে তার ওপর। মুক্তিবাহিনী এবং তাদের আশ্রয়দাতাদের বিষয়ে সালাহউদ্দীনের কাছে তথ্য চায় পাক সেনারা। বুটের লাথি, চাবুকের চাবকানি, কোনোকিছুতেই নতি স্বীকার করেনি সে। মৃত্যুর ভয় দেখালে সালাহউদ্দীন দৃঢ়ভাবে নাকি জানিয়ে দিয়েছিলো আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। তার হাতের আঙুলগুলো পাক সেনারা জাতি (টিন কাটার বড় লোহার কাঁচি) দিয়ে কেটে ফেলে, হাতেপায়ে গজাল পেরেক ঠুকে দেয়। চোখের মণিতে বড়শি আটকিয়ে সুতো বেঁধে টানাটানি করে নিষ্ঠুরভাবে। তারপরও সালাহউদ্দীন ছিলো অবিচল, পাকিস্তানিদের কাছে কিছুই স্বীকার করেনি সে। পাকিস্তানিমেজর মাহমুদ হাসান বেগ নাকি মুক্তিযোদ্ধা সালাউদ্দীনের দৃঢ়তায় বিস্মিত এবং স্তম্ভিত হয়েছিলো ! সালাহউদ্দীনের মতো এতো দৃঢ়তা, এতো দেশপ্রেম এর আগে আর কারো মধ্যে সে কখনও দেখেনি। কোনো অবস্থানেতেই কোনো তথ্য না দেওয়ায় পরদিন ১২ নভেম্বর সকালে পাকিস্তানি মেজর জামানের নেতৃত্বে কয়েকজন পাক সেনা বের করে নিয়ে আসে ক্ষতবিক্ষত সালাহউদ্দীনকে। তার দুই হাত পিঠমোড়া করে বাঁধা। জিহ্বাতেও চালানো হয়েছে চাকু। ঐ অবস্থানেয় তাকে ঐ বাঘের খাঁচার সামনে আনা হয়। সেখানে তাকে আবার নাকি বলা হলো, হয় তথ্য দাও, নইলে বাঘের খাঁচায় মৃত্যু। তারপরও সে বাঘের খাঁচাকেই কবুল করে নিয়েছে। তার পরের দৃশ্যের কোনো বর্ণনা হয় না।
পিঠমোড়া করে হাত বাঁধা অবস্থানেয় সালাহউদ্দীনকে ফেলে দেয়া হয় বাঘের খাঁচায়। বীর মুক্তিযোদ্ধা তাকিয়ে ছিলো বাঘের দিকে। চারিদিকের রুদ্ধশ্বাস নিস্তব্ধতাকে ভেঙে বাঘ দু’টো ঝাঁপিয়ে পড়ে সালাহউদ্দীনের ওপর। নির্ভিক মুক্তিযোদ্ধার ক্ষীণ চিৎকারে প্রকৃতি কেঁপে উঠলেও পাকিস্তানিসেনা এবং তাদের দোসরা এটা দেখে উল্লসিত হয়েছিলো। এক সময় সব শেষ হয়ে গেলো। পাক বাহিনী যে কতটা নিষ্ঠুর ছিলো তা এই একটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায়।
তারপর ইপিআর ক্যাম্পেও তাদের একটা নির্যাতন সেল ছিলো। এ ছাড়া গ্রামে-গঞ্জে যেখানে যেখানে তারা বাংকার বা ঘাঁটি করতো- সেখানেই মানুষের ওপর বিশেষ করে মেয়েদের ওপর তারা নির্যাতন চালাতো। রাতে তারা কোথাও থাকতো না। সন্ধ্যার মধ্যে সব চলে এসে বাংকারে থাকতো এবং মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করতো। আমরা বহু বাংকার দেখেছি যেখানে মেয়েদের শাড়ি, চুড়ি, ব্লাউজ ছিলো অসংখ্য। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। আটোয়ারিতে এক পাগলীর সাথে আমাদের দেখা হয়েছিলো। পাকিস্তানিদের বার বার নির্যাতনের ফলে এক পর্যায়ে সে পাগল হয়ে যায়। স্বাধীনতার পরও সে বেঁচে ছিলো এবং বলতো, ‘আমাকে তোরা ব্যবহার করবি নি ? খাবার দিবি নি’ ? সে ছিলো অর্ধ উলঙ্গ অবস্থানেয়। মাঝে মাঝেই সে আমাদের কাছে আসতো এবং পাকিস্তানিদের খোঁজ করতো। পাগলী বলতো, আমাকে খাবারও দেবে আবার আমার সঙ্গে খারাপ কাজও করবে।
প্র: মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য ছিলো কি ? এ সম্পর্কে আপনি কি জানেন ?
উ: আমি জানি, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কোনো ছেলেকে ভর্তির ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেছিলো। এ জন্য পাল্টা একটা ইয়ুথ ক্যাম্প গঠিত হয়েছিলো। ক্যাম্পটা পরিচালনা করতেন মোজাফফর আহমদ এবং কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃবৃন্দ। ক্যাম্প টা ছিলো গঙ্গারামপুরে। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যান্য দলের ছেলেদের এখানে রিক্রুট করা হতো। এরপর তাদেরকে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হতো। ভারত সরকারের সাথে বাম নেতারা যোগাযোগ করেই আলাদাভাবে ক্যাম্প তৈরি করেছিলো। এ সব ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে গেছে এবং যুদ্ধ করেছে।
