বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ, ২০০৮

যে গল্প হয়নি বলা..................

কোকিলের ডাক শুনে হঠাৎ ঘুমে ভেঙে গেলো সাদিক সাহেবের। দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখেন ৯ বাজছে। উইসকনসিনের এই কনকনে ঠান্ডায় কোকিল আসবে কোথা থেকে ! কি যে হয়েছে আজকাল বুঝতে পারছেন না। সেদিন শুনলেন ঘঘুর ডাক, আজ কোকিল। মাথার মধ্যে কোকিলটা আজকাল বড্ড বিরক্ত করছে।

নিচে লাউন্জে ছেলে-মেয়েদের কথা শোনা যাচ্ছে। ওরা মনে হয় টিভি দেখায় ব্যস্ত। ফেরদৌসী মনে হয় রাতের খাবার তৈড়িতে ব্যস্ত। আজ কি রান্না হয়েছে ভাবছেন সাদিক সাহেব, ভাত নাকি ছেলে-মেয়েদের প্রিয় পাস্তা ?

হাত বাড়িয়ে পানি খেতে গিয়ে দেখেন গ্লাসে পানি নেই। ধ্যাত।
একটা সিগারেট ধরিয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ভাবছেন সাদিক সাহেব, সময় কতো দ্রুত চলে যায়। এইতো সেদিন, মনে হয় এইতো সেদিন। আজকাল বেশ নস্টালজিক হয়ে পড়েন অতীতের কথা মনে পড়লে। গংগাচড়ার মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান আজ আজ উইসকনসিনের মোহাম্মদ সাদিক, ৫৮ বছর বয়স্ক একজন সুখি- সংসারী মানুষ।

তৃতীয় বিশ্বের যেকোন এক দেশকে নিয়ে একটা একটা এসাইন্টমেন্ট করতে দিয়েছে, ছেলে ঠিক করেছে বাংলাদেশকে নিয়ে লিখবে যদিও বাংলাদেশে সে গিয়েছে মাত্র দুবার, ‌তাও সেই খুব ছোট্ট বেলায়। ইউএস তার দেশ, বাংলাদেশ তার বেড়ানোর জায়গা।

ছেলে এসেছিলো বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে, তার বাবার মুখ থেকে শুনতে।সাদিক সাহেব ফীরে গিয়েছিলেন সেই ৭১ এ। আগুনঝড়া সেই ৯ মাস। ইতিহাস শুরু করেছিলেন ৪৭ এর দেশ বিভাগ, ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন, ৭ই মার্চের বংবন্ধুর সেই ভাষন, ২৫ মার্চের কালোরাত, ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় উৎসব। বলতে বলতে সাদিক সাহেব বার বার ফীরে যাচ্ছিলেন সেই সময়টুকুতে। ১৫ অগাস্টের বংগবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার কথা বলার সময় বারবারে কেঁপে উঠছিলেন। ছেলে বলছিলো " ড্যাড কি ভাবে পুরো পরিবারকে নিঃশেষ করে দিতে পেরেছিলো ! বাংলাদেশের মানুষ কি কিছুই বলেনি, কিছুই করেনি ? "

২৫ মার্চের সেই কালো রাতে সাদিক সাহেব ছিলেন মুহসিন হলে। পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমন শুরু হবার পরে অনেক কস্টে কিভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন ছিলেন সেটা ভেবে শিউরে উঠেন এখনো। হলে থাকতে লেখা লেখির সাথে যুক্ত থাকলেও আজকাল আর হয়ে ‌উঠে না। মাঝে সাজে লেখেন, বেশ কবছর আগে দেশে তার ২/৩ টা বইও বের হয়েছিলো। তারপরো ভাবছেন আবারো লেখা শুরু করবেন। অন্তত নিজের ছেলে-মেয়েদের জন্য লিখবেন। এদের প্রকৃত ইতিহাস জানিয়ে যেতে হবে।

সেদিন বাংলাদেশ কমিউনিটির অনুস্ঠান ছিলো, বিশিস্ঠ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সাদিক সাহেবও আমন্ত্রিত ছিলেন। সবাই শুনতে চাচ্ছিলেন কথা, মুক্তির ইতিহাসের কথা। যুদ্ধের অনেক গল্প বলেছিলেন সে রাতে।

সিগারেটে শেষ টান মেরে বাট টা ছুড়ে দিয়ে সাদিক সাহেব ভাবছেন অন্য কথা। ভাবছেন, বিশিস্ঠ মুক্তিযোদ্ধা সাদিক সাহেব ৯ টি মাস কিভাবে নিরাপদে দেশে থেকেও মুক্তিযোদ্ধা হলেন অথচ ওপারেই কোচবিহার, ১ ঘন্টার হাঁটার দূরত্ব।এ গল্পটা বলতে পারেননি, ৭৫ এর ১৫ অগাস্টের পর বংগবন্ধুর হত্যার পর পোস্টার লেখার পরিবর্তে কিভাবে ব্যস্ত ছিলেন পাসপোর্টের ফরম ফিলাপের, আমেরিকা যে ডাকছে।

যুদ্ধে গিয়ে ফেরত না আসা কলিমের মা কি আজো কাঁদে?
এ গল্পটা বলা হয়ে ‌উঠেনি
মাথার মধ্যে কোকিলটা আজকাল বড্ড বিরক্ত করে।

কোন মন্তব্য নেই :

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনার মন্তব্য পেলে খুশি হবো, সে যত তিক্তই হোক না কেনো।
পোস্টে মন্তব্যের দায়-দায়িত্ব একান্তই মন্তব্যকারীর। মন্তব্য মডারেশন আমি করি না, তবে অগ্রহনযোগ্য ( আমার বিবেচনায় ) কোনো মন্তব্য আসলে তা মুছে দেয়া হবে সহাস্য চিত্তে।