শনিবার, ২৩ আগস্ট, ২০০৮

পোকামানবের ঘর বসতি

কিছু কিছু মানুষ আছেন যাদের বড্ড আপন মনে হয়। হয়তো সামনা সামনি দেখা হয়নি তবুও মনে হয় এইতো সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলছেন " ভালো আছেন তো ? " জৈষ্ঠের প্রচন্ড রোদে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে প্রিয় মানুষটিকে খুঁজছি। হটাৎ তাকিয়ে দেখি সেই মানুষটি মুচকি হেসে বলছেন " রোদ চশমা পড়ে আছেন যে ! আপনার চোখ দেখতে পাচ্ছি না ।" তড়িঘড়ি করে রোদ চশমা খুলে তাকিয়ে দেখলাম সেই মানুষটিকে। একটু পাগলে অনেকটুকুই আবেগীয় একজন সুন্দর মনের সাধাসিধে মানুষ। পরনে ফতুয়া, দৃস্টিতে পাগলামী। পথে যেতে যেতে অনেক কথা। মনে হচ্ছিলো কত্ত দিনের পরিচয়।

বসুন্ধরা সিটি ঘুরে আজিজ মার্কেটের অন্তরে দূপুরের খাবার খেতে খেতে কত যে আলাপ, সাথে আরেক অন্ধকার মানব। উনি মাছ খান না, কিন্তু আমাকে সেধে সেধে খাওয়াতে ভুল্লেন না। নিত্য উপহার থেকে উনার কিনে দেয়া ৭১ এর স্টিকার দেয়া টি শার্ট যখনি পরি তখনি উনার কথা মনে পরে। বিশেষ কোনো দিনে পড়বার জন্য সযতনে রেখে দেয়া আছে সে টি শার্ট টি।

পোকামানব খ্যাত মানুষটির ডেরায় যাবার কথা বলছি এবার। ট্রেনে থাকতেই বার বার ফোন " সুমন, কোথায় আপনারা ? " " এইতো আমার মাত্র টংগি পার হলাম ।"
"এখন আমরা ভৈরবে । " এভাবে বলতে বলতে কখন যে ষ্টেশনে পৌছুলাম মনে পড়ছে না। বাজারের পাশে বড় মসজিদের কাছ গিয়ে যে কাউকে আমার নাম বল্লেই বাসা দেখিয়ে দেবে, এই ছিলো ঠিকানা। রিকশা ঠিক করছি, এমন সময় চমকে উঠে তাকিয়ে দেখি সেই মানুষটি, শিশুর মতো হাসছেন। অথচ উনার ষ্টেশন আসার কথা ছিলো না। আমাদের চমকে দিতে চলে এসেছেন। গ্রামের রাস্তায় রিকশায় টুং টুং করে বেল বাজাতে বাজাতে যখন পোকামানবের ডেরায় পৌছুলাম তখন মধ্য দূপুর।

বাঁশের তৈরি সুন্দর একটা সদর দরজা পেড়িয়ে পোকামানবের আস্তানায় ঢুকতেই মমতাময়ীর আগমন, সাথে দুই দেব শিশু।উনবিংশ শতাব্দীর সেই বাড়ী যেটাকে নিয়ে পোকামানব লিখেছেন "এখানেই জন্মেছি। কে জানে,এখানে মরতে পারলে হয়তো মৃত্যুটা অনেকখানি সহজ হবে! "

বাড়ীতে ঢুকতেই পোকামানবের সংগ্রহশালা। ডানেই পোকামানবের লেখালিখির আস্তানা, আরেকটি সংগ্রহশালা। এক এক করে দেখালেন হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একাত্তরের ইতিহাস, উনার লেখার সব পান্ডুলিপি, পরম মমতায় বাঁধিয়ে রাখা ব্লগে লেখাগুলো। সংগ্রহের জিনিসগুলো দেখিয়ে দিচ্ছিলেন শিশুর মতো করে। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম স্বপ্নগুলোকে।

মমতাময়ীর মমতায় বলি হয়েছেন অনেকেই, আমরাও হয়েছিলাম। খাবার খেতে খেতে এটা সেটা কত যে আলাপ, কত যে কথা। অসাধারন সব খাবার। ঘরে বানানো অসাধারন দই খেতে খেতে ভাবীকে প্রশ্ন করতেই জানতে পারলাম পোকামানবের মেজাজের খবর। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই মেজাজ উনার, এই ভালোতো এই খারাপ। আসলে মাটির মানুষ।

টয়লেটের দরজায় আমেরিকা-ব্রিটেনের যুগল পতাকা। কেউ জিগেস করলেই বলে দেয়া হয় যে দরজায় পতাকা দুটো পাবেন সেটাই টয়লেট। টয়লেটেও ক্লাসিক্যাল মিউজিক বাজে পোকামানবের। বাড়ীর সামনে ছোট্ট একটি বাগান। প্রথম রয়ালটির টাকা দিয়ে কেনা শিশুবৃক্ষটি এখন টগবগে যুবক। চোখের সামনে পোকামানবের আরেকটি স্বপ্ন তড়তড়িয়ে বড় হচ্ছে । মুক্তিযুদ্ধের সময় মর্টারের আঘাতে ধসে যাওয়া ছাদের অংশ টুকু দেখিয়ে বল্লেন যখনি এটা দেখি তখনি একাত্তর জেগে উঠে মনের মাঝে।

পোকামানব বল করছেন আমি ব্যাটিং করছি, ফিল্ডিং এ দুই দেব শিশু। এক ফাঁকে আমার শৈশবে ফীরে যাওয়া, দুস্ট বালকের মতো খেলায় মেতে উঠা। মাঝ খানে দূপুরের খাবারের জন্য ছোট্ট বিরতি। আবার গল্প। আবার আড্ডা।

গল্প গল্পে ইট পাথরের জংগলে ফেরত আসার সময় হয়ে এলো টেরই পাইনি। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো থেকেই যাই, কি হবে ইট পাথরের জংগলে ফেরত গিয়ে? হাঁটতে হাঁটতে ষ্টেশনে গিয়ে টিকেট কাটতে গিয়েও আরেক চমক। পোকামানবের শাসনে টিকিটও কাটা হলো না, উনি টিকিট কেটে দিলেন আমাদের জন্য। ট্রেন ছেড়ে দিলো , পোকা মানব হাতা নাড়াচ্ছেন, আমরা তাকিয়ে দেখছি, আস্তে আস্তে সব কিছু দৃস্টিসীমার বাহিরে চলে এলো, কিন্তু মনে হয় এইতো পোকামানব হাত নাড়িয়ে বলছেন " রাস্তায় কোনো সমস্যা হলে ফোন করতে ভুলবেন না কিন্তু। ঢাকায় পৌছেই ফোন দিবেন"।
রাস্তায় খাবার জন্য কিছু খাবারও দিয়ে দিয়েছিলেন মমতাময়ী, রাষ্তায়ই সেটা সাবরে দিয়েছিলাম, এতো সুস্বাদু খাবার সামনে দেখে সামলে রাখতে পারিনি।

" আমি না একটা সাপ দেখছিলাম, সাপটার মা নাই, সাপটার ভাই নাই, জানো সাপটার কেউ নাই ।" ঝাপলা ঝাপলি করা দেবশিশুটিও যেনো মিশে গিয়েছিলো আমাদের সাথে। লাজুক আরেক দেবশিশু লজ্জা কাটাতে অবশ্য একটু সময় লেগেছিলো। আর মমতাময়ীর কথা ! সেটা না হয় আরেকদিন।

অনেক কিছুই বলার ছিলো, অনেক কিছুই বলা হলো না। পোকামানবের নিষেধ সত্বেও পোকামানবের ঘর বসতি নিয়ে লিখে ফেল্লাম আজ।

কোন মন্তব্য নেই :

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মন্তব্য পেলে খুশি হবো, সে যত তিক্তই হোক না কেনো।
পোস্টে মন্তব্যের দায়-দায়িত্ব একান্তই মন্তব্যকারীর। মন্তব্য মডারেশন আমি করি না, তবে অগ্রহনযোগ্য ( আমার বিবেচনায় ) কোনো মন্তব্য আসলে তা মুছে দেয়া হবে সহাস্য চিত্তে।