প্র: ১৯৭১ সালে ঠাকুরগাঁও-য়ে রাজাকার বাহিনীর ভূমিকা কি ছিলো ?
উ: এ সময় পাকিস্তানি আর্মি রাজাকার হিসাবে অনেককে রিক্রুট করেছিলো। আমাদের এলাকাতেও করেছিলো। আমি এই মুহূর্তে তাদের নাম বলতে পারবো না। তবে তাদের অনেকেই জামাতে ইসলাম এবং মুসলিম লীগের সমর্থক বা কর্মী ছিলো। এ ছাড়াও অনেককে তারা রিক্রুট করেছিলো। আমি তাদেরকে চিনি, কিন্তুএই মুহূর্তে তাদেরও নাম বলবো না। তারা মূলত: লুণ্ঠন, মেয়েদের উপর অত্যাচার এবং পাকিস্তানি আর্মিদের সহযোগী হিসাবে তাদের বিভিন্ন ধরনের রসদ যোগান দিতো।
প্র: ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিসেনা কর্তৃপক্ষ শান্তি কমিটি গঠন করেছিলো। ঠাকুরগাঁও এলাকায় এ সব কমিটিতে কারা ছিলো এবং তাদের ভূমিকা কি ছিলো ?
উ: সে সময় ঠাকুরগাঁও পঞ্চগড়সহ পুরো এলাকায় মহকুমা, থানা এবং ইউনিয়নভিত্তিক শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন মূলত: মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলাম দলীয় সদস্যরা। তাদের নাম আমি জানি। তাদের কেউ কেউ মারা গেছেন, কেউ কেউ বেঁচে আছেন। ওনাদের নাম এখন আমি বলতে চাচ্ছি না।
প্র: স্বাধীনতার পর নিজ এলাকায় ফিরে এসে আপনি এলাকার অবস্থানে কেমন দেখলেন ?
উ: ৪ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও মুক্ত হয় এবং তারপরই আমরা চলে আসি। আমরা যা দেখেছি তাকে সম্পর্ন একটা ধ্বংসস্তুপ বলা যেতে পারে। আমাদের এলাকায় পাকা বাড়ি তো খুব বেশি ছিলো না। ঘরের চাল পর্যন্ত তারা খুলে নিয়ে গিয়েছিলো। পাকা বাড়ি থেকে আসবাবপত্র, দরজা-জানালা সবকিছু তারা খুলে নিয়ে গিয়েছিলো। কারো কিছু ছিলো না। গরু, ছাগল, ভেড়া সবই তারা লুট করে নিয়ে গিয়েছিলো। আমাদের বাড়ির আসবাবপত্র বলতে কিছুই ছিলো না। দেশ স্বাধীনের পর লুট করা অনেক মালামাল আমরা পাকিস্তানি সহযোগীদের বাড়ি থেকে বা বিভিন্ন পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করেছিলাম। উদ্ধার করা মালামাল ঠাকুরগাঁও বি. ডি. হলে রাখা হয়েছিলো। যারা তাদের জিনিসপত্র সনাক্ত করতে পেরেছিলো তারা তাদের জিনিষপত্র নিয়ে গিয়েছিলো। বাকিগুলো আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গ কাকে কি দিয়েছেন আমরা তা জানি না। এই ডিস্ট্রিবিউশনের ব্যাপার থেকেই আমাদের ভূমিকা আস্তে আস্তে কমে গেলো। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে, স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত আমরা সবাই প্রতিটি কর্মকান্ডে এক সাথে ছিলাম। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পর রাজনীতি যখন এখানে প্রতিষ্ঠা লাভ করলো, আবার যখন নির্বাচন হলো তখন আমরা আস্তে আস্তে বিভিন্ন কর্মকান্ড থেকে সরে গেলাম বা সরে যেতে বাধ্য হলাম বলা যায়।
       
                         

কোন মন্তব্য নেই :

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মন্তব্য পেলে খুশি হবো, সে যত তিক্তই হোক না কেনো।
পোস্টে মন্তব্যের দায়-দায়িত্ব একান্তই মন্তব্যকারীর। মন্তব্য মডারেশন আমি করি না, তবে অগ্রহনযোগ্য ( আমার বিবেচনায় ) কোনো মন্তব্য আসলে তা মুছে দেয়া হবে সহাস্য চিত্তে